আদর্শ গ্রামোন্নয়ণের ভাবনা বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সোপান

লেখক
আচার্য রবীশানন্দ অবধূত

আনন্দপূর্ণিমা ধর্ম মহাসম্মেলন সবেমাত্র শেষ হলো৷ গ্রামের মার্গীদের সুখ দুঃখের  কাহিনীর কথা শুনছিলাম৷ সেটা ২০০৯ সালের জুন মাস, তখনও আনন্দনগর অঞ্চলে বৃষ্টির হদিস নেই৷ সকাল নয়টার পর ঘর থেকে বেরোলে শরীর যেন ঝলসে যায়, জিব শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়৷ এই তীব্র দাবদাহের পরিবেশে দু’তিন জন মার্গী বলছিলেন যে, ওদের পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই৷ গ্রামের কুয়োগুলো আরও একমাস আগেই শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে, ওদেরকে এক কলসি জল আনতে আসা যাওয়ায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা ভেঙে গলা ভেজানোর ব্যবস্থা করতে হয়৷

আমি কিন্তু শুণে অবাক হইনি, কারণ আনন্দনগরের আশেপাশের গ্রামগুলোর এহেন দুর্দশার কথা কমবেশী আগেও শুণেছি৷ তাই সব শুনে আমি ওদের কাছে সমাধান সূত্র জানতে চাইলে ওঁরা বললেন যে, গ্রামে  বহাল জমির কাছে নতুন কুয়ো খনন করলে সমস্যার  সমাধান সম্ভব৷ শুণে দেরি করিনি, পরদিনই অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে কূয়ো খননের কাজ শুরু হলো কিন্তু বিধি বাম, একটু গভীরে যেতেই পাথর পড়লো, তাই জলস্তর পাওয়া গেল না, কিন্তু নিরাশ না হয়ে পাশেই আরেকটি  জায়গায় খননকার্য শুরু করতে বললাম, এবার কিন্তু আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেল৷ খুব ভাল জলস্তর,সেদিন ওদের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে  পেরে যারপরনাই আনন্দিত  হয়েছিলাম৷ সেই কুয়ো আজও  সমভাবে ব্যবহৃত হয়ে চলছে৷

তখন থেকেই ভেবে চলেছিলাম যে, এই অবহেলিত গ্রামটির নানবিধ সমস্যার স্থায়ী সমাধান কিভাবে করা যেতে পারে৷ ডামরুঘুটু একটি পশ্চাৎপদ, অনুন্নত, নানাদিক থেকে বঞ্চিত সাঁওতাল  গ্রাম৷ এই গ্রামেরই একটি একেবারে সংযুক্ত অংশ বেলাঘুটু, কিন্তু  এই বেলাঘুটু, ডামরুঘুটু গ্রামের অঙ্গ নয়৷ এটা অন্য পঞ্চায়েতের  অংশবিশেষ৷ সমস্ত  দিগ্‌দর্শনের কথা বিবেচনা করে বেলাঘুটুকে ডামরুঘুটুর বর্ধিতাংশ হিসেবে ধরে নিয়েই আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করেছি৷ বেলাঘুটুতে সাঁওতালদের সাথে সাতটি মুসলিম পরিবারও আছে৷ অতএব আমাদের কর্মযজ্ঞে ডামরুঘুটুর সঙ্গে বেলাঘুটুর সংযুক্তিকরণ ও অভেদ ভাবনায় পরিচালিত সেবাকার্য বর্তমান ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে এক ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত৷

এই অঞ্চলটির নব্বই শতাংশ মানুষই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে  হোঁচট খেয়ে দিনমজুরীর দ্বারা দিনাতিপাত করে৷ প্রায় পরিবারেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাই দুঃখকষ্টকে ফাঁকি দিতে অধিকাংশ সময়ই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এইভাবেই চলছে! তাদের  মানুষ হওয়ার সুযোগ কোথায়? সত্যিকারের দরদ দিয়ে কেউ কি ওদের কথা ভেবেছেন! না সেটা কেউ করেন নি৷ তাই আজও ওদের এই করুণ দশা৷ যুগস্রষ্টা জগৎ গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী  অন্যান্য ধর্মগুরুর ন্যায়  তাঁর প্রধান আশ্রম বড় বড় নগর-মহানগরে স্থাপন না করে কেনই বা জনবিচ্ছিন্ন, জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করলেন! হয়তো এর অজস্র কারণ আছে, কিন্তু এইসব কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো যাদেরকে এই সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী অমানুস করে রেখেছে৷  তাদের কাছটিতে বসে তাদের সুখ দুঃখের কথা শোণা, ব্যথা বেদনার অংশীদার হওয়া, মনের সমস্ত ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ওদের সমস্যা সমাধানের জন্যে চিন্তা ভাবনা করা, সদর্থক কিছু করার সুযোগ করে নেওয়াটি অত্র অঞ্চলে আশ্রম স্থাপনের অন্যতম কারণ৷ ডামরুঘুটু গ্রামে বহু বছর যাতায়াত করলেও  ওদের সমস্যা আগে তেমন করে বুঝিনি, যতটা ২০০৯ সাল থেকে বুঝেছি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও গভীর ভাবে সদর্থক কিছু একটা যে করবো সাংঘটনিক কাজকর্মের চাপে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি৷

