বাঙালিদের নিজস্ব বাসভূমি কোথায়?

লেখক
সুকুমার সরকার

বাঙালির দেশ কোনটি? এই প্রশ্ণ  আজ বাঙালিদের  সামনে  বড় হয়ে  দেখা দিয়েছে৷  অসম, বিহার, মণিপুর, ঝাড়খণ্ড, ওড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আন্দামান, দণ্ডকারণ্য সহ বর্তমান ভারতের  বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাঙালি  বিতাড়ণ চলছে৷  বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে  দেশ ভাগের  কুফল হিসেবে  আজও হিন্দু  বাঙালি মুসলমান  বাঙালি বিতাড়িত হয়ে চলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে কুর্মী বাঙালী, রাজবংশী বাঙালী , মতুয়া বাঙালী করে  বাঙালীদের বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা চলছে৷ আরাকান  বাঙলার  বাঙালিদের দুর্দশার  চিত্র  তো বিশ্ব  বিবেক  কেড়েছে৷ কিন্তু  কেন?  বাঙলা ও বাঙালির  এত  দুরাবস্থার  পিছনে  কারনটাই  বা কী?

ব্রিটিশ আমলে  যখন  অসম  প্রদেশ গড়া হল, তখন  অসমের  ভৌম-কৃষির্থনীতি  অত্যন্ত দুর্বল ছিল৷ সেই দুর্বলতা কাটাতে  ভৌম-বাঙলার  নওগাঁ, করিমগঞ্জ, কাছাড়, শিলচরসহ  বেশ কিছু উন্নত  কৃষিজ অঞ্চল  নবগঠিত  অসম রাজ্যের  মধ্যে ঢুকিয়ে  দেওয়া হয়৷ আজ  তারাই অসমের  বহিরাগত  বাঙালি৷ কী অদ্ভুত বাঙালির  ভাগ্য  বিড়ম্বনা! মণিপুর  ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও অনেকটা ওইরকম৷ মণিপুর  ত্রিপুরার সমতল  অংশ  মূলতঃ বাঙলারই অংশ  ছিল৷ ছিল  নেপালের  ঝাঁপা জেলাও৷ ঝাড়খণ্ডের তো প্রায়  পুরোটাই  বাঙলার অংশ৷ বিহার, ওড়িষ্যার  মধ্যেও  বাঙলার  অনেক ভৌম  অঞ্চল ঢুকানো আছে৷ এখন কথা হচ্ছে, বাঙলার  ভৌম  অঞ্চল  কেটে অন্য রাজ্যের  মধ্যে ঢুকিয়ে  দেওয়া বাঙালিরা কেন বিদেশি  হবে? স্বাধীনতার  নামে বাঙলার  ভাগ করে নেওয়ার ক্ষত হিসেবে আজও  দেশত্যাগের যে হিড়িক চলছে তার খেসারত বাঙালিরা দেবে ? যে উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালীদের আন্দামান দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হল, আজ কেন সেখানে তারা ব্রাত্য হবে? আগে তার ফয়সালা হওয়া দরকার৷ এইসব অঞ্চল  অন্য রাজ্যে  বা রাষ্ট্রে বিভাজিত  করার  আগে  একবারও কি সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে কথা  বলে নিয়েছিল? দেশভাগের সময়ও কি সাধারণ  হিন্দু বাঙালি  মুসলমান  বাঙালিদের  সঙ্গে কথা  বলেছিল? দেশ ভাগ তো হয়েছে  নেহেরু  জিন্নার  গদির  লোভের ভাগবাটোয়ারা  কারণে৷ সাধারণ মানুষ কেন তার  খেসারত দেবে? আজ  রাজ্য-রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বিচারের  আগে কোর্টের  বিচারকদের  এই মানবