আজকের সমস্যা সমাধানে প্রাউট

লেখক
মোহন সরকার

বিশ্ববিখ্যাত সংবাদ সংস্থা ‘অক্সফ্যামে’র সমীক্ষায় প্রকাশ, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৮ জনের কাছে যে সম্পদ আছে, তা গোটা পৃথিবীর অর্দ্ধেক অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি মানুষের সম্পত্তির সমান৷ ভারতেও বিত্তবান্ ১ শতাংশ মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে তা আছে ভারতের মোট  জনসংখ্যার  ৫৮ শতাংশ  মানুষের  কাছে৷

দেখা যাচ্ছে, মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর মানুষের হাতে যে বিপুল পরিমাণ বিত্ত সঞ্চিত রয়েছে, তার আদৌ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না, বরং চলছে  চরম অপব্যবহার৷ তারা  চরম বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত করছে৷ উদাহরণ স্বরূপ,একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে প্রকাশ, ভারতের জনৈক পুঁজিপতি মুকেশ আম্বানির মুম্বাইয়ে একটি বিশাল বাড়ী রয়েছে৷ বাড়ীর বাসিন্দা মাত্র ৪ জন৷ আর এ চার জনের জন্যে যে বাড়ীটি নির্মিত হয়েছে তা ২৭ তলা বিশিষ্ট৷ নীচের ৬ তলাতে কেবল গাড়ী রাখার জায়গা৷ সেখানে ১৬০টি গাড়ী থাকত পারে৷ বাড়ীর ছাদে ৩টি হেলিপ্যাড অর্থাৎ হেলিকপ্ঢার নামার জায়গা৷

অন্যদিকে ওই মুম্বাইতে হাজার  হাজার মানুষ গৃহহীন, ফুটপাথে ব্রিজের তলায় তারা জীবন কাটাচ্ছে৷ ঝুপড়িতে চরম কষ্টের সঙ্গে  দিন কাটাতে হচ্ছে  লক্ষ লক্ষ মানুষকে৷

এই সমস্ত পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের শিল্প বাণিজ্যক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শ্রেণীর  কঠোর শ্রমদানে  অর্জিত সম্পদের অতিক্ষুদ্র  ভগ্ণাংশ তাদের  দিচ্ছে, বাকিটা সুচতুরভাবে মুনাফার নাম করে লুন্ঠন করে চলেছে৷ যাদের পরিশ্রমের ফলে এদের সম্পদের পাহাড় রচিত হচ্ছে, ওই সমস্ত হতভাগ্য মানুষের অধিকাংশেরই ক্ষুধার প্রয়োজনীয় অন্ন জুটছে না, চিকিৎসার পয়সা  মিলছে না, মোটকথা  তাদের জীবনের  নূ্যনতম প্রয়োজনের  পূর্ত্তি ঘটছে না৷ অথচ তাদের শোষণ করা অর্থেই এদের যত বিলাসিতা, এদের অত  রমরমা৷

তাছাড়া পুঁজিপতিরা তাদের অতিসঞ্চিত অর্থশক্তির অপব্যবহার  করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে ও দূষিত করছে৷ নির্বাচনের সময় অর্থশক্তির ম্যাজিক দেখিয়ে তারা যোগ্য নীতিবান সেবাব্রতী জনপ্রতিনিধিদের পরাজিত করে অযোগ্য দুর্নীতিপরায়ণ শঠ মানুষদের  জনপ্রতিনিধি হিসেবে   জিতিয়ে  আনে৷ এইভাবে  সরকারকে এরা  কুক্ষিগত  করে ও বাস্তবে তাদের  সেবাদাসে  পরিণত করে৷ সাংস্কৃতিক জগৎকেও পুঁজিপতিরা তাঁদের অর্থশক্তির  সাহায্যে কুক্ষিগত করে৷  যে সমস্ত গল্প, নাটক প্রকৃতপক্ষে অসংস্কৃতির  বাহক, কুরুচিসম্পন্ন ও নিম্নমানের সেগুলির  পেছনে  পুঁজিপতিরা টাকা ঢালে, উদ্দেশ্যে অধিক থেকে  অধিক মুনাফা অর্জন৷ এইভাবে  সাংসৃকতিক  জগৎকেও  তারা কলুষিত  করে৷ ধর্মমতের  ক্ষেত্রে  অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার  তথা বিভিন্ন ডগমাকেও  এরা নানান্ভাবে তাদের অর্থশক্তির  সহায়তায় সমাজে ব্যাপকভাবে  জনপ্রিয়  করে তোলার চেষ্টা  করে৷ কারণ, যতই মানুষের নৈতিক অবনমন হয়, ততই পুঁজিপতিদের  নানান্ দিক থেকে সুবিধা৷ তাদের শোষণের সাম্রাজ্য বিস্তারের  পক্ষে এগুলি অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে৷ 