কিন্তু করোনার লক্‌ডাউন আমাকে সে সুযোগ এনে দিয়েছিল৷ লক্‌ ডাউনে ত্রাণ কার্যের ফাঁকে ফাঁকে নিবিড়ভাবে ভাবছিলাম যে, কোথায় কি করতে পারি, কোথায় আছে কাজের সুযোগ! মনের এই ঐকান্তিক ভাবনা থেকেই ডামরুঘুটুতে  প্রাউটের এই আদর্শ গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা৷ ডিপার্টমেন্টের সবাইকে নিয়ে সভার পর সভা অনুষ্ঠিত হলো, শুরু হলো নিবিড় আলোচনা, চুল ছেঁড়া বিচার বিশ্লেষণ৷ করবো কি করবো না, পারবো কি পারবো না ! অবশেষে করোনাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বর্ষিত হলো পরমপিতা বাবার অপার করুণা৷ আমরা সবাই একমত, সংঘবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আনন্দনগর তথা ডামরুঘুটুতে৷ তীব্র সংকট৷ অর্থ সংকট, যাতায়াতের সমস্যা, আশ্রয়ের সমস্যা, ছিল রোগাক্রমণের ভয়৷ এতসব সত্ত্বেও সবকিছুর রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে,একমাত্র তাঁর নামকে পাথেয় করে এগিয়ে চলেছি আমাদের লক্ষ্যের পানে, এই বাস্তবমুখী মহান কর্মযজ্ঞে আমরা উৎসর্গ করলাম আমাদের বিভাগীয় সংঘশক্তিকে৷ সমস্ত ভয়, সংশয় নিমেষে যেন উড়ে গেল, ভূমামানস তরঙ্গের ঢেউতে সবাই  হলো স্পন্দিত, তাঁর কৃপাবারি হলো বর্ষিত, দিক দিগন্তে ধবনিত  হলো মাভৈঃ মাভৈঃ৷ পরম করুণাময়ের  অসীম  কৃপায়  আমরা অভাবনীয়ভাবে এগিয়ে চলেছি আমাদের মহান কর্মযজ্ঞের বাস্তব রূপায়ণে৷ আমাদের নির্বাচিত বিয়াল্লিশটি প্রকল্পের মধ্যে বর্তমানে বারোটি প্রকল্পের কাজ বাবার স্নেহধন্য সুপু ও সুপুীদের   স্বতঃস্ফূর্ত  সহযোগিতায় আমরা নিয়মিতভাবে করে চলেছি৷

এই লকডাউনের মধ্যে কারোর কাছে আমাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল না, তা সত্ত্বেও আদর্শানুরাগী, মিশনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ দাদা, দিদি, ভাই ও বোনেরা যেভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন তা সত্যিই অভাবনীয়৷ এমনকি সরাসরি মার্গীয় আদর্শ ও সংঘটনের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন  শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গুণীজনেরাও আশাতীতভাবে সহযোগিতা করেছেন৷ এগুলো সবই পরমারাধ্য বাবার অসীম কৃপা,  আমরা শুধু উপলক্ষ্য মাত্র৷ তিনি অলক্ষ্যে থেকে তাঁর প্রতিটি কথা রক্ষা করে চলেছেন৷ আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করতে তিনি হামেশাই বলতেন ‘‘তোরা এক পা এগোলে আমি তোদের দশ পা এগিয়ে দোব৷’’

আজ এই সামাজিক অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল তথা দীর্ঘমেয়াদী ঘটনমূলক কাজে নেমে প্রতিমূহূর্তে তা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করছি৷ মানবপ্রেমিক ধর্মগুরু  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর মানুষের  প্রতি যে কি ধরনের প্রাণভরা অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল, তাঁর সংস্পর্শে যারা যায়নি তাদের পক্ষে তা উপলদ্ধি করা সত্যিই দূরূহ৷ তিনি বলতেন যে, ‘যে কোন সমস্যা সমাধানের মূল উপাদান হলো ভালবাসা’ আমার মনে পড়ে, ১৯৮১ সালের ৯ই জুন ধর্মসমীক্ষার  জন্যে ৫১১ নং যোধপুর পার্কের বাবার ঘরে ঢুকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে ওঠার পর াা একটু শাসন করলেন, কয়েকটি বেত্রাঘাত ও করলেন, তাতে আমার যতটা না কষ্ট হচ্ছিল, তা  লক্ষ গুণ বেড়ে গেছিলো, যখন  তিনি কাছে টেনে কোলে বসিয়ে বললেন ‘‘দেখরে মানুষের  খুব কষ্ট, তুই তাদের অশ্রু মুছিয়ে হাসি ফুটাবি তো! াার সেই মর্মস্পর্শী, মানবতার প্রতি মমত্বপূর্ণ, আবেগঘন জিজ্ঞাসার উত্তর সেদিন াাকে দিতে পারিনি, আমি এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম৷ মানুষের প্রতি াার অপার করুণাময় নিখাদ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ শব্দগুচ্ছ আমাকে করে দিয়েছিল নির্বাক, অশ্রুই ছিল শুধু আমার সম্বল৷। আর নিজের পকেট থেকে রুমাল  বের করে অশ্রু মোছাতে মোছাতে আরও কী কী বলছিলেন সেগুলো আমার শ্রুতিগোচর হয়নি,কারণ সেই মূহূর্তে আমি ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না৷

