আনন্দমার্গে যোগতন্ত্র মনুষ্যত্ব বিকাশের সাধনা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

তন্ত্র কী? এ নিয়ে নানান্ জনের নানান্ প্রশ্ণ৷ এই সমস্ত প্রশ্ণের নিরসনের জন্যে এই  প্রবন্ধের অবতারণা৷

তন্ত্রের আদিগুরু হলেন সদাশিব৷ না শিব কোনো কাল্পনিক দেবতা নয়৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ‘‘নমঃ শিবায় শান্তায়’’ গ্রন্থে শিবের ইতিহাস ও  শিক্ষা মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন৷ তিনি বলেছেন, শিব এসেছিলেন প্রায় ৭ হাজার বছর আগে যেমন কৃষ্ণ এসেছিলেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে৷  শিব তন্ত্র শাস্ত্র রচনা করেছেন ও তন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃত আধ্যাত্মিক সাধনার তত্ত্ব ও প্রয়োগের দিকটা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন৷ তাই সমস্ত তান্ত্রিক সাধক-সাধিকা-গণ শিবকে আদিগুরু বলে নির্বিবাদে স্বীকার করে নেন৷ বলা বাহুল্য, যোগ হ’ল তন্ত্রেরই এক সূক্ষ্ম অংশ৷ তাই শিবকে মহাযোগী বা যোগীশ্বর বলা হয়েও থাকে৷ তন্ত্রের চক্র সাধনা যোগেরও ভিত্তি৷

‘তন্ত্র’ শব্দের ব্যাখ্যা

তন্ত্রের অর্থ কী? শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘তন্ত্র শব্দের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে--- ‘তং জাড্যাৎ তারয়েৎ যস্তু--- সঃ তন্ত্র পরিকীর্ত্তিত’৷ জড়তার বীজ ---‘তং’ থেকে যা পরিত্রাণ করে অর্থাৎ যার কল্যাণে জড়তার  নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়া যায় তার নাম তন্ত্র৷ তন্ত্র শব্দের অন্যরূপে ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে৷ সংসৃকতে ‘তণ্’ ধাতুর অর্থ প্রসারিত হওয়া অর্র্থৎ যে সাধনা পদ্ধতির দ্বারা আত্মবিস্তার ঘটে ও তার ফলে মোক্ষলাভ হয়, তার নাম তন্ত্র৷ তাহলে দেখতে পাচ্ছি মুক্তির  যে সাধনা তাকেই বলতে হয় তন্ত্র অর্থাৎ সাধনা ও তন্ত্র অভিন্ন৷’’

বিদ্যাতন্ত্র ও অবিদ্যাতন্ত্র

যে আগুন মানুষের অশেষ কল্যাণে লাগে, সেই আগুনের অপব্যবহার করলে যেমন তা ধবংসকারী শক্তিরূপে দেখা দেয়, তেমনি তন্ত্রবিদ্যার অপব্যবহার  করে’ তামসিক বৃত্তিসম্পন্ন মানুষেরা মানুষের ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করে ও করেছেও৷ মানুষ মোক্ষমুক্তির বদলে  নিজের প্রতিপত্তি ক্ষমতা, যশবৃদ্ধির  জন্যেও তন্ত্রের অপব্যবহার  করেছে৷ তাই  বলা হয়, তন্ত্রের দুইভাগ ---বিদ্যাতন্ত্র  ও অবিদ্যাতন্ত্র৷

মানুষের সদবুদ্ধি জাগানো, সৎবৃত্তি জাগানো, বিনয় জাগানো, ধর্মভাব জাগানো আত্মসমর্পণের ভাব আর শান্তিকর্ম--- এই ছ’টা মুখ্যতঃ বিদ্যাতন্ত্রের কাজ৷

আর অবিদ্যাতন্ত্রের বিভিন্ন শাখা হল---মারণ, বশীকরণ, উচাটন, সম্মোহন,স্তম্ভন প্রভৃতি৷

