বাংলা নববর্ষে বাঙালীর সংকল্প

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পা-পা ক’রে বাংলা নববর্ষ অর্র্থৎ ১লা বৈশাখ এগিয়ে এলো---বাঙালীও পেরিয়ে গেল আর একটা বছর৷ কালের নিয়মেই মাসের পর মাস ক্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বঙ্গ জীবনে চৈত্রের চিতভস্ম উড়িয়ে কালবৈশাখীর তাণ্ডব যেন শুণিয়ে যায় রুদ্র বৈশাখের আগমন বার্র্ত৷ আর বাঙালী তখন গা-ঝাড়া দিয়ে গেয়ে ওঠে-‘‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’’৷ পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে নোতুন বছরকে বরণ করার সাড়ম্বর প্রস্তুতি৷ টেলিবিশন, রেডিওয়, বর্ষবরণের জমকালো অনুষ্ঠান, সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা, গল্পকথা, বৈঠকী আড্ডার বিপুল আয়োজন৷ এই দিনটাতে বাঙালী অন্ততঃ মনে- প্রাণে, সাজে-পোশাকে, চলনে-বলনে, আচার-আচারণে বাঙালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করে৷ সকালে উঠেই স্নান সেরে নোতুন জামা কাপড় প’রে গুরুজনদের প্রণাম করা, ডালি সাজিয়ে মন্দিরে মন্দিরে পূজা অর্চনা, আত্মীয় স্বজন, পরিচিতদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, ইত্যাদির মধ্যদিয়ে শুরু হয় ‘‘শুভ নববর্ষ’’ উদ্যাপন৷ এরপর নববর্ষের উপাদেয় বিশেষ পদ ও ব্যঞ্জনাদিসহ দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের সঙ্গে চলে টেলিবিশনের পর্র্দয় বিশিষ্ট কলাকুশলী, শিল্পী সাহিত্যিকদের বৈঠকী আড্ডার রসাস্বাদন৷ সন্ধ্যায় বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে, অস্থায়ী মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বহুবিধ নৃত্য-গীত-কবিতা-সাহিত্যচর্র্চর আসর৷ এইভাবেই কেটে যায় বাঙালীর নোতুন বছরের প্রথম দিন৷ পরের দিন থেকে আবার সেই গতানুগতিক জীবনচর্র্যর গড্ডলিকা প্রবাহ আর পরবর্তী ১লা বৈশাখের দিকে চাতক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা৷

এতসব উৎসব-অনুষ্ঠান, আনন্দ উপকরণের মধ্যেও সচেতন বাঙালীর মনে একটা বেদনার চিনচিনে অনুভূতি, চেতনার গভীরে বিষাদের মৃদু লহরী বয়ে যায়৷ আমরা নিজেকেই প্রশ্ণ করতে বাধ্য হই--- সত্যিই কি আমরা নিজেদের ‘‘বাঙালী’’ মনে করি--- নাকি ওই ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখের দেখনদারী বাঙালীয়ানাটুকু সেরে আমরা আমাদের বাঙালী জাতিসত্তাকে অচিরেই হারিয়ে ফেলি! চোখের সামনে বাঙলা ভাষার প্রতি বঞ্চনা-অবদমন, বাঙালী জাতিসত্তাকে লাঞ্ছনা ও পদদলিত হতে দেখেও প্রতিবাদে সরব হওয়ার সাহসটুকু ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলেছি৷ আমরা ভুলে যাই, আমাদের পূর্ব প্রজন্মের বাঙালীরাই লঙ্কা জয় করেছিলেন, আমাদের এই বাঙলারই বীর বিপ্লবীদল অকুতোভয়ে প্রবল পরাক্রমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিল৷ মাষ্টারদা সূর্যসেন, শহীদ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ প্রমুখ হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী মরণপণ লড়াই করে আত্ম-বলিদান দিয়েছেন৷ আমাদেরই অগ্রজ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষেরা ভোগবিলাস পূর্ণ নিশ্চিন্ত জীবনের আরাম পরিত্যাগ করে দেশ-মাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন৷ আমাদের এই বাংলারই সুসন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাথ সাহা প্রমুখ মণীষীগণ পৃথিবীর বুকে জ্ঞানে গরিমায় ও আধ্যাত্মিকতায় বাংলার নাম স্বর্র্ণক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন৷ আমরা, আজকের বাঙালিরা সেই ঐতিহ্যকেই তো বহন করে চলেছি, তবে আমরা কেন পারি না বাংলা ও বাঙালীর সেই গৌরবান্বিত পতাকাকে গর্বের সঙ্গে ঊধের্ব তুলে ধরতে?

স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালী ও বাংলার প্রতি যে অবিচার হয়ে চলেছে আমরা কি পারি না তার প্রতিকার করতে? ওপার বাংলা তথা পূর্ব বাংলার বাঙালীরাই তো উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে তাদের নিজস্ব স্বাধীন বাসভূমি ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র! মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় তাঁদের লড়াই ও ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি সাপেক্ষে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ২১শে ফেব্রুয়ারিতে   ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’’ পালনের অধিকার পেয়েছে৷ অবশ্য এদেশেও বাংলার ভাষার জন্যে দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস বর্তমান৷ এই উদ্দেশ্যেই মাতৃভাষার দাবীতে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে অসমের শিলচর ষ্টেশন চত্বরে ১১জন ভাষা-বিপ্লবী শহীদের অমরত্ব বরণ করেন৷ কিন্তু তৎকালীন অসম সরকারের চক্রান্তে, কেন্দ্রীয় সরকারের উপেক্ষা ও ষড়যন্ত্রে, তৎসহ পশ্চিম বাংলার প্রশাসক মণ্ডলীর দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক ভূমিকার কারণে এই ভাষা আন্দোলনকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ সেই সময় ভারতবর্ষের সব বাঙালী জাতি-ধর্মমত-দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ কন্ঠে গর্জে উঠলে হয়তো ভারতবর্ষে বাঙালীর ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হত৷ বর্তমানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে বাঙালী হারিয়েছে তার ভূমি ও ভাষা দুই’ই৷ ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, অসম, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরায় বাংলার যে খণ্ডিত অংশগুলি জবরদস্তি জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে ক্রমশ বাংলা শিক্ষার বিদ্যালয় ও শিক্ষক কমতে কমতে নিঃশেষিত অবস্থায় পৌঁছেছে৷ সেইসব প্রদেশে বাঙালীদের মাতৃভাষা বাঙলা ভুলে হিন্দি বা অন্যভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, জনগণনার সময় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার পরিবর্তে অন্যান্য ভাষা দেখানো হয়েছে৷ ফলে ওই সকল বাঙালীরা আজ মাতৃভাষাহীন হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পর্যবসিত৷ কোন ভাষা অবদমিত হলে সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়, তারা হীনম্মতায় ভুগতে থাকে ও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে৷ আর সেই অবস্থাই হয়েছে অন্যান্য প্রদেশে বসবাসকারী বাঙালী ভাই-বোনেদের৷ এমনকি কলকাতার মত শহরেও বহু বাংলা বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ আর অলিতে গলিতে হিন্দি অথবা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের রমরমা৷ পশ্চিমবঙ্গে আজও পাঠ্যক্রমে বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করা হয়নি, সরকারী বেসরকারী কাজে বাংলার ব্যবহারও সুনিশ্চিত হয়নি৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, শোষণ চক্রান্তে বাঙালী ক্রমশ স্বভূমি ও মাতৃভাষার অধিকার হারাচ্ছে৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাগরিকপঞ্জী বা এন.আর.সির হিংস্র থাবা৷ অসমে এন.আর.সির চক্রান্তে প্রায় ৪০লক্ষ বাঙালীকে নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ হাজার হাজার বাঙালীকে ডি-বোটারের তকমা নিয়ে স্বজন হারিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে অমানবিক ও নির্যাতনের জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে৷ এদিকে বর্তমানে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে৷ বর্তমান প্রশাসক দল তাঁদের ইস্তেহারে জানিয়েছে --- তারা যদি নির্বাচনে জয়ী হয় তবে সারা দেশে এন.আর.সি চালু করবে৷ বুঝতে অসুবিধে নেই যে এই এন.আর.সির লক্ষ্য হবে একমাত্র বাঙালী, যার উদ্দেশ্য বাঙালী জাতিকে সম্পূর্ণতঃ ধবংসের মুখে ঠেলে দেওয়া ও একটি ভূমিহীন, মাতৃভাষাহীন, রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা৷

এমতাবস্থায় প্রত্যেকটি বাঙালীর ভাববার সময় এসেছে আমরা কী নিজেদের ‘বাঙালী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অবস্থায় রয়েছি? যদি ক্রম-অবদমনের ফলে আমরা বাঙলা ভাষাটাই হারিয়ে ফেলি, তবে কি কেউ আমাদের বাঙালী বলে স্বীকৃতি দেবে? সুতরাং পরিণতি হিসেবে এই বাঙালী জাতিটারই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে৷ তাই এই নববর্ষের সালতামামি উৎসব অনুষ্ঠান, নৃত্য-গীত-কবিতা-গল্পে, বেশভূষায় যদি আমরা বাঙালীয়ানা প্রদর্শন করার চেষ্টাতেই মেতে থাকি তবে কিন্তু বাঙালী জাতিসত্তাটাই ধবংস হয়ে যাবে৷ একটা কথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে, নববর্ষ এমন একটা দিন যখন আমাদের ভাবতে হয় গত বছরে আমরা কী করেছি, কী হারিয়েছি, কী পেয়েছি--- সেইসঙ্গে এই সংকল্পও নিতে হবে যে গত বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী বছরে কী কী কাজ করতে পারব৷ আগামীদিনের পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের শপথ নেওয়ার দিনই হলো নববর্ষ৷ এই কারণেই নববর্ষের দিন সমগ্র পৃথিবীর সব বাঙালীর সামনে বাংলাভাষা ও বাঙালীজাতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে আন্তরিক চেষ্টাই আশু কর্ত্তব্য ও মহান দায়িত্ব৷ আর এই দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার প্রত্যেক বাঙালীকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে৷ তখনই আমরা আমাদের ‘বাঙালী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারব---নচেৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আগামীদিনের ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না৷ এই মর্মে স্মরণ করি মহান দার্শনিক ও প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের আশ্বাসবাণী ---

‘‘বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত আছে, আর আমি আশা করব ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷’’

‘‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে পৃথিবী নামে যে ছোট গ্রহটা আছে, সেই পৃথিবীর এক কোণে বাঙালী নামে যে জনগোষ্ঠী আছে, সেই জনগোষ্ঠীরও অন্ধকারের নিশা শেষ হয়ে গেছে৷ অতীতের অন্ধকার থেকে এগোতে এগোতে তার জীবনে নোতুন সূর্র্যেদয় এসেছে৷ এবার তাকে এগিয়ে চলতে হবে৷ চলাটাই তার জীবন ধর্ম৷ মরণের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে’ এগিয়ে চলবার মত প্রাণশক্তি তার যথেষ্ট আছে৷’’