অবহেলিত  বীরভূম সম্বন্ধে   দু’চারকথা

লেখক
প্রভাত খাঁ

মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  তাঁর ‘বাংলা  ও বাঙালী’ গ্রন্থের  প্রথম  খন্ডে  ‘সভ্যতার  আদিবিন্দু রাঢে’  বীরভূম সম্বন্ধে  বলেছেন---‘‘অষ্ট্রিক ভাষায় ‘বীর’ মানে অরণ্য৷ সাঁওতাল  পরগণা জেলার  রাজমহল ও পাকুড় মহকুমা, বর্তমান বীরভূম  জেলার  রামপুরহাট  মহকুমা, মুর্শিদাবাদ জেলার  কান্দি মহকুমা ও রাঢ় অংশে (ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্ত্তী অঞ্চলে)  বীরভূমের সিংহ  পদবীধারী কায়স্থ  রাজারা রাজত্ব করতেন৷ এঁরা বহুকাল  বৌদ্ধধর্মকে  ঠেকিয়ে  রেখেছিলেন৷’’

১৮৫৬ সালে যখন  সাঁওতাল  পরগণা জেলা তৈরী হয় তখন  পাকুড়  মহকুমা ও রাজমহল মহকুমাকে ওই জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হল৷ পরবর্তীকালে কান্দি মহকুমাকেও বীরভূম থেকে বিচ্ছিন্ন করে  মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়৷

 এই অঞ্চলের জনগণ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়  ও অন্তর্মুখী তাই এরা সরাসরি  কোন প্রতিবাদ করেনি৷ তারা  সব কিছুকে  মেনে নিয়েছে শান্তমনে৷  ইংরেজ রাজত্বে এই এলাকার আর্থিক উন্নয়নে ছোট রেল স্থাপন করা হয়৷ ম্যাকলয়েড কোম্পানি এই কাজ করেন৷ ছোট রেল লাইন করা হয় আহম্মদপুর থেকে কাটোয়া পর্যন্ত৷  কাটোয়ায় বড় রেল লাইন ও আহম্মদপুরে বড় রেললাইন ছিল৷ এই ছোট রেললাইনের মাধ্যমে বড় রেললাইনের সঙ্গে এই এলাকার যোগসূত্র স্থাপিত হয়৷ এই ছোট রেললাইনটির এককালে অবদান ছিল অনেক৷ বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুর এই ছোট লাইনেই পড়ে৷ কীর্ণাহার  নিবাসী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়ের  বাসভূমি কীর্র্ণহার  স্পর্শ করে  এই ছোট রেললাইন ছিল৷ সম্প্রতি এটিকে  বড় ব্রডগেজ রেললাইনে  রূপান্তরিত করা হয়৷ এরজন্যে  বেশ কিছুদিন লাইনটি  বন্ধ ছিল৷ এখন বড় রেল লাইন  হলো, কিন্তু এতে এলাকার  কোন আর্থিক  উন্নতি  হল না৷ বর্তমানে কাটোয়া থেকে ১ টি  ট্রেন  আর আহম্মদপুর  থেকে  একটি ট্রেন  সপ্তাহে  ৬দিন  ২বার  করে যাওয়া আসা  করার সিদ্ধান্ত  রেল কর্ত্তৃপক্ষ নেয়৷ তা-ও রবিবার  বন্ধ থাকে৷ দেখা গেল কয়েকদিন  এই বড় রেল চলার পর  বিশেষ কোন কারণে  রেল যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়৷ ছোট লাইনের সময় যে সব ষ্টেশনে ট্রেন থামানো হত, সেই সমস্ত ষ্টেশনে ট্রেন না থামানোর জন্যে এলাকার  জনগণের মধ্যে দারুণ ক্ষোভ  জাগে৷ তারা প্রতিবাদ জানায়৷ আগে যেমন হল্ট ষ্টেশনগুলিতে,  যেমন  মহেশপুর  ষ্টেশন ও অন্যান্য অনেক হল্ট স্টেশনে ছোট রেল থামত  সেগুলিতে ট্রেন থামা বন্ধ  করে দেওয়াতে  আশপাশের গ্রামগুলি রেল  যোগাযোগ থেকে  বঞ্চিত হয়৷  ফলে ঢাকঢোল  পিটিয়ে  যে বড় রেল কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার  চালু  করলো  তাতে পর্বতের  মুষিক প্রসবই  হলো ৷ স্থানীয়  লোকদের  কোন  আর্থিক  উন্নয়ন ঘটলো না৷