যুগে যুগে বিভিন্ন সাধক সাধিকাগণ এই বিদ্যাতন্ত্রের অনুসরণ করে নিজের ও জগতের কল্যাণ সাধন করেছেন৷ প্রাচীনকালে বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ঋষিগণ এই বিদ্যাতন্ত্রের অনুসরণ করেছেন৷

ব্যামাখ্যাপা, শ্রীরামকৃষ্ণদেব এঁরাও ছিলেন বিদ্যাতান্ত্রিক৷ এমনি রাজা রামমোহন রায়ও তন্ত্রসাধনা করতেন৷

তন্ত্রসাধনা ও মূর্ত্তিপূজা

অনেকে তন্ত্র সাধনাকে কালিপূজা , দূর্গাপূজার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখেন৷ কিন্তু লক্ষ্যণীয়, তন্ত্র সাত হাজার বছরের পুরোনো, কিন্তু বর্তমানে যে দূর্গাপূজা ও কালিপূজার প্রচলন তা শুরু হয়েছিল প্রায় ছশো বছর আগে৷ (বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই ইতিহাসও প্রকাশিত  হয়েছে৷) পাঠান আমলের গোড়ার দিকে বরেন্দ্রভূমিতে মানে উত্তর বাঙলার রাজশাহী জেলার  তাহেরপুরে এক রাজা ছিলেন৷ নাম কংসনারায়ণ রায়৷ তিনি পণ্ডিতদের ডেকে বললেন, ‘‘আমি রাজসূয় কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই৷ মানুষ জানুক আমার ধন ঐশ্বর্য কী রকম আছে, আমি দুহাতে ফেলে ছড়িয়ে  দানও করব৷ একথা শুণে পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, এই কলিযুগে অশ্বমেধ, রাজসূয় হয় না৷ তাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে  যে দূর্গাপূজার  কথা রয়েছে, তাতেও জাঁকজমক দেখানো যায়, ঐশ্বর্যের প্রকাশ করা যায়৷ বলা বাহুল্য, এই ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণও রচিত হয়েছিল, প্রায় তেরশ’ বছর আগে৷ সমস্ত পুরাণাদির রচনার উদ্দেশ্য ছিল, লোকশিক্ষা দেওয়া৷ পুরাণ ‘ইতিবৃত্ত’ বা ‘ইতিহাস’ নয়, লোকশিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷

যাইহোক পণ্ডিতদের কথামত রাজা কংস নারায়ণ রায় তৎকালীন সাতলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে দূর্গাপূজা করেছিলেন৷ তাঁর দেখাদেখি একটাকিয়ার  রাজা (রংপুর জেলার অন্তর্গত) রাজা জগদ্বল্লভ, মতান্তরে জগৎ নারায়ণ রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে আর জাঁকজমক করে দূর্গাপূজা  করলেন৷ তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য জমিদারও দূর্গাপূজা করা শুরু করে  দিলেন৷ এইভাবে বিভিন্ন জমিদার বাড়ীতে দূর্গাপূজা শুরু হয়ে গেল৷ পরে--- হুগলি জেলার বলাগড় থানার গুপ্তি পাড়ার (গুপ্তবৃন্দাবন) বারজন বন্ধু মিলে ভাবলেন, আমরা এককভাবে তো দূর্গাপূজা করতে পারব না৷ বার জন মিলে পূজা করতে পারি৷ উর্দুভাষায় বন্ধুকে বলে ‘ইয়ার’৷ তাই বারজন ইয়ার মিলে যে দূর্গাপূজা করলেন তার নাম হ’ল বার-ইয়ারী পূজা  বা বারোয়ারী পূজা৷ এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলা রামায়ণ লেখেন কৃত্তিবাস ওঝা৷ সে সময় বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ৷ তিনি  বিদ্যোৎসাহী ছিলেন৷ সংসৃকত ভাষার  ভালো ভালো বই যাতে বাংলা ভাষায় অনুদিত করা হয়, সেই জন্যে তিনি বিশেষ প্রয়াসী ছিলেন৷ তাঁর অনুরোধে কবি কৃত্তিবাস বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করলেন৷ তিনি সংসৃকত বাল্মীকি রামায়ণের হুবুহু বাংলা অনুবাদ করেননি, বাংলার তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির আলোকে তিনি  এতে অনেক পরিবর্তনও এনেছেন৷ সে সময় বাংলায় জমিদার বাড়ীতে দূর্গাপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল৷

