অশনি সংকেত

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সংবাদে প্রকাশ, একমাত্র অসমে এন আর সি করতে সরকারের এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা৷ কার টাকা? সরকারকে জনসধারণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা৷ কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, সব রাজ্যেই এন.আর.সি. করা হবে৷ তারপর আবার নাগরিক সংশোধন (সি.এ.এ.) কার্যকর করা হবে৷ অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা এভাবে খরচ হবে৷ তাতে যাদের টাকা, সেই জনসাধারণের কি উপকার হবে? এতে কি গরীব মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা বা কর্মসংস্থান সমস্যার সুুরাহা হবে? না৷ যে টাকায় কোটি কোটি নিরণ্ণ্ মানুষের ক্ষুধার অন্ন মিলত, যে টাকায় গ্রাম বাঙলার কৃষি, সেচের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনা যেত, বিভিন্ন স্থানে ছোটো ছোটো জলাধার করে’ ক্যানেলের মাধ্যমে সারা বছর সেচের জল সরবরাহ করা যেত, গরীব চাষীদের মুখে হাসি ফোটানো যেত, শিক্ষার আলোয় কোটি কোটি শিশুর জীবনকে আলোকিত করা যেত, দরিদ্র সীমারেখার নীচে তলিয়ে থাকা কোটি কোটি অতি গরীব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেত, সেই টাকায় কী হচ্ছে? দেশে আগুন জ্বালানো হচ্ছে৷ অসমে ১৯ লক্ষ বাঙালী---যারা ভারতের মাটিতেই পুরুষের পর পুরুষ ধরে বাস করে আসছেন, সেই বাঙালীরা আজ রাষ্ট্রচূ্যত হয়ে কেউ কেউ ডিটেনশন ক্যাম্প নামক ভয়াবহ জেলখানায় চরম ভাবে নির্যাতীত হচ্ছে, আর বাকীরা তারা এবার কোথায় যাবে, কী করবে? সেই আতঙ্কে চরমভাবে আতঙ্কিত৷ তাদের মধ্যে হিন্দু বাঙালীদের অভয় দিলেও, শাসক দলের করুণা কবে হবে---সেই চিন্তায় চিন্তায় কেউ বা হতাশায় আত্মহত্যা করছে---অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে৷ আর এন.আর.সি.-র জালে ধরা পড়া বিশেষ করে গরীব মুসলীমরা এদেশের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সরকারী আধিকারিকদের অভিপ্রেত নথিপত্র নেই---এ কারণে রাষ্ট্রহীন হয়ে  কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না৷ তাদের যে কি দশা হবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না৷ বিশেষজ্ঞরাও নয়, বাঙলাদেশ ও রাজনীতিজ্ঞরাও নয়৷ বাঙলাদেশ ও তাদের নেবে না জানিয়ে দিয়েছে৷ এদেশে যদি স্থান না হয়, তাহলে কি এই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার তাদের নেই?

এটাকে কেউ মেনে নেবে না৷ তার ওপর সারা দেশে এন আর সি হলে যে সারা দেশ জুড়ে দাবানল জ্বলবে তা সহজেই অনুমেয়৷ জ্বলবে ক---এখনই তো সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে৷ আন্দোলনে উত্তাল দিল্লীর শাহীনবাগ থেকে শুরু করে ত্রিপুরা, অসম, পশ্চিমবাঙলা, কেরল, কর্ণাটক, রাজস্থান, পঞ্জাব---দেশের অধিকাংশ রাজ্যই৷ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রা--- সে জে.এন.ইয়ূ-র হোক, আলিগর বিশ্ববিদ্যালয়েরর হোক, যাদবপুর প্রেসিডেন্সী---সারা দেশের ছাত্রছাত্রারা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিবাদে মুখর৷ আজকের এই উত্তাল আন্দোলন ১৯৭৭ সালের জরুরী অবস্থার পূর্বেকার যুব ছাত্রদের দেশ জুড়ে দুর্নীতি বিরোধী উত্তাল আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে৷ এন.আর.সি. আর তার দোসর সি.এ.এ., ও তার সঙ্গে এন.পি.আর---যাতে জনসংখ্যা গণনার নামে প্রত্যেকের পিতামাতার জন্মস্থান, জন্ম তারিখ এসবের নথি সংগ্রহের অভিযান চলছে---এসবের বিরুদ্ধে সারা দেশ ব্যাপী আগুন জ্বলছে৷ তাতে দেশের শান্তি, উন্নয়ন সব জলাঞ্জলিতে৷

