অখণ্ড ভারতবর্ষের যে কোন মানুষই এই ভারতেরই নাগরিক

লেখক
প্রভাত খাঁ

বর্তমান ভারত যুক্তরাষ্ট্র এক মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে৷ মনে পড়ে সেই অতীতের কথা যেদিন বিদেশী আক্রমণকারী আলেকজাণ্ডার এই দেশের পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধু নদের তীরে এলেন৷ তখন তিনি সিন্ধুকে হিন্দু বলে সম্বোধন করেন৷ কালক্রমে সেই সিন্ধুই নাকি হয়ে গেছে হিন্দু৷ এমনকি এদেশটাও হয়েছে হিন্দুদেশ হিন্দুস্তানী৷ কিন্তু এদেশের মানুষজন বহু ভাষাভাষীর, কেউই এক জনগোষ্ঠীর লোক অন্য জনগোষ্ঠীর লোকের ভাষা বোঝে না৷ কিন্তু এই ত্রিভূজাকৃতি বিরাট এলাকার অর্থাৎ বিশাল ভারতবর্ষের মানুষজন সেই সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল৷ আর একমাত্র মিলনের ভাষা ছিল সংসৃকত ভাষা৷ তাই আসমুদ্র ঐক্যের ভাষা ছিল সংসৃকত৷ আজ সেই ভাষাটাই অস্বীকৃত ও অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে৷ একে যদি রোমান হরপে প্রকাশ করা হ’ত ও ব্যাপকভাবে সারা দেশে চালান হতো বিশেষ করে ইংরেজ আমল থেকে তাহলে এই ভাষা শক্তপোক্ত হতো এবং সারা ভারতে সংুহতির সহায়ক হতো৷ কিন্তু স্বাধীন ভারতের কোনও সরকারই সে পথে চলেনি৷ তাই আজ ভাষা নিয়ে এত বিরোধ৷ হিন্দীকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সেই বিরোধ আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ দেখা গেছে সারা ভারতের জনগণও হিন্দীকে চায় না কারণ ভাষা হিসাবে হিন্দীর চেয়ে উন্নত ভাষা ভারতে অনেকগুলি আছে, হিন্দী হ’ল হিন্দী বলয়ের কৃত্রিম ভাষা৷ উর্দুর মধ্যে আরবী, ফারসী যে শব্দ আছে সেগুলিকে সরিয়ে সংসৃকত জাত কিছু শব্দের---যেগুলি উত্তর ভারতে আঞ্চলিক উচ্চারণে চলে সেগুলি প্রবেশ করিয়ে একটা কথ্য ভাষা চালু করে সেটাই হ’ল হিন্দী ভাষা৷ বর্তমানে যারা সরকারে এসেছে তারা ইতিহাসকে অস্বীকার করে বিদেশী (?) খেদানোর  উন্মত্ততায় ব্যস্ত৷ এরা ভুলে গেছে মুসলমান রাজ্য এদেশে চলেছে৷ কয়েক শত বৎসর তারা এসে এদেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে৷ এদেশের মহিলাদের বিবাহ করে ও রাজত্ব দীর্ঘ বছর চালানোর ফলে রাজার ভাষা প্রজার ভাষা হিসাবে অনেক হিন্দু (সনাতন ধর্মী) কারণ হিন্দু ধর্মী বলে মূলতঃ কোন ধর্ম নেই, তবে হিন্দু যে ধর্মমত মেনে চলে তারাই হিন্দু ধর্মমতাবলম্বী বলে প্রচলিত আছে৷  আর মুসলমান ধর্মমত যারা মানে তারা তেমনই মুসলমান ধর্মী বলে পরিচিত৷ তাই ভারতীয় বলতে যারা এদেশে  বাস করে তারা যে ধর্মমতেরই হোক না কেন৷ দেখা যাবে পাঁচ/ছয় পুরুষ আগে অনেকে হিন্দুই ছিল৷ আজ ভারত হ’ল বিচ্ছিন্ন  একটা দেশ৷ কারণ ভারতবর্ষ আজ আরও দু’টুকরো হয়েছে৷ পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান৷ পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান  লড়াই করে হয়েছে বাঙলাদেশ৷ দেশ টুকরো করেছে কিছু স্বার্থান্বেষী৷ আজ তারই কুফল আমরা ভোগ করছি৷ মূলত ভারতবর্ষ ছিল হিন্দু ও মুসলমানের দেশ৷ আজ শাসক দল সেই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বিদেশী বিতাড়নের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ এটা অত্যন্ত অমানবিক৷ এটা বর্তমানে জনগণের মধ্যে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে৷ বর্তমান যুগে মানুষের পচিয় মানুষ, মানবিক ধর্মই হ’ল মানুষের একমাত্র ধর্ম৷

