২০১৫ বিশ্বকাপের মত সেমিফাইনালে বিদায় স্বপ্ণের দল নিয়েও স্বপ্ণভঙ্গ, তীরে এসেও তরী ডুবল ভারতের

সংবাদদাতা
ক্রীড়া প্রতিনিধি
সময়

শুরুটা দারুণ হয়েছিল মিশন বিশ্বকাপের লক্ষ্যে৷ অষ্ট্রেলীয়দের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিল ভারত৷ তারপর পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েষ্ট ইণ্ডিজের মত দলকে হারিয়ে দিয়েছিল ভারত৷ রাউণ্ড রবিন লীগে ইংলণ্ডের কাছে হার মানতে হলেও অন্যান্য সব দলকে হারিয়েছে ভারত৷ লীগের খেলায় নিউজিল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারত মাঠে নামতে পারেনি বৃষ্টির কারণে৷

সেমিফাইনালের শুরুটাও ভারত ভালই করেছিল নিউজিল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে টসে হেরে বল হাতে বুমরা ও ভুবনেশ্বর বিপক্ষকে বিপদে ফেলেছিল৷ পীচে ভাল বাউন্স থাকায় ভারতের অন্য বোলাররাও ভাল বল করেছে৷ শেষমেশ ৫০ ওভারে নিউজিল্যাণ্ড ২৩৯ রান তোলে৷ ভারতের বিরুদ্ধে এই রানটা বিশ্বকাপে অন্য সব দলের থেকে কম৷ সকলেই ধরে নিয়েছিল যে ভারত ফাইনালে যাচ্ছেই৷ কারণ ভারতের সাত-আট জন ভাল ব্যাটসম্যান রয়েছেন৷ অথচ সব হিসাব পাল্টে গেল যখন পরপর রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, কে. এল. রাহুল আউট হয়ে গেলেন৷ ভারতের রান তখন মাত্র ৫৷ এরপরও ভারত ধরে খেলতে পারেনি৷ ষষ্ঠ উইকেটে রবীন্দ্র জাদেজা ও মহেন্দ্র সিং ধোনি ম্যাচ প্রায় নিজেদের অনুকুলে নিয়ে আসছিলেন৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি৷ ভারতকে হার মানতে হয়েছে ১৮ রানে৷ একরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই ভারত ছিটকে গেল বিশ্বকাপ থেকে৷