আজ সমগ্র মানব সমাজের বাস্তব ছবি এইটাই৷ চারিদিকে বঞ্চনা ও শোষণ৷ একদিকে কোটি কোটি মানুষ বাঁচার লড়াই করতে করতে তাদের সমস্ত প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে ফেলছে, মানসাধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে জীবনের  পরিপূর্ণতা অর্জনের চিন্তা-ভাবনা তাদের পক্ষে -অসম্ভব৷

অন্যদিকে শোষকশ্রেণীও উচ্ছৃঙ্খল দুর্নীতিপরায়ণ জীবনযাপন করে, তারাও তাদের জীবনকে সার্থক  করার সম্ভাবনাটুকু  হারিয়ে ফেলেছে,  মানসাধ্যাত্মিক উৎকর্ষের -ছিটেফোঁটা তারাও পাচ্ছে না৷  এইভাবে প্রায় গোটা মানব সমাজই দিশাহারা৷

মানব সমাজের  এক যুগসন্ধিক্ষণ৷ সমগ্র  মানবসমাজে  নেমে এসেছে এক সর্বাত্মক অবক্ষয়, সমাজের  সর্বস্তরেই দেখা দেয় বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা,নৈতিক  স্খলন, অন্যায় অত্যাচারে, ব্যভিচার  ও শোষণের  রাজত্ব৷ সমাজে দেখা দেয় ব্যাপক আদর্শগত শূণ্যতা---যেন অমারাত্রির অন্ধকার৷

কিন্তু ইতিহাসের  ধারাপ্রবাহে দেখেছি, এই শূন্যতা বেশিদিন থাকে না৷ তাই এই ব্যাপক সর্বস্তরীয় আদর্শগত শূন্যতা দূর করতে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই আজ এসেছে এক নোতুন যুগান্তকারী সর্বানুসূ্যত আদর্শ--- যা সমাজের  সর্বক্ষেত্রে ঘনায়মান  অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে  প্রভাতের অরুণ আলোর  বার্র্ত বহন করে আনছে৷ এই যুগান্তকারী আদর্শের  নাম ‘প্রাউট’৷ যাঁর প্রবক্তা মহান্ দার্শনিক  ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷  যিনি ধর্মজগতে  আনন্দমার্গের  প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি নামে পরিচিত৷ তিনি সমাজের সর্বক্ষেত্রে সর্বব্যাপী অন্ধকারের অবসানকল্পে  এনেছেন তার  সর্বানুসূ্যত দর্শন বা আদর্শ যাতে সমাজের  সর্বক্ষেত্রের সমস্ত সমস্যা সমাধানের পথ রয়েছে৷ তিনি দিয়েছেন আজকের দিশাহীন মানুষকে এক যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত নোতুন আধ্যাত্মিক দর্শন, সমস্ত  অন্ধবিশ্বাস  ও কুসংস্কার বর্জিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন তথা অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা, শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থা, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি আজকের  অসংস্কৃতির  অন্ধকারের অবসানকল্পে রচনা করেছেন পাঁচ সহস্রাধিক প্রভাত সঙ্গীত ও নিজেই তাতে সুরারোপণ করেছেন৷ এমনিভাবে শিল্প সাহিত্য ভাষাতত্ত্ব, মাইক্রোবাইটাম  প্রভৃতি বিভিন্ন  ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর  বিস্ময়কর  অবদান  রেখে  গেছেন৷

