আলোর পাশে অন্ধকার

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মহালয়া থেকে শারদোৎসবের সূচনা হয়ে গেল৷ শারদোৎসব বাঙালী সমাজের সবচেয়ে বড় উৎসব৷ উৎসব কথাটির অর্থ হ’ল যার মাধ্যমে সবাই প্রাত্যহিক একঘেয়েমি কাটিয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে যেন নবজন্ম লাভ করে৷ শারদোৎসব সেদিক থেকে বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব অবশ্যই৷ সারা পৃথিবীর যেখানে বাঙালী থাকে সেখানেই শারদোৎসবের ব্যবস্থা৷ বাঙালীর শারদোৎসবের প্রধান মাধ্যম বর্তমানে দুর্গাপূজো৷ মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠ থেকেই উৎসবের সূচনা হয়ে যায়৷ দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বিশাল বিশাল কোটি কোটি টাকার বাজেটের প্যাণ্ডেল সবার চোখ ধঁধিয়ে দেয়৷ পূজোটাই অপ্রধান হয়ে যায়, প্রধান হয়ে যায় প্যাণ্ডেল আর অন্যান্য আড়ম্বর৷ হুজুগে বাঙালী মাতোয়ারা হয়ে ওঠে দুর্গাপূজায়৷ নূতন পোষাক জাঁকজজমকপূর্ণভা খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়---সব নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া৷

কিন্তু এই আনন্দের জোয়ার কি বাঙলার ও বাঙালী সমাজে সর্বত্র পৌঁছোয়? এই কয়দিন পত্র-পত্রিকা আলোর রোশনাইয়ের ছবিতে ভরপুর থাকে৷ কিন্তু এই আলোর ঠিক পাশটিতেই যে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করে, সেদিকে খুব একটা কারোর নজর আসে না৷ গ্রামাঞ্চলের দিকে গেলে দেখা যাবে হাজার হাজার মানুষ প্রত্যন্ত গ্রামে যারা দারিদ্র্যসীমার নীচের পরিবারগুলির শিশুরা এই দুর্গোৎসবের সামগ্রিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত৷ তাদের নতুন জামা-কাপড় পরার সামর্থ কই? শহরেও যারা ঝুপড়িবাসী ও ফুটপাতবাসী তাদের অবস্থাও এমনই৷ এদের শিশুদের মুখের দিকে তাকালে মন ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে৷ এদের শিশুরা প্রায় আদুল গায়ে প্যাণ্ডেলের পাশে একটুখানি প্রসাদের ফলমূলের জন্যে বা একটু খিচুড়ির জন্যে লাইন দেয়৷ কোনো সমাজসেবী সংস্থা হয়ত দশ-বিশ জনকে কিছু নতুন জামা-কাপড় দেয়৷ যারা পায় তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে৷ এরা দু’বেলা পেট ভরে খেতেই পায় না, রোগের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার আলো থেকে এরা বঞ্চিতই থাকে বলা চলে৷ সরকারী সর্বশিক্ষার ব্যবস্থায় এদের শিশুরা দুপুরে খাবারের জন্যে স্কুলে এলেও পড়াশোনা এদের হয় নামমাত্র৷ আলোর রোশনাইয়ের পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারেরই বাসিন্দা এরা৷

কিন্তু কেন এমন হবে? একদিকে বিপুল বিলাসিতা, বিপুল প্রাচুর্য ও তার সঙ্গে সঙ্গে অপচয়৷ অথচ তাদের পাশেই এরা অভাবে-অনটনে শুকিয়ে মরবে কেন? বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক তো বিশ্বস্রষ্টা পরমব্রহ্ম৷ সেই বিশ্বপিতার সন্তান হিসেবে বিশ্বের সমস্ত সম্পদে সবাইকার অধিকার৷ তাহলে কেন এদের সামান্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসের ব্যবস্থা হয় না৷

বলা হয় দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা কুমারীপূজা, নারীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজার নামে মাতৃশক্তির আরাধনা করা হয়৷ আর এর মাধ্যমে নাকি মাতৃশক্তির জাগরণের জন্যে সবাই প্রার্থনা করেন! কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি? সারা দেশ জুড়ে নারী জাতির ওপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে৷ ঘরে ঘরে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির হাতে বধূ নির্যাতন, পুত্র-পুত্রবধূর হাতে বৃদ্ধা মায়ের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে যত্রতত্র এমনকি বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী অফিসেও যৌন নির্যাতন বা নানাভাবে মাতৃজাতির ওপর নির্যাতনের সংবাদে পত্রপত্রিকা ভরে থাকে৷ আসলে এইভাবে লোকদেখানো পূজার আড়ম্বরে মেতে থাকা নয়, প্রকৃত আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানসিকতথা আত্মিক চেতনার প্রসার ঘটাতে হবে৷ ধর্মীয় আড়ম্বর ও ধর্ম ধর্ম করে লোকদেখানো মাতামাতিতে ধর্মচেতনার বিকাশ ঘটে না৷ আত্মশক্তির জাগরণের জন্যে সাধনা অভ্যাস করতে হবে৷ অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার তথা ডগমার খোলস ছেড়ে মনের বিস্তার ঘটাতে হবে৷ মনের চরম বিস্তার ঘটিয়েই আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে৷ তখনই সমস্ত মানুষের প্রতি, শুধু মানুষ নয়, পশু-পক্ষী-তরুলতা সবার প্রতি ভালবাসা ও কর্তব্যবোধ জাগবে৷ বর্তমান বাহ্য পূজার নামে আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডীতে বদ্ধ না থেকে নব্যমানবতাবোধের প্রসার ঘটাতে হবে৷

যারা এইভাবে মানসিক তথা আত্মিক প্রসার ঘটিয়ে নব্যমানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হবে, তারাই পারবে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিতদের কাছে টেনে নিয়ে এক সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ গড়তে৷ আজ সেই সমস্ত মানুষ (যাদের বলা হবে সদ্বিপ্র) তাদের সমাজের সবাইকে নিয়ে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে৷

শারদোৎসবের অবসরে শুধু তথাকথিত আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে না দিয়ে আত্মশক্তির জাগরণ তথা সমাজের নবজাগরণের দিকটা চিন্তা করতে সবাইকে অনুরোধ করি৷