খেলায় হার-জিত আছেই৷ কিন্তু বিপক্ষের থেকে যদি দল দুর্বল হয় তখন মেনে নেওয়া যায় নিজেদের পরাজয়কে৷ আসলে নিউজিল্যাণ্ড দল মোটেই ভারতের থেকে শক্তিশালী নয়৷ এই দল এই বিশ্বকাপেই অষ্ট্রেলিয়ার কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে হেরেছে৷ আবার অষ্ট্রেলিয়াকে ভারত লীগ ম্যাচে পরাজিত করেছে৷ তবে সেমিফাইনালের মত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কি উপযুক্ত চিন্তাভাবনা করেননি৷ এই প্রশ্ণ ক্রিকেট বোদ্ধারা তুলতেই পারেন৷ পরাজয়ের ম্যাচের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে মনে হবে ভারতকে নিউজিল্যাণ্ড হারায়নি, ষ্ট্র্যাটেজির ভুলে ভারত নিউজিল্যাণ্ডে কাছে আত্মসমর্পণ করেছে৷ কারণ প্রথমতঃ ভারত পাঁচ বোলার নিয়ে খেলেছে৷ পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে পাঁচ বোলার নিয়ে খেলা বিপজ্জনক, কারণ যদি একজন বোলারও বেশী রান দিয়ে ফেলেন তবে অন্য বোলার না থাকায় বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হবে৷ ম্যাঞ্চেস্টারের পীচে মহঃ সামির মত বিপজ্জনক বেলারকে দলের বাইরে রেখে হয়তো ভুল হয়েছে ভারতের৷ কারণ সামি থাকলে ওই স্যুইং উইকেটে নিউজিল্যাণ্ড আরও কম রান করতে বাধ্য থাকত৷ মনে রাখতে হবে অন্য মাঠের চেয়ে ম্যাঞ্চেষ্টারের মাঠ যথেষ্ট বড়৷ তাই ওভার বাউণ্ডারী মারাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়৷ চাহ্বালের যে ওভারে কিউয়ি ব্যাটসম্যানরা ১৮টি মূল্যবান রান করেছিল তা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল৷ সামি থাকলে প্রারম্ভিক ব্যাটসম্যানরা আরও বিপদে পড়ত ও উইকেট খোয়াতে বাধ্য হ’ত৷ সেক্ষেত্রে ২০০-র মধ্যে বিপক্ষের ইনিংসকে থামিয়ে দেওয়া যেত৷ দ্বিতীয়তঃ যদিও রবীন্দ্র জাদেজা, ঋষভ পন্থরা ভাল ফিল্ডিং করেছেন বেশ কিছু রান বাঁচিয়েছেন, কিন্তু কয়েকটি ওভার থ্রোর দরুণ চার-পাঁচটি অতিরিক্ত রান পেয়েছে নিউজিল্যাণ্ড৷ এমনকি তারা বেশ কয়েকটি এক রানকে দুই রানে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছে৷ এইসব খুঁটিনাটি বিষয়গুলি ভারতের হারের কারণ বলা চলে৷ তৃতীয়তঃ যদিও বা মহঃ সামিকে দলে রাখা হ’ল না তবে অবশ্যই এই দলে কেদার যাদবকে অবশ্যই প্রয়োজন ছিল৷ এই তরুণ খেলোয়াড় সিঙ্গলস নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পটু, দীনেশ কার্ত্তিক যা পারেননি৷ ত্রিশটারও বেশী বলে দীনেশ কোনও রান করতে পারেননি৷ এতে সহজেই অনুমেয় ভারতের হার কোন জায়গাতে হয়েছে৷ চতুর্থতঃ চার নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে দীনেশের পরিবর্তে মহেন্দ্র সিং ধোনীকে ব্যাট করতে পাঠানোর প্রয়োজন ছিল৷ কারণ ধোনী অন্য ব্যাটসম্যানকে বার বার ষ্ট্রাইক দিয়ে ম্যাচ বের করার জন্য যথেষ্ট সময় পেতেন৷ এই কাজে ধোনী যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও সিদ্ধহস্ত৷ ষষ্ঠ উইকেটে রবীন্দ্র জাদেজা ও মহেন্দ্র সিং ধোনী যে খেলাটা খেলে দিলেন তাতে ভারত জেতার জায়গায় চলে যেত, বড় শট মারতে গিয়ে সেট ব্যাটসম্যান জাদেজাতে ঝঁকি নিতে হ’ত না৷ কারণ কারণ তাঁদের ওই খেলাটা যদি চতুর্থ কিংবা পঞ্চম উইকেটে হ’ত তবে খেলার ফল অবশ্যই অন্যরকম হ’ত৷ সুতরাং চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেমিফাইনাল দল নির্বাচনে ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাটিং লাইন-আপ ঠিক না করার জন্যেই ভারতকে নিউজিল্যাণ্ডের কাছে সামান্য মাত্র কয়েকটি রানের ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়েছে৷

অনেকে বলতে পারেন নিউজিল্যাণ্ড ভাল খেলেছে তাই ভারত পরাজয়৷ ভাল খেলার বিরুদ্ধে আরও ভাল খেলার জন্যেই বিশ্বকাপে ব্যাট-বলের লড়াই৷ লীগ শেষে শীষস্থান দখল করে ভারত চতুর্থ স্থানের নিউজিল্যাণ্ডের কাছে হার মানল!

আসলে এত বিশ্লেষণ মনের মাঝে উঁকি মারত না যদি ভারতীয় দল দুর্বল হ’ত৷ এই দলে যে ব্যাটসম্যান বা বোলাররা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের তালিকায়৷ বর্তমান ভারতের এই দলটি যথেষ্ট শক্তিশালী৷ বিশ্বকাপ শুরুর পরে ভারত যে ক্রীড়ানৈপুণ্য মাঠে রেখেছিল তাতে অনেকেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতকেই ভেবেছিলেন৷ ২০১৫-র বিশ্বকাপের মত সেমিফাইনালের নক-আউটে নক-আউট হয়ে গেল ভারত৷ ২০১৯-র স্বপ্ণের দল গড়েছিল ভারত৷ কিন্তু স্বপ্ণের দল নিয়ে স্বপ্ণ দেখা হ’ল, স্বপ্ণ সফল হ’ল না৷ অনিশ্চিততার এই ক্রিকেট খেলায় এটাই স্বাভাবিক৷ মন না চাইলেও কঠোর বাস্তবটাকে মেনে নিতেই হবে৷ অপেক্ষায় থাকতেই হবে ১৯৮৩, ২০১১-র স্বপ্ণের বিশ্বকাপ জয়ের পুনরাবৃত্তির জন্যে--- ভারতীয় ক্রিকেটে অনুরাগী হিসেবে আমাদের কাছে এটাই পাওনা হয়ে রইল৷