আজকের জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান কোন পথে?

লেখক
অরুণাভ সেনগুপ্ত

‘‘বল বল বল সবে শত বীণা বেণু রবে

ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে৷

ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে,

নব দিনমণি উদিবে আবার

পুরাতন এ পূরবে৷’’

ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশের পদানত ছিল, যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্যে দেখা দেয় দেশজুড়ে উত্তাল আন্দোলন৷ সেই সময়কার স্বাধীনতাকামী বীর বিপ্লবীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিধবনিত হয়েছিল এই কবিতাটিতে৷ তাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করলুম৷ কিন্তু তাঁদের আশা আকঙ্ক্ষা আজও পূর্ণ হয়েছে কি? দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়--- আদৌ হয়নি৷ কেন হল না? আজ তা বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে!

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নানান্ প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছে সমর্থন চাইছেন৷ জনগণের সমর্থন লাভ করে বিভিন্ন সময়ে শাসক বদলাচ্ছে, কিন্তু সমাজের দরিদ্র জনগণ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকছে৷ একদিকে অজস্র দরিদ্র মানুষের আর্ত-চিৎকার, আর তার পাশাপাশি দেশের এক শ্রেণীর ধনকুবেরদের বিলাস-ভৈভব৷ আধুনিক সভ্যতার এ এক কলঙ্ক৷

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল--- কেউ ধনতন্ত্রের পথে মুক্ত অর্থনীতি, বিশ্বায়নের শ্লোগান দিচ্ছে৷ কেউবা মার্কসবাদের বুলি কপচিয়ে চলেছে৷ বেশীরভাগ মার্কসবাদী এখন তাদের মার্কসবাদ মার্র্ক বোতলে ধনতন্ত্রের রঙীন পানীয় সরবরাহেই বেশী আগ্রহী৷ কিন্তু কোনোকিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না৷

আসলে কেন এই ব্যর্থতা? তার কারণ, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরোনো ডগ্মা ছঁুড়ে ফেলে নোতুন যুগোপযোগী আদর্শকে যে মুক্তমনে গ্রহণ করবে---সে মানসিকতার অভাব৷

এটা সত্য কথা যে, আজকের এই জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ এই সমস্যা-সমাধানের পথও খঁুজে পাচ্ছে না৷ মানুষ আজ দিশাহারা৷

এই পরিস্থিতিতে আজকের সমাজের সমস্ত সমস্যার যুগোপযোগী সমাধানের সুচিন্তিত বাস্তব সম্মত পথ দেখিয়েছেন মহান্ সমাজগুরু পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার, যিনি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীরূপে বিশ্বে সমধিক পরিচিত৷ যিনি একাধারে নোতুন সর্র্বনুসূ্যত আধ্যাত্মিক দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনামার্গ--- আনন্দমার্গের প্রবক্তা, নোতুন সমাজদর্শনের জনক, যিনি দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদ দর্শন ও এই নব্যমানবতাবাদের ভিত্তিতে নোতুন শিক্ষাব্যবস্থা, দিয়েছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান জগতের যুগান্তকারী মাইক্রোবাইটাম তত্ত্ব৷ সঙ্গীতকার হিসেবে তিনি পাঁচ সহস্রাধিক প্রভাত-সঙ্গীতের স্রষ্টা ও সুরকার, ভাষাতত্ত্ববিদ্ ওবিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক সংঘটনের প্রতিষ্ঠাতাও৷

সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি যে নোতুন দর্শন তথা আদর্শ দিয়েছেন তার নাম ‘প্রাউট’(প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব)৷ এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, প্রাউটের মৌলিক অর্থনৈতিক নীতিতে প্রথমেই সমাজের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার গ্যারান্টী দেওয়া হচ্ছে৷ এরপর বলা হয়েছে শ্রম, নিষ্ঠা ও যোগ্যতা আন্তরিকতার মর্যাদা দিতে গুণানুপাতে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার (ইন্সেনটিভ) ব্যবস্থা করতে হবে৷ আর তারপরের কথা হ’ল, সমাজের বিভিন্ন মানুষের নিম্নতম আয় তথা নিম্নতম মানের ক্রমবৃদ্ধি ঘটাতে হবে৷ উচ্চতম ও নিম্নতম আয়ের মধ্যে পার্থক্য বেশী হওয়া উচিত নয়৷