সে সমস্ত  আপাততঃ এখানে আলোচ্য বিষয় নয়৷

তিনি সামাজিক-অর্থনৈতিক  ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী আদর্শ দিয়েছেন, যা আজকের  আলোচ্য বিষয়, যা একটু আগে বললুম, তার নাম ‘প্রাউট’৷

‘প্রাউট’ শব্দটি  Progressive Utilisation Theory)-র সংক্ষিপ্ত  রূপ  (prout), যার বাংলা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷

এখানে এই নামকরণ সম্পর্কে দু-চার কথা বলাটা  প্রয়োজন৷

মানুষের অজস্র প্রকারের অভাব৷ এই অভাবের জন্যেই যত দুঃখ-ক্লেশ৷ এই অভাব  মিটবে কী করে?

ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন৷ প্রকৃতি মানুষের  অজস্র অভাব  পূরণের  জন্যে  নানান্ সম্পদ সাজিয়ে  রেখেছেন৷ যেমন ক্ষুধার  সঙ্গে সঙ্গে অন্ন ও সৃষ্টি করে দিয়েছেন৷

এক্ষেত্রে  সংক্ষেপে  একটা  ছোট্ট গল্প বলি৷ উপদেশমূলক গল্প, প্রায়  সবারই জানা৷ এক বৃদ্ধ  পিতা মৃত্যুর  সময় তার চার  ছেলেকে ডেকে বলল, এই যে সামনে  বড়  উঠান রয়েছে, এই উঠানে তোদের জন্যে আমি অনেক সোনাদানা পুঁতে রেখেছি৷ এইবলে  বৃদ্ধের মৃত্যু হ’ল৷ পিতার মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য-সম্পন্ন করে ৪ ছেলে রাতারাতি মাঠখানা খুঁড়ে ফেলল--- সোনা-দানা পাওয়ার  জন্যে৷  সারা মাঠটা গভীরভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করেও  কোনো সোনা-দানা  পেল না৷ তখন  তারা  ওইখানে বসে কান্না  শুরু করে দিল৷  তখন  এক জ্ঞানী বৃদ্ধ  মানুষ এসে তাদের  জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কাঁদছে কেন? তারা উত্তর দিল, বাবা বলেছিলেন, এই মাঠে তিনি আমাদের জন্যে সোনা-দানা পুঁতে রেখেছেন৷ আমরা তাই  পুরো মাঠটা খুঁড়লাম, কিন্তু কোন  সোনার-দানার হদিশ পেলাম না৷

জ্ঞানী বৃদ্ধ তখন বললেন, ঠিক আছে, কেঁদে লাভ নেই৷ এই পতিত মাঠটা তো খুঁড়ে ফেলেছো, এবার  এটাতে চাষ করে ফেল৷ তারা সেই মত ওই মাঠটাতে  চাষ করল৷  তাতে প্রচুর ফসল  ফলল৷ তখন  ওই জ্ঞানী-বৃদ্ধ মানুষটি তাদের বললেন, দেখ, তোদের  বাবা এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন৷ চাষ করে এই যে সোনার ফসল ফলেছে এটাই তো সোনা-দানা৷ ছেলেদের চোখ খুলে গেল৷

একেই বলেই উপযোগ৷ প্রকৃতি  মাটি, জল, বাতাস, এই মাটির আবার  ওপরের স্তরের মাটি ও নিম্নস্তরে  ভূগর্ভস্থ খনি প্রভৃতি এমনি নানানভাবে নানান্ সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ এসবের যথাযথ উপযোগ নিতে পারলে, মানুষের  সমস্ত অভাবেরই নিরসন হবে৷

বর্তমানে মানুষ প্রকৃতি ও সমস্ত স্থূল, সূক্ষ্ম সম্পদের ঠিকভাবে   বিধিবদ্ধভাবে উপযোগ নিতে  পারছে না বলেই যত সমস্যা৷

উপযোগ মানে হল প্রকৃতি দত্ত সম্পদের প্রয়োজনমত  রূপগত পরিবর্তন, স্থানগত পরিবর্তন  কালগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ব্যবহারোপযোগী করে তোলে ও অভাব মেটানো৷