সেই মানবিক ধর্ম ভুলে বিদেশী বিতাড়নে কেন্দ্র সরকার মত্ত হয়েছে৷ তাই নানা বিল পাশ করায় মত্ত হয়েছে৷ সংখ্যাগড়িষ্ঠার শক্তিতে লোকসভায়৷ এটা অবশ্যই গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক৷ অসমে ১৯ লক্ষ্যে মধ্যে ১২ লক্ষ বাঙালী আর ৭ লক্ষ অন্যান্য৷ তাদের জন্যে অসম সরকার নতুন জেল তৈরী করে আটকে রাখার ব্যবস্থা করছে৷ এটা কোন ধরণের গণতন্ত্র?

আমরা যারা প্রবীণ, যারা এই ইংরেজ আমলে জন্মেছি তারা জানে এদেশ কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগ হয়৷ আর সেই সাম্প্রদায়িকতা লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে পাকিস্তান থেকে বিতাড়ন করে ও এক বস্ত্রে উদ্বাস্তু করে ছেড়েছে৷ যাদের আজও নিরাপত্তা নেই এই ভারতে৷ তারাই নাকি বিদেশী৷ এ কেমন কথা? আর যারা হাজারে হাজারে প্রাণ হারিয়েছেন তারা তো এই স্বাধীনতার (?) জন্যেই হিংসার বলি৷ সেকথা এদেশের শাসক কি ভুলে গেছেন? ‘নেহেরু তো তাদের এদেশে আশ্রয় দেবারই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন’৷ এত বছর পরে তাদের কোথায় স্থান হবে? পশ্চিমবাঙলা থেকে নাকি ২ কোটী বিদেশী বিতাড়ন করবে কেন্দ্র সরকার৷ এ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুমকী দিয়ে যাচ্ছেন৷

অত্যন্ত দুঃখের কথা আজ ভারতে ১৫টি পরিবার ১০ শতাংশ জিডিপির মালিক৷ ১৩৩ কোটি মানুষ তাদের যে কী দূরবস্থা সেটা যারা গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত তারাই জানেন৷ চরম বেকার সমস্যা৷ চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে৷ নিরাপত্তাহীনতায় লোকের আতঙ্ক! এ কেমন সরকার? পশ্চিম বাঙলা চিরকালই হিন্দু ও মুসলমানদের বাস৷ বহুকালই মুসলমান রাজারা রাজত্ব করেছেন৷ তাই হিন্দুরাই অনেকে স্বেচ্ছায় ও মধ্যযুগের রাজশক্তির দাপটে হিন্দুরা মুসলমান হয়েছে৷

সমাজ সংস্কারণ হিসাবে শ্রীচৈতন্যদেব জাত-পাত অস্বীকার করেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তন করেন৷ যেখানে হিন্দু ধর্মের কোন অনুষ্ঠান চলত না৷ অনেক মুসলমান চৈতন্যদেবের সেই সংস্কার হীন ধর্ম গ্রহণ করেন আর দলিত হিন্দু ও উুচ্চবর্ণের সংস্কার মুক্তরা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করেন৷ তিনি ভারতের জনগণকে মুসলমান আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেন৷