প্রাউটের মতে, অর্থনৈতিক সমবন্টন একটা অবাস্তব তত্ত্ব, যুক্তিপূর্ণ বন্টনই Rational distribution) কাম্য৷ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায়, সমবন্টন করা হল, তাহলেও অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দেবে৷

একটা কারখানায় যদি সাধারণ অদক্ষ্য শ্রমিক, নিষ্ঠাবান কর্মী, কারখানার ম্যানেজার সবাইকে একই বেতন দেওয়া হয়, তাহলে কারখানায় কেউ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে না৷ তখন উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেবে৷

এখন প্রশ্ণ উঠতে পারে, প্রাউটে সকলের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি দেওয়া হবে কি করে?

এর উত্তরে প্রাউট বলছে, এটা সম্ভব হবে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে৷ বর্তমানে যে রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ে এত মাতামাতি করা হচ্ছে, একটু তলিয়ে বিশ্লেয়ণ করলে বোঝা যাবে, এটা কতটা অন্তঃসারশূন্য৷ গণতন্ত্র মানে, জনগণের শাসনব্যবস্থা৷ কিন্তু বর্তমানে শাসনব্যবস্থায় যার প্রচুর অর্থ আছে বা ক্ষমতা (প্রশাসনিক বা দৈহিক বা অস্ত্রশক্তি) সেই যত সুবিধাভোগ করছে৷ সহায় সম্বলহীন মানুষ বঞ্চিত, শোষিত অত্যাচারিত৷ তাই প্রতিটি মানুষের হাতে শুধু ‘ব্যালেট’ ধরিয়ে দেওয়া নয়, প্রতিটি মানুষের হাতে ‘ক্রয় ক্ষমতা’ দিতে হবে৷ তাই প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে৷ আর যার সবচেয়ে কম আয়, সেও যেন তার নিজের আয়ে, তার নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্য ক্রয় করতে পারে বাজারে ওই সমস্ত ভোগ্যপণ্যের সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে ও সে সবের মূল্য নিয়ন্ত্রিত থাকবে৷ আর যারা কর্মক্ষম নয়, সমাজ থেকে তাদের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে৷

বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক একমাত্র বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বর৷ সবাই সেই এক পরমপিতার সন্তান৷ তাই বিশ্বের সমস্ত সম্পত্তি সবাইকার পৈত্রিক সম্পত্তি৷ সবার এতে যৌথ অধিকার৷ তাই কেউ অভাবে শুকিয়ে মরবে, তা চলতে দেওয়া হবে না৷

প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে৷ তাই ‘কেন্দ্রিত পরিকল্পনা’ centralised economy) নয়,‘বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা’decentralised economy) চাই৷ তার সঙ্গে সঙ্গে ‘সুসন্তুলিত অর্থনীতির balanced economy) রূপায়ন৷ ‘সুসন্তুলিত অর্থনীতির মানে হচ্ছে, দেশের ৩০ থেকে ৪০শতাংশ মানুষকে কৃষিতে নিযুক্ত রাখতে হবে৷ আজ দেশের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিতে নিয়োজিত৷ এ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ৷ আর দেশের ২০শতাংশ মানুষকে কৃষিভিত্তিক শিল্পে agro industry) (অর্থাৎ কৃষিতে উৎপাদিত ফসলের ভিত্তিতে শিল্প,যেমন, নদীয়ায় কলা চাষ ভাল হয়, এ থেকে কলা চিপস্ বানানো, ধানের তুষ থেকে ভোজ্য তেল তৈরী, তেল কল, পাট সুতাকল, কাগজ তৈরী শিল্প প্রভৃতি) নিয়োগ করতে হবে৷ ২০ শতাংশ মানুষকে কৃষি-নির্ভর শিল্পে agrico industry) নিয়োগ করতে হবে৷ কৃষিনির্ভর শিল্প বলতে বোঝায়, কৃষির প্রয়োজনে যে শিল্প গড়ে ওঠে,যেমন, কৃষির যন্ত্রপাতি, সার (জৈব সারই ভাল), কীটনাশক (জৈব কীটনাশকের ওপর জোর দিতে হবে) প্রভৃতি তৈরীর শিল্প৷ এরপর ১০ শতাংশ মানুষকে ব্যবসায় নিয়োজিত থাকবে৷