যাক্‌ মনে মনে একটা সংকল্প নিয়ে াার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন৷ কিন্তু আজও জানিনা াার সেই হৃদয়বিদারক মর্মবাণী কিভাবে সমাজে কার্যকর করবো৷ কিভাবেই বা মানুষের অশ্রু মুছিয়ে একটু হাসির ঝলক আনবো৷ শুধু তাঁর নির্দেশকে কার্যকর করতে উদ্‌ভ্রান্তের মত ছুটে চলেছি তাঁরই নির্বাচিত ও নির্দেশিত জায়গাগুলোতে, যদি কোথাও কিছু একটা তিনি কৃপা করে করিয়ে নেন৷ যার মাধ্যমে একদিকে যেমন সমাজের    দুঃস্থ অসহায় মানুষ জীবনে নোতুন করে বাঁচার একটা স্বপ্ণ দেখবে, জীবনের একটা নোতুন স্বাদ খুঁজে পাবে, উপলব্ধি করবে যে তাঁরা অসহায় নয়! তাদের কথাও আন্তরিকভাবে  ভাবার মানুষ আছে৷ াার  নির্দেশিত পথে  এই বার্তাটি  সমাজের অবহেলিত  মানুষদের  কাছে পৌঁছে দিতেই এই ডামরুঘুটু গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন সমাজের বঞ্চিত, পদদলিত মানুষের মুখে  হাসি  ফুটে উঠবে, অন্যদিকে প্রাউটের সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব ই যে  বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল মানবসমাজের  একমাত্র সমাধান  সবার কাছে তার একটি  সুস্পষ্ট বার্তা যাবে৷ সমস্যার গহ্বরে নিমজ্জিত দিশাহীন মানবসমাজ এক অব্যর্থ, সদর্থক দিশা খুঁজে  পাবে৷ হাজার সমস্যার নাগপাশ থেকে মুক্তির পথ  পাবে ধরিত্রী৷ হাফ ছেড়ে বাঁচবে ধরাবাসী৷

অতএব আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জীবনটা অন্য দশ পাঁচ বা হাজারটি মানুষের মতো উদরপূর্ত্তির জীবন নয় আর নিছক ভোগবিলাসের জীবনও নয়৷ আমাদের জীবন বহু জীবনের তপস্যার ফলশ্রুতি, বিধাতার আশীর্বাদপুষ্ট, এই অমূল্য জীবনকে উৎসর্গিত করে  রাখতে হবে তাঁরই চরণতলে ---কর্মের দ্বারা, সেবার  দ্বারা, ত্যাগের ও সাধনার দ্বারা৷

ভোগবিলাস, রুটিনমাফিক বাৎসরিক ভ্রমণ, নিছক আনন্দস্ফূর্তি, ধনসঞ্চয়, জ্ঞান গরিমার অহংকার আধ্যাত্মিক জীবনের  জন্যে নয়, এসব মানব মনের ক্রমোন্নতির পথে ভয়ঙ্কর বাধাস্বরূপ, ধর্মানুশীলনের  পরিপন্থী৷

আদর্শ জীবন ত্যাগ  তিতিক্ষার জীবন৷ আমাদের জীবন এক মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে৷

আমাদের জীবন যাদের কথা কেউ ভাবেন না তাদের জন্যে৷

আমাদের জীবন শিবজ্ঞানে জীবের সেবার জন্যে৷

আমাদের জীবন গুরু প্রদত্ত কর্তব্য সম্পাদন করে  মানবজীবনকে সার্থক করে তোলার জন্যে৷

আসুন, সংঘবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিপীড়িত মানবতার  মুক্তির জন্যে সদর্থক কিছু করি, দৃষ্টান্তমূলক কিছু গড়ি, আদর্শ গ্রামের রচনা করে তাঁর পা রাখার জায়গা করি৷

এসো ভাই এসো বন্ধু মানবতার এ সিন্ধু

তুমিও এনো কয়েক বিন্দু

প্রীতির উপহার পরিমল  (প্রঃ সঃ)