এই এলাকার  মানুষগুলি  ছোটরেল লাইনের দৌলতে  কাটোয়া পর্যন্ত এসে  বড় রেল ধরতে  পারতো  তাতে তাদের  অনেক সুবিধা হত৷ রেলের  সংখ্যাও বেশী ছিল৷ কিন্তু এই বড় রেল নামেই বড় হল কিন্তু  জনগণের তা  তেমন কিছু ভালো  করতে সবম হয়নি৷

আর্থিক দিক থেকে বীরভূম জেলা একসময়ে  পশ্চিমবঙ্গের চালের  প্রয়োজন সেটাকে  অনেকটা মিটিয়ে দিত৷ এখানে বিখ্যাত  উন্নতমানের  ধান ফলতো যার  নাম ‘ভাসামাণিক’৷ সেই চাল  বর্ত্তমানে প্রায় লুপ্ত৷ জেলার চাষেরও  উন্নতি ঘটানো  দরকার৷

এই বড় রেললাইনটি  আরও  বড়  রেলগাড়ির  যোগান দিয়ে প্রায় সব ষ্টেশনে  রেল থামার ব্যবস্থা করে’ এটিকে আর্থিক উন্নয়নে কার্যকরী করে  সরকার জনগণকে আর্থিক  সংকট থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুক৷ কারণ  প্রতিটি স্টেশনে  বাজার হাট, দোকান আগের চেয়ে বেশী দরকার৷ জন সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে এই লাইনের গাড়িগুলিকে সরাসরি ব্যাণ্ডেলের সঙ্গে যুক্ত করার  বন্দোবস্ত করে আর্থিক উন্নয়নে  এই এলাকাকে এগিয়ে নিয়ে  যাওয়ার জন্যে কেন্দ্র  সরকার চিন্তা করুক৷

বীরভূমের রাস্তাগুলির  সংস্কার হচ্ছে৷ কিন্তু  শিল্প  এলাকা গড়ে না ওঠায়  ব্লকগুলিতে  আর্থিক উন্নতি ঘটানো  সম্ভব  হয়নি৷  আহম্মদপুরের চিনির কলটি পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে৷ এটির উন্নয়ন ঘটানো জরুরী৷ এই জেলা সবদিক  থেকে বঞ্চিত৷ জলের অভাবে  চাষের  উন্নয়ন  ব্যাহত  হচ্ছে৷ ভূমি  সংস্কার , জৈব  সারের উৎপাদন সহ  ব্লকগুলিতে যাতে  চাষীরা সমবায় ভিত্তিতে  ঐক্যবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষিসহায়ক শিল্প গড়ে এই কৃষিপ্রধান  জেলা  বীরভূমকে  উন্নয়নের  পথে  নিয়ে যাওয়াটা হলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ তাই  জনগণকে  সমাজের  আর্থিক  কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার  সময় এসেছে ৷

 বীরভূমের  মাটিতে  অনেক  আশা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন  গড়ে তুলেছিলেন৷ তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন,  পরাধীন ভারতের বুকে৷ সেই  শান্তিনিকেতন  আজ  কোন পর্যায়  এসে পৌছেছে, ভাববার বিষয়৷  শান্তিনিকেতনে এখন আর সেই শান্তি নেই, উচ্চ আদর্শও নেই!

নানুরের  দ্বিজ চণ্ডীদাস-এর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘‘শুণরে মানুষ ভাই৷  সবার উপরে  মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’’ মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করেছে বহু বছর আগে৷ সেখানকার নোংরা দলবাজির  বর্তমানে  নানুর সহ এই এলাকার পরিস্থিতি  মানুষকে  লজ্জা দেয়!  কবি জয়দেব এই জেলার গর্ব! তন্ত্রভূমি হলো বীরভূম৷  সেই জেলা আজ পড়ে পড়ে কাঁদছে৷ তাই বীরভূমের দিকে সরকার বিশেষভাবে নজর দিক, এটাই একান্ত কাম্য৷