কবি কৃত্তিবাস দূর্গাপূজাকে অধিকতর মহিমা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর বাংলা ভাষায় রচিত রামায়ণে রাম কর্তৃক দূর্গাপূজার  উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু লক্ষণীয়, বাল্মীকি রামায়ণে দূর্গাপূজার উল্লেখ নেই, উত্তর ভারতের বিখ্যাত তুলসী দাসী রামায়ণেও রাম কর্তৃক দূর্গাপূজার  উল্লেখ নেই৷

কালিপূজার ইতিহাস

কালীপূজার ইতিহাসও খুব প্রাচীন নয়৷ ভারতীয় সাধক-সাধিকাদের প্রখ্যাত জীবনীকার শংকরনাথ রায় তাঁর ‘ভারতের সাধক’ পুস্তকে (৩য় খণ্ড) এই ইতিহাসের উল্লেখ করেছেন৷

নবদ্বীপের এক প্রান্তে  গঙ্গাতীরে নির্জন শ্মশানে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্রসাধনা করতেন৷ ঘট ও প্রতীক সহায়ে মাতৃজ্ঞানে জগজ্জননীর সাধনাই  তিনি করতেন৷ কিন্তু তাঁর মনের একান্ত বাসনা,জনমনে এই তন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তোলার  জন্যে  জগজ্জননীর বিশেষ রূপ দেওয়া৷ তিনি  অবিরত ভাবতে থাকলেন, ‘‘মাগো তোমার কোনরূপে  আমি পূজো করবো? কোনমূর্ত্তি সর্বজন গ্রাহ্য হয়ে উঠবে?’’

গভীর ধ্যানের মধ্যে তাঁর মনে এই ভাব উদ্ভূত হ’ল, মা যেন বলছেন, ‘‘বৎস, যে মূর্ত্তিতে, আর যে ভঙ্গীতে আমার বিগ্রহের পূজা তোমার দ্বারা প্রচলিত হবে, তা মানবদেহের মাধ্যমেই তোমায় দেখিয়ে দেবো৷ নিদ্রাবসানকালে প্রথম যে নারী মূর্ত্তি যে রূপে যে ভঙ্গীতে তোমার নয়নগোচর হবে, তাই হবে আমার সাধকজনের হৃদয় বিহারিণী মূর্ত্তি’’৷ পরদিন ভোরবেলা কৃষ্ণানন্দ--- গঙ্গার দিকে চলেছেন৷ কিছুটা এগিয়ে অস্ফূট আলোকে দেখলেন, অদূরে  এক  শ্যামাঙ্গিনী গোপকুমারী দাঁড়িয়ে আছেন৷ তাঁর দক্ষিণ পা-টি কুটিরের বারান্দায়  স্থাপিত৷ আর বাম পা  রয়েছে নীচে৷ দক্ষিণ  করতলে রয়েছে গোবর৷ এমনভাবে উঁচু করে আছেন, যেন মেনে হয় বরাভয় মুদ্রার প্রতিচ্ছবি৷ বাম হাত দিয়ে তিনি বেড়ার গায়ে গোবরের প্রলেপ দিচ্ছেন৷ রমণীর কেশরাশি কৃষ্ণবর্ণ, নিটোল দেহের চারিদিকে তাঁর কেশ আলুলায়িত৷ তিনি সামনে হঠাৎ আচার্য কৃষ্ণানন্দকে  দেখে লজ্জায় জিব কেটে দাঁড়ালেন৷

সাধক কৃষ্ণানন্দের অন্তঃস্থল থেকে বিদ্যুৎ খেলে খেল৷ এই মূর্ত্তিকে অন্তরে গেঁথে তিনি জগজ্জননীর মূর্ত্তি গড়ে তা পূজার প্রথা জনমনে প্রচার  করলেন৷ এইভাবে  কালীপূজা বা কালী মার প্রবর্তন হ’ল৷ (ক্রমশঃ)