আত্মহত্যা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

সমম্প্রতি কলকাতার নেতাজী নগর থানার গান্ধী কলোনীতে দেবার্চন ঘোষ নামে এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া গেল৷ তার বিছানাতে পাওয়া গেল তার লেখা সুইসাইড নোট৷ তাতে লেখা ‘আই এ্যাম ফেলিওর৷, গুড বাই বাবা৷’ ওই ঘরে থাকত সে আর তার ছোট ভাই দেবদ্যুতি ঘোষ৷ দেবার্চন ঘোষ ভূগোলে-অনার্স পাশ করে একটা বেসরকারী অফিসে কাজ করছিল৷ ভাই পড়াশোনা করত৷ বাবা পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর৷ বাবা বাইরে থাকেন৷ ছোট ভাই পড়াশোনা করে ঘরে ফিরে দেখে ঘর ভিতর থেকে বন্ধ৷ অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও দেখল ঘর খুলছে না৷ তখন দরজা ভেঙ্গে দেখা গেল দেবার্চনের মৃতদেহ ঝুলছে৷ ঠিক কেন আত্মহত্যা করেছে পুলিশ এখনও জানতে পারেনি৷ কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে হতাশায় এই আত্মহত্যা৷ এমনি ভাবে দেশে, শুধু এই দেশেই বা কেন সারা বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার প্রাণ এভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে৷ চরম মানসিক হতাশায় ভুগতে ভুগতে শেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে৷ খবরে প্রকাশ সারা পৃথিবীতে শত শত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে তার ৩৬.৬ শতাংশ ভারতেই৷ আর লক্ষণীয় যে ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোর কিশোরীরাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক হতাশায় ভুগতে ভুগতে মানসিকভাবে ব্যধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ ন্যাশনাল  মেণ্টাল হেল্থ-এর সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে এই দেশে এভাবে প্রায় ১ কোটি কিশোর কিশোরী মনের রোগে ভুগছে৷

কিন্তু কেন এই হতাশা ও আত্মহত্যা? এর প্রথম কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক৷ জীবনের নূন্যতম চাহিদা মেটানোর ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে না পেরে অনেকেই যে এই পথ বেছে নিচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই৷ এই ধরণের বহু ঘটনার কথা সংবাদপত্রে দেখাও যাচ্ছে৷

বলা বাহুল্য বর্তমান মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এর জন্যে দায়ী৷ দেশের জিডিপি-র যতই ঢাক পেটানো হোক না কেন ‘সাইনিং ইণ্ডিয়া’ বলে দেশের নেতা-নেত্রীরা যতই বত্তৃণতার ফুলঝুরি ওড়াক না কেন, দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষদের অর্থনৈতিক দুর্দশা যে ক্রমবর্ধমান এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই৷ এই সমস্যার সমাধান করতে হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধাঁচটাকেই পরিবর্তন করতে হবে৷ জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ তবে অর্থনৈতিক কারণ যে আত্মহত্যার একমাত্র কারণ তা কিন্তু নয়৷ আত্মহত্যার দ্বিতীয় কারণ সামাজিক৷ যেমন পণপ্রথার মত সামাজিক কুসংস্কারের বলি হয়ে বহু মেয়েদের জীবন অকালে নষ্ট হচ্ছে৷ পণের জন্যে শ্বশুর ঘরে লোকজনের চাপ ও অপমান সইতে না পেরে বহু মহিলা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে৷ অনেককে তো শ্বশুরবাড়ীর লোকে নানাভাবে মেরেও ফেলছে৷ পণপ্রথা যে একটা ঘৃণ্য কুপ্রথা এটা অনেকে স্বীকার করেও নিজেরা কিন্তু পণের দাবী ছাড়তে রাজী নয়৷ এ ব্যপারে শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদ নেই৷

আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল মানুষ জানেনা যে তাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য কি? মহাসম্ভুতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘‘সকল বস্তুরই একটা ভিত্তি থাকা চাই৷ জীবন দৃঢ়ভিত্তিক না হলে সামান্য ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে৷ ব্রহ্মভিত্তিই দৃঢ়তম ভিত্তি৷ ’’

জীবনের লক্ষ্য কেবল অর্থ, যশ বা মান নয়৷ অর্থ আর যশকে জীবনের চরম লক্ষ্য করে চললে মানুষকে একসময় হতাশ হতেই হবে৷ কারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই৷ মানুষ যতই পাবে ততই তার জাগতিক আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি হতে থাকবে৷  এই কামনার আগুনে তাকে  পুড়ে মরতেই হবে৷ জীবনে প্রকৃত স্থায়ী শান্তি সে এ থেকে পাবে না---পেতে পারে না৷ কারণ মানুষের সমস্ত অভাব আর অর্থ বা জাগতিক ভোগ্যবস্তু  যশ এই সবই সীমিত৷ তাই সীমিত কোন কিছু মানুষের অসীম অভাবকে মেটাতে পারে না৷ তা মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে না৷ এসবের পেছনে পাগলের মত ছুটতে ছুটতে মানুষ নিজের অন্তরের শান্তিতো  খোয়াবেই , সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে ও সমাজে হিংসা,  দ্বেষ, বঞ্চনা, দুর্নীতি ও শোষণের  জাল বিস্তার করবে৷ মানুষের জীবনে এই ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী বা ত্রুটিপূর্ণ জীবনচর্চা তথা ত্রুটিপূর্ণ জীবনাদর্শের ফলস্বরূপ সমস্ত সমাাজিক পরিবেশও চরমভাবে দুষিত হবে৷ ফলে সারা সমাজ জুড়ে হতাশা, মনোরোগ, আত্মহত্যা ও পারস্পরিক হত্যার এক দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হবে৷ সমাজ কথাটার মানে ‘‘সমানম্ এজতি ইতি’’ অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলা৷ এই আদর্শে সামাজিক চেতনারই অভাব দেখা দেবে৷ আর হচ্ছেও তাই৷

তাই মানব জীবনের প্রকৃত শান্তির জন্যে ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে সেই প্রাচীন মুনীঋষিদের প্রদর্শিত পথ ‘ নাল্পে সুখমস্তি ভূমৈব সুখম্’-অল্পে সুখ নেই,  ভূমাতেই সুখ৷ এই পথকেই অনুসরণ করতে হবে৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়---‘শুধু সেই পথ আছে, নাহি অন্যপথ৷’

প্রাচ্যের মূল শিক্ষা এই অধ্যাত্মবাদ তথা ভূমাদর্শ ও পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞান কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না, বাদ দিলে চলবে না৷ অধ্যাত্মবাদ ও জড়বিজ্ঞান দুইয়ের মধ্যে একটা সুন্দর সমন্বয় চাই৷

প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের শিক্ষার এইটাই মূল কথা৷ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের জন্যে জড়বিজ্ঞানের অবদানকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না৷ সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিক তথা নৈতিক বিকাশের জন্যে তথা মানসিক প্রসারতার জন্যে বিজ্ঞানভিত্তিক কুসংস্কার মুক্ত অধ্যাত্মবাদের প্রয়োজনও একান্ত জরুরী৷ তাই ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে সমন্বয়বাদী জীবন দর্শনকে জীবনের ভিত্তি করে নিয়ে চলতে হবে৷