আজ মানুষ অনেক সচেতন৷ মিথ্যা জাত-পাত অন্ধের মত অনুসরণ করেন না৷ ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’৷ এই মহান বাণী আজ অনেকের ধ্যান-জ্ঞান৷ তাই আজকের মানুষ তাড়িয়ে সরকার তাদের পাঠাবে কোথায়? তাছাড়া এ সরকারকে কে অধিকার দিয়েছে মানবতাকে অস্বীকার করার! যারা প্রাচীন কালে এদেশে এসেছে সেই আর্যরা তো বিদেশের ছিল৷ তাহলে লোক কমাতে সরকারকে তো সারা  গো-বলয়ের অধিকাংশ মানুষকেই তাড়াতে হয়৷  কেন্দ্রীয় সরকার সেটা পারবে কী? আর বাঙালী তো অষ্ট্রিক দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষ৷ বাঙালী এই ভারতেরই মাটির মানুষ৷ তাই বাঙালী এই মাটিরই সন্তান৷ তাই কোন অধিকারে এই বাঙলার মানুষদের বিতাড়িত করার হুমকী  দেন কেন্দ্রের নতুন সরকারের প্রতিনিধিরা, পূর্বপুরুষের পরিচয়ে  যারা ভারতের প্রকৃত বিদেশী৷ প্রত্যেক মানুষ এই পৃথিবীর কোন না কোন দেশের নাগরিক হতে পারে৷ রাষ্ট্রহীন হয়ে কোনও জনগোষ্ঠী থাকতে পারে না৷ ভণ্ড দেশপ্রেমিকদের প্রতারণার শিকার হয়ে যারা  দেশভাগের শিকার হয়ে সর্বহারা হয়ে প্রাণের দায়ে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা কেন বিদেশী হবে?  সেই দেশের ভাগ হবার আগে আগে তারা তো সেই অখণ্ড ভারতবর্ষেরই সন্তান ছিল৷ আজ তাদের তাড়িয়ে পাঠানো হবে কোথায়? এটা তাদের জন্মগত অধিকার৷ অখণ্ড দেশের এক অংশে তারা অশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, তাদের বয়স হয়েছে এদেশেই বাস করে, এদেশের শিক্ষা নিয়ে, দেশের সেবা দিয়ে তারা তো এদেশের মানুষ৷ অনেকে ষাট-সত্তর বছর বা তারও বেশী সময় এদেশে আছে, আবার এদেশেই জন্মেছে৷ তাই তাদের বিতাড়ন করার অমানবিক কর্ম থেকে বিরত থাকাটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের উচিত কাজ হবে৷ তাদের জাত, ধর্ম যাই হোক৷ মনে রাখতে হবে সনাতন ধর্মের অধিকারী সবাই৷ ধর্মমত আর ধর্ম কিন্তু এক নয়৷ হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকে শাসকদের আজ অনেক ওপরে থাকতে হবে৷ নোংরা সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে দেশ শাসন বর্তমান যুগে দেশের পক্ষে  মারাত্মক ক্ষতি হবে৷

মনে রাখতে হবে ভারত কিন্তু পাকিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক দেশ নয়৷ ভারতের মাটিতে মানবিক মূল্যবোধ আজও বেঁচে আছে৷ তাই ভারত পৃথিবীতে আদৃত সবার৷ বিজেপি ও তার সরকার সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে দেশে ‘ংকরর্ণ দলীয় স্বার্থে, যার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে৷ নানা ভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষের পরিণতি সোভিয়েতের মত হতে পারে৷ তাই বিদেশী বিতাড়নের নামে ভয়ঙ্কর এই সাম্প্রদায়িক খেলা বন্ধ হোক---তবে দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণ হবে৷.