আর দেশের বিশেষ করে অনুর্বর বা কম উর্বর জমিতে অকৃষি শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷ অকৃষি শিল্প বলতে বোঝায় যে সব শিল্প কৃষির ওপর নির্ভরশীল বা যুক্ত নয়৷ যেমন, লৌহ-ইস্পাত শিল্প কৃষির ওপর নির্ভরশীল বা যুক্ত নয়৷ যেমন, লৌহ-ইস্পাত শিল্প, গাড়ী তৈরীর কারখানা প্রভৃতি৷ এই অকৃষি শিল্পে দেশের শতকরা ২০থেকে ৩০ শতাংশ মানুষকে নিযুক্ত করা বাঞ্ছনীয়৷ আর যেমন যেমন অকৃষি শিল্পের বিকাশ ঘটানো হবে, তেমন তেমন ভাবে, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প তথা কৃষিনির্ভর শিল্পে নিযুক্ত মানুষের শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে৷ তবে অকৃষি শিল্পে ৩০ শতাংশের বেশী মানুষের নিয়োগ বাঞ্ছনীয় নয়, আবার ২০ শতাংশের কমও বাঞ্ছনীয় নয়৷ ২০শতাংশের কম হলে মানুষের অর্থনৈতিক মান অনুন্নত হবে৷ ৩০শতাংশের ঊধের্ব হলে উৎপাদিত পণ্যের বাজার পাওয়া অসুবিধা জনক হবে৷ তখন বিদেশে বাজার খঁুজতে হবে৷ এই বিদেশে বাজার খোঁজার প্রতিযোগিতা বিশ্বশান্তির পথে কাঁটা৷

প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আর একটা গোড়ার কথা হ’ল, সামাজিক অর্থনৈতিক সুবিবেচনার মাধ্যমে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ (স্বনির্ভর) অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা৷ এইসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের এলাকাকে ক্রমে ক্রমে বর্দ্ধিত করতে হবে৷ এমনিভাবে স্বনির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিস্তার ঘটাতে ঘটাতে একসময় আসবে যখন সারা পৃথিবী একটাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে৷

অবাধ ব্যষ্টিগত উদ্যোগ,না রাষ্ট্রীয় মালিকানা---প্রাউট কোনটা সমর্থন করে? এর উত্তরে এক কথায় বলতে গেলে, প্রাউট চায়---কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য যতদূর সম্ভব সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা উচিত৷ আর, এই সমবায়কে মজবুত করার সার্বিক প্রয়াস চালাতে হবে৷ এজন্যে ৩টে জিনিস খুব জরুরী ঃ (১) সামবায়িক মানসিকতা, (২) দেশের মানুষের উন্নত নৈতিকমান, (৩) সমবায়  উদ্যোগের ওপর নীতিবাদী মানুষের কঠোর তত্ত্বাবধান৷ আর এই কারণে একটা সার্বভৌম আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রয়োজন খুব বেশী৷

সর্বশেষে বলব, প্রাউটের এই যুগান্তকারী আদর্শকে কার্যে পরিণত করার জন্যে চাই নীতিবাদী, ধার্মিক, সেবাব্রতী ও সংগ্রামী মানুষ৷ নব্যমানবতাবাদ তথা বিশ্বৈকতাবাদ হবে তাদের ভিত্তি৷ প্রাউট তাদের নাম দিয়েছে ‘সদবিপ্র’৷

নীতিবাদী সদবিপ্র পরিচালিত এই ধরণের অর্থনৈতিক গণতন্ত্র্ আজকে সমাজের জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ৷