সমাজব্যবস্থার ত্রুটির জন্যে ‘অধিকারগত সমস্যা বা মালিকানাগত সমস্যা এক্ষেত্রে জনসাধারণের উপযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷

ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ ক্ষমতার জোরে বিপুল পরিমাণ প্রকৃতি দত্ত সম্পদের ওপর নিজ অধিকারস্বত্ব বা মালিকানা স্বত্ব দাবী করে,  ও সমাজের অধিকাংশ জনসাধারণকে  বঞ্চিত করে৷

এক্ষেত্রে  ‘প্রাউট’ বলছে, এই বিশ্বের সমস্ত কিছুর স্রষ্টা, পরম ব্রহ্ম  তথা ঈশ্বর৷ বাঙলার দায়ভাগ প্রথাতে রয়েছে, পিতা বর্তমানে তার ছেলে-মেয়েরা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ করতে  পারে, কিন্তু  ইচ্ছামত গায়ের জোরে  কোনো সম্পত্তি দখল করে অন্য ভাইবোনকে বঞ্চিত করতে পারে না৷

ঠিক তেমনি ঈশ্বরের সন্তান  হিসেবে বিশ্বের সমস্ত  সম্পদে সমস্ত  মানুষের যৌথ  অধিকার রয়েছে৷

‘আজকের সমস্যা’ গ্রন্থে  প্রাউট-প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  সুস্পষ্টভাবে বলেছেন--

“জীবজগৎ একটি বৃহৎ যৌথ পরিবার–একথা ক্ষণেকের জন্যেও ভুললে চলবে না৷ প্রকৃতি বিশ্বের কোনো সম্পত্তিই ব্যষ্টিবিশেষের নামে লেখাপড়া করে দেননি৷ ব্যষ্টিগত মালিকানার সৃষ্টি করেছে স্বার্থপর সুবিধাবাদী মানুষেরা, কারণ এই ব্যবস্থার রন্ধ্রপথে তারা অন্যকে শোষণ করে’ নিজেদের স্ফীতোদর করবার সুযোগ পায়৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জীবমাত্রেরই যখন পৈত্রিক সম্পত্তি তখন কারও ঘরে প্রাচুর্যের স্রোত বয়ে যাক আর কেউ অনাহারে তিলে তিলে শুকিয়ে মরুক এই ব্যবস্থাটাকে ন্যায় ধর্মসম্মত বলা যেতে পারে কি? যৌথ পরিবারের নিজের ক্ষুধা বা প্রয়োজন মত অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–চি বা আরামের ব্যবস্থা সমগ্র পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী প্রত্যেকেই পায়৷ কিন্তু এই পরিবারের কোনো সদস্য যদি নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্ন–বস্ত্র, পুস্তক বা ঔষধ নিজের জিম্মায় আটকে রাখে তখন সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্লোশের কারণ হয় না কি? সেক্ষেত্রে তার আচরণ নিশ্চয়ই ধর্মবিরোধী, নিশ্চয়ই সমাজ বিরোধী৷

বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদিরা ঠিক এই ধরণেরই ধর্মবিরোধী বা সমাজবিরোধী জীব৷ নিজের ঘরে প্রাচুর্যের মাত্রাধিক্য ঘটাতে গিয়ে এরা অন্যকে ক্ষুধার জ্বালায় শুকিয়ে মারে, নিজের পোষাকের জৌলুষ দেখাতে গিয়ে অন্যকে ছিন্ন কন্থা ব্যবহার করতে বাধ্য করে, নিজের প্রাণশক্তিকে বাড়াতে গিয়ে অন্যের প্রাণরস শোষণ করে৷ট

পরিবারের যে সদস্য অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে একাত্মভাব রাখে না, যৌথ অধিকারের মহৎ আদর্শ তথা যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যটুকুকে স্বীকার করতে চায় না তাকে সামাজিক জীব বলে স্বীকার করা চলে না৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিক আদর্শ অনুযায়ী ব্যষ্টিগত মালিকানা ব্যবস্থাকে চরম ও পরম বলে’ স্বীকার করা চলে না, আর তাই পুঁজিবাদকেও সমর্থন করা যায় না৷”   (ক্রমশঃ)