এদিকে মোদীজি যে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি---জি.ডি.পি নিয়ে গর্ব করতেন সেই জি.ডি.পি. বৃদ্ধির হার ক্রমেই নেমে চলেছে৷ ২০১৮-১৯ সালে জি.ডি.পি-বৃদ্ধির হার প্রত্যেক ত্রৈমাসিকে একটু একটু করে নেমেছে৷ প্রথমে ছিল ৮.০, পরবর্তী ত্রৈমাসিকে ৭.০, তারপরে ৬, তারপর ৫.৮৷ ২০১৯-২০ সালে বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা ৫-এ নেমে যাবে৷ ভারতের অর্থনীতিতে আগুন জ্বলছে, সে আগুন নেভানোর চেষ্টা না করে, মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ সস্তা সেণ্টিমেণ্টে সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে৷ আর সেই কারণেই কী দেশ জুড়ে এন.আর.সি আর সি.এ.এ নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি? কিন্তু এ যে দেশ জুড়ে আবার ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ে খেলা করা৷

সারা দেশ জুড়ে যেভাবে স্বাধিকার ও মানবতার মশাল হাতে নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে ও সরকার পক্ষ থেকে যেভাবে ক্রমাগত মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে, দেশ জুড়ে নিশ্চিত রূপে তা অশনি সংকেত!

মোদীজী, অমিত শাহরা ভুলে যাচ্ছেন, এটা একবিংশ শতাব্দী৷ জাত-পাত-সম্প্রদায়ের উগ্র মাদকতা দিয়ে আার মানুষকে বেশীদিন বিপথে পরিচালনা করা যাবে না৷ এখন বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের যুগ, আরও এগিয়ে এটা নব্য মানবতাবাদের যুগ৷ জাত-পাত-সম্প্রদায়ের বিভাজন মানুষ মানবে না৷ মানব সমাজকে পেছন দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না৷ বর্তমান যুগের মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এ ব্যাপারে যা বলেছেন সেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ৷ তিনি বলেছেন ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ কিন্তু আজ কুসংস্কার, সংকীর্ণতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ বিভিন্ন ইজমের কবলে পড়ে মানব সমাজ ধবংস হতে বসেছে৷ এই অবস্থায় মানব সমাজ ধবংস হতে বসেছে৷ এই অবস্থায় মানব সমাজকে এক ও অখণ্ড রূপে গড়ে তুলতে গেলে সেবা ও কল্যাণের মনোভঙ্গী নিয়ে সংশ্লেষণের পথটি বেছে নেওয়া দরকার৷’ ‘সংশ্লেষণ’ বলতে কী বোঝায়?  তিনি বলেছেন  ‘‘সার্বভৌমিক আদর্শের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, সহজ কথায় অনেককে এক করার মধ্যেই রয়েছে সংশ্লেষণের যথার্থ রূপ৷ অন্যদিকে এক অবিভাজ্য সত্তাকে অনেক করার প্রচেষ্টাই হচ্ছে বিশ্লেষণের পথ৷’’

আর স্বদেশী বিদেশী ব্যাপারে তাঁর প্রবর্ত্তিত প্রাউট দর্শনের সুস্পষ্ট অভিমত, যে কোন সম্প্রদায় বা ভাষাভাষী গোষ্ঠী যে এলাকায় বর্তমানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন ও তাঁরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থকে সেই অঞ্চলের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে এক করে দিয়েছেন, তাঁরাই স্থানীয়৷ অর্থাৎ তাঁরাই স্বদেশী বা সেখানকার ন্যায্য নাগরিক৷ এ ব্যাপারে অন্য কোন কূট বিতর্ক থাকা উচিত নয়৷