আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস

লেখক
অাচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

গত ২৬শে জুন আন্তর্জাতিক মাদক  বিরোধী দিবস পালিত হ’ল৷ মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা আনার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের  ৭ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে  এই আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস ঘোষণা  করা হয়৷

প্রকৃতপক্ষে মদ,গাঁজা, হেরোইন, তামাকজাতীয় দ্রব্য প্রভৃতি  নানান্  নেশার  দ্রব্য সমাজের চরম ক্ষতি সাধন  করছে৷ সমাজে  খুন খারাবি, নারী নির্যাতন, বলাৎকার  প্রভৃতি  প্রায় সমস্ত অপরাধ মূলক কার্যের সঙ্গে  নেশা-জাতীয় দ্রব্যের যোগাযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ৷ আমরা শহরে-বাজারে  গা-গঞ্জে প্রায়ই দেখে  থাকি  মদ খেয়ে নেশায়  চুর হয়ে মানুষ  এই সমস্ত  অপরাধ  করে৷

 প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয়  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  বলেছেন, ‘‘নেশার  জিনিষ আমরা তাকেই বলি যার তিনটি  লক্ষণ--- (১) নিয়মিত  সময়ে  নেশার  জিনিস না পেলে মন উশখুশ  করে,  কোনো  কাজে  মন বসে না৷ (২) নেশার  জোর যতক্ষণ  থাকে ততক্ষণ  বুদ্ধিভ্রষ্ট  অবস্থায়  থাকে ও স্থায়ীভাবে নেশা করতে থাকলে  বুদ্ধিভ্রষ্টতাও স্থায়ী হয়ে যায়৷  (৩) নেশার  তৃতীয় দোষ হচ্ছে যকৃত, কন্ঠ , কিডনী অবশ্যই  আক্রান্ত হয়৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোষ্ঠবদ্ধতা রোগও দেখা দেয়৷

মদের নেশা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘‘মানুষের  সবচেয়ে যে বড় সম্পদ  তার বৌদ্ধিকতা, তার বৈদুষ্য--- মদ এই বুদ্ধি -বৈদুষ্যকে  নষ্ট করে দেয়৷ তার থেকে দূরে থাকা মানুষের সর্বতোভাবে উচিত৷’’

রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট, মাদক দ্রব্য সেবনের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর ২ লক্ষ মানুষের  মৃত্যু হয়৷  তাছাড়া, নেশার জন্যে নানান্  রোগের  সৃষ্টি  তো হয়ই৷ মাদক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে রোগ  দেখা দেয় এইসব রোগ সারতে বছরে  পৃথিবীতে  ২৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়৷ আর মাদকদ্রব্য ব্যবহারের জন্যে  সমাজে  অপরাধ সংঘটনের  মাত্রা ক্রমে বেড়েই চলেছে৷

 নানান্ রোগ ছাড়া  মহান দার্শনিক  শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার  যে জিনিসটার ওপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব  দিয়েছেন, পূর্বেই বলা হ’ল, নেশার কবলে পড়ে , মানুষ তার বৌদ্ধিকতা, তার বৈদুষ্য হারিয়ে ফেলছে৷ মানুষ ও পশুর মধ্যে  পার্থক্য কী? মানুষের  বিচারবুদ্ধি আছে,  সে বিবেকের দংশন অনুভব করে,  পশুর মধ্যে  এ ব্যাপারটা  একেবারে নেই৷ সে কেবল তার সহজাত  প্রবৃত্তির  দ্বারাই পরিচালিত  হয়৷

মন যার সম্যকরূপে বিকশিত  তার নাম ‘মানুষ’৷  মন সম্যকরূপে  বিকশিত হওয়ার  কারণে  তার মধ্যে  বিচার করার শক্তি,  ভালমন্দ  বিবেচনা  করার শক্তি  আছে৷ নেশা মানুষের  এই শক্তিটুকু  নষ্ট  করে দেয়৷ তাহলে  সে তো আর  মানুষই  থাকল না৷ সেতো পশুতে পরিণত হল৷ তারপর  নেশার  কারণে  অন্যান্য মারাত্মক রোগ  হওয়ার ব্যাপারটা তো আছেই৷ কিন্তু এই যে বুদ্ধিভ্রষ্টতার ব্যাপার  এতো মানুষের সমাজকে পশুর  সমাজে  পরিণত  করে দিচ্ছে৷ তাই  তো  নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষ  অতি জঘন্যতম  কাজ করে  সমাজের শান্তি শৃঙ্খল নষ্ট করে দিচ্ছে৷

তাই এই মাদকাশক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ , সমস্ত সংঘটন ও সরকারকে বিশেষভাবে  উদ্যোগী হতেই হবে৷

দুঃখের  সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সরকার আবগারী আয় বৃদ্ধির জন্যে পরোক্ষে মাদক-ব্যবসায়কে  সমর্থন করছেন৷  এর কারণে সরকার ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করে  মাদক দ্রব্যাদির  বিরুদ্ধে নামমাত্র  প্রচার  করছেন, আবার ভেতরে  ভেতরে  আবগারী বিভাগ থেকে  দেশের  বা রাজ্যের আর বৃদ্ধি  হোক  এধরণের ভাবনা-চিন্তাও পোষণ করছেন৷ তাই  সরকারের এই ‘দোনামনা’ নীতির কারণে  সরকারের মাদকবিরোধী প্রচারের সঙ্গে তাল রেখে  মাদকদ্রব্যের  ব্যবসাও রমরমিয়ে  চলছে৷

ঘটা করে মাদকদ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের মাধ্যমে একদিকে জনগণকে এর দিকে আকৃষ্ট করা হয়, কেবল নীচে ছোট করে এর ক্ষতিকারক  দিকগুলির কথাও উল্লেখ করে রাখা  হয় মাত্র৷ এই ভাবে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো  হচ্ছে৷ এটা বোঝা উচিত, জল নিম্নগামী, মানুষের মনও সাধারণভাবে তেমনি প্রবৃত্তির টানে  বয়ে যেতে চায়৷ মানুষের মনকে  এই প্রবৃত্তির  নিম্নগামী স্রোত থেকে  টেনে তুলতে হলে এমনি  দুর্বল প্রচারে চলবে না, নিম্নগামী  প্রবণতার  বিরুদ্ধে ও মনকে  ঊধর্বগামী করার স্বপক্ষে প্রবল ধাক্কা দিতে হবে৷

এজন্যে গভীর আন্তরিক ও সর্বপ্রকার চেষ্টা চাই৷  মানবতাকে রক্ষা করতেই  হবে৷ এর জন্যে যা প্রয়োজন  তাই করতে হবে৷ তথাকথিত স্বাধীনতা বা উদারতার  নামে মানবতাকে ধবংসের  পথে  ছুটে যাওয়াকে কোনোমতে প্রশ্রয় দিলে চলবে  না৷

হ্যাঁ, এব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক পন্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে৷ কিন্তু সৎনীতির ব্যাপারে অসতের সঙ্গে কোনো আপোষ করা চলবে না৷

তাছাড়া বর্তমানে তথাকথিত গণতান্ত্রিকতার  নামে শাসন ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে চোর-গুন্ডা বদমায়েশদের প্রশ্রয় দেওয়া, স্বীয় উদ্দেশ্যে-সিদ্ধির জন্যে ওদের  সাহায্য নেওয়ারও একটা প্রবণতা দেখা যায়৷ এর বিরুদ্ধে  প্রবল  জনমত গড়ে তোলা উচিত৷ ব্যষ্টিগত বা দলগত ক্ষমতা লাভের  চেয়ে  সমাজের সামগ্রিক  কল্যাণকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে৷ এব্যাপারে সমাজের  প্রতিটি  শুভবুদ্ধি  সম্পন্ন মানুষকে  সজাগ  হতে হবে৷৷ সামগ্রিক  গণসচেতনতা এ ব্যাপারে  সবচেয়ে বড় কথা৷