অচ্ছা (ভাল) দেশের স্বচ্ছ প্রশাসনের  এত দুরবস্থা কেন?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

প্রকৃতি মায়ের কোলে অবস্থান করে,সবুজ রঙের মখমলের গালিচা পাতা ধরিত্রীপৃষ্টে শুয়ে বা বসে, মাথার উপরে দিগন্ত বিস্তৃত হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে কার না মন চায়? অনন্ত উদার সুনীল আকাশে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে মনটাকে ঘুড়ি বানিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে কার না মন চায়? আবার যদি সময়টা হয় শরতের শিউলি সুরভিত সকাল তাহলে আমাদের নীল সায়রের বুকে শাদা শাদা খণ্ড মেখে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যটা কার মনকে উদার না করে ছাড়ে? যদি বা হয় শরতেরই কোন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাত তাতেও কিন্তু মন-কাড়া রূপালি রঙের পাড় আর চুমকি গাঁথা আঁচলসহ নীল-রঙের শাড়ী-পরা শারদাময়ীর রূপৈশ্বর্যের মোহে বিভোর না হয়ে থাকা যায় না৷ আবার বাসন্তী পূর্ণিমাতেও রক্তগোলাপের পাপড়ি রাঙা পাড় আর আঁচল সমৃদ্ধ সবুজ শাড়ী পড়া পৃথিবী যখন উপরে ফিরোজা রঙের উদার আকাশের পানে তির্যক ভ্রূ-ভঙ্গীসহ আড় নয়নে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে অব্যক্ত মিঠি-মিঠি চপ্পল হাসি ফুটিয়ে তোলে,তাতেও যে-কোন প্রেমিক-হৃদয়ে সাড়া না দিয়ে পারে না৷

আবার সূর্যাস্তের বেলায় পশ্চিমের সারাটা দিগবলয় লজ্জা-বিব্রত হয়ে লালাভ-মুখ হয়ে উঠুক না কেন, এর চেয়েও ঢের মনোমুগ্দকর ও  মোহময় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কোন সুনির্মল প্রতূ্যষে ঊষার আগমন-মুহূর্তটি যখন অরুনিমার লাজুক লাজুক ওষ্ঠাধরের ফাঁকে মিষ্টি হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে ভোরের ঝিরি ঝিরি উদাস হাওয়ার বুকে আর চারিদিক থেকে গাছে গাছে কিশলয়েদের দাপাদাপি শুরু হয়ে যায় ফুলবাগিচায় ফুলকলিরা পাপড়ির আবরণ উন্মোচন করে পূর্ণপুষ্পরূপে প্রস্ফূটিত হতে শুরু করে অলিরা ছুটে আসে মধু আহরণের দিশা নিয়ে আর কুঞ্জে কুঞ্জে  পাখীরা কল-কাকলিতে মেতে উঠেছে৷ সত্যি প্রদোষকালের  আকাশ আমাদের যতই সুন্দর ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে যাক না কেন, প্রত্যূষের ঊষা-রঞ্জিত আকাশ কিন্তু তারও চেয়ে শতগুণে বেশী নবোন্মেষের আশায় প্রত্যেকের মনেই নবারুণের আলোকে উদ্দীপিত করে পাঞ্চজন্যের সুরে উদ্বোধিত করে তোলে৷ কিন্তু এত সব কিছু সম্ভব হয়ে উঠে, যদি আবহমণ্ডল পরিচ্ছন্ন থাকে আকাশটাও মেঘমুক্ত থাকে বায়ুপ্রবাহ থাকে শান্ত-স্নিগ্দ ও ধীর-স্থির৷ আর,এর পরিবর্তে যদি, ঘন- কালোমেঘে আকাশ ঢাকা থাকে, আবহমণ্ডলে গুমোট ভাব বিরাজ করতে থাকে শান্ত সমীরণ প্রবলাকার পবনরূপ ধারণ করে বাত্যাবেগে ঝঞ্ছা বা প্রভঞ্জনরূপে এসে হাজির হয়, উদার আকাশও তখন  মুহূর্তে তার স্বভাব বদল করে উগ্রমূর্তি ও রুদ্ররূপ-ধারণ করে বজ্র-বিদ্যুত- নিক্ষেপে ধরাবাসীকে ছন্নছাড়া ও অস্তিত্বহারা করে তুলতে উদ্যত হয়৷

মনে হয়, আমাদের অর্থাৎ মানুষ-নামক জীবদের ক্ষেত্রেও প্রকৃতির এই ছলনাময় রূপ ভূমিকা পালনের কিছু না কিছু মিল অবশ্যই রয়ে গেছে৷ আর মনের এই অনুভূতিপ্রবণ আকুতি থেকেই এই মুহূর্তে আমার এই নিবন্ধ-রচনার উদ্যোগ করেছি বলতে হচ্ছে৷

প্রতিরোজ ভোরবেলার রুটিন মাফিক,কর্তব্য সমাপণের পরমুহূর্তে কিছুটা সময় আমার বরাদ্দ করা থাকে স্বাধ্যায়ের জন্যে৷ তখন, সচরাচর যেমনটা হয়ে থাকে, অভ্যেস মতোই আমার পরমারাধ্য গুরুদেবের প্রণীত কোন না কোন বই বা লেখা থেকে  কিছুটা পড়ে নেবার জন্যে৷ কিন্তু, আজকের সকালবেলাটা অভ্যেস মত শুরু হয়ে যাবার পরও কেন বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমটায় মনটা যেন বিগড়াতে শুরু করেদিল--- অন্য কিছু একটা পড়ে নিতে৷ সেকেণ্ড কয়েক ভাবলুম কী করা যায়৷ ভাবলুম, পড়ার কাজটা রেখে দিয়ে কাগজ আর কলম হাতে নেব কিনা৷ না তাও মন মানতে চাইছে না৷ অগত্যা টেবিলটার পাশেই ছিল গুটিকয়েক রাখা বইগুলোর মধ্যে প্রখ্যাত নীরদচন্দ্র চৌধুরীর রচিত ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ আর স্বনামখ্যাত লেখক কালিপদ বিশ্বাস-রচিত ‘যুক্ত বাঙলার শেষ অধ্যায়’ নামের বই দু’খানাও৷ তাই উক্ত ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ বইটাই তুলে আনলুম ও এ বইয়ের আগে পড়ে---রাখা পৃষ্ঠাটাও বের করে পড়তে শুরু করে দিলুম৷ কিন্তু, মন-পবন উতলা--- কিছুতেই বেগ-সংবরণ করতে পারছিলুম না৷  মনের আকাশে যেন চারদিক থেকেও অজস্র কালো মেঘেরা এসে ভীড় জমাতে শুরু করে দিচ্ছিল৷ উক্ত ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ বইটার এক জায়গায় লেখক নিজেই তাঁর জীবনের প্রথম দিককার একটা লিপি-চিত্র আঁকলেন এই মর্মে যে, সেই সময়ে অভিজাত বাঙালীরা অনেকেই পড়াশোনা চালাতেন ইংরেজী ভাষায়, আবার নিজেদের ভাব ব্যক্ত করতে সাহায্য নিতেন মাতৃভাষা বাংলার৷ আমি দ্বিধাহীনভাবেই এ স্বীকারোক্তি করছি স্পষ্টভাবে যে ইংরেজী ভাষার দউলতে আর পাশ্চাত্য সভ্যতার জাদুকরী প্রভাবে ভারতবাসী আমরা আর বিশেষ করে বাঙালীরা যথেষ্ট উপকারী হয়েছি বটে, তবে আমরা হারিয়েছিও অনেকটাই৷ অবশ্য এর পেছনেও যথেষ্ট জোরালো ঐতিহাসিক সমর্থন রয়েছে৷ এর খানিকটা আভাস এখানে তুলে ধরে আমি আমার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চাইছি৷

আমাদের এ ভূ-ভাগের নাম তখনও ‘ভারতবর্ষ’ হয়নি, যখন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অপেক্ষাকৃত উর্বর অঞ্চল, যার প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিমণ্ডল ছিল মানুষ্যবসতির উপযোগী৷ আর সেই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় পরবর্তীকালে সেখানে মানুষের আবির্ভাব ঘটারও পরে যখন মানুষের মুখের ভাষার স্ফূর্তি ঘটেছিল তারও পরে৷ প্রাচীন পৃথিবীতে সর্বপ্রথম যেসব বিশেষ বিশেষ বিন্দুতে প্রথম মানুষ ভূমিষ্ট হয়েছিল তাঁদের মধ্যে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের রাঢ় ---অঞ্চলেই পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তান সূর্যের আলো দেখেছিল, এটাই ঐতিহাসিক সত্য বলে ঘোষণা করেছেন প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তাঁর লেখা ‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’ বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে রাঢ়-ভূমিতেই পৃথিবীর মানব সভ্যতার প্রথম প্রদীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল৷ পরে সেখানকার অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষের ভাষায় সেই ভূ-ভাগের নাম হয়ে যায় রাঢ়, যার বাংলায় মানে হয়--- লালমৃত্তিকার দেশ৷ আর্যরা পরে---এদেশে এসে এর নাম দেয় ‘রাঢ়’, চীনারা বলত ‘রাঢ়া’ আর গ্রীকেরা নাম দিয়েছিল ‘গঙ্গারিঢ়ি’ বলে৷

তারও পরবর্তীকালে মধ্য-এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতবর্ষে এসে প্রবেশ করে৷ আর সেই সময়ে কৃষি-ভিত্তিক তন্ত্র-প্রভাবিত অষ্ট্রিকদের সঙ্গে  পশুজীবী, যাযাবর আর্যদের  অহরহ সংঘর্ষ চলত৷ সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে একদিকে বৈরিতা প্রকাশ পেত ও অপরদিকে উভয় জনগোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণও ঘটে চলছিল৷ সেকালে বর্তমানে ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চল ঘিরে এই আর্য-অষ্ট্রিক মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছিল আর্র্যবর্ত৷ আবার, অন্যদিকে অষ্ট্রিকদের সঙ্গে  নিগ্রোয়েড ও মঙ্গোলায়েডদেরও রক্ত সংমিশ্রণ ঘটেছিল৷ অষ্ট্রিক-নিগ্রোয়েড রক্ত-সংমিশ্রণের ফলে উদ্ভব ঘটেছিল দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর --- গড়েও উঠেছিল নগরকেন্দ্রিক, দ্রাবিড়-সভ্যতা৷ আধুনিককালে ১৯২৯ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস-ব্যানার্জী কর্তৃক  হরপ্পা-মহেনজোদাড়োর সভ্যতার ধবংসাবশেষ আবিষ্কারের পরই বিশ্ববাসী জানতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা আর্য---সভ্যতা নয় সেটি হল অষ্ট্রিক তথা দ্রাবিড়-সভ্যতা৷ (ক্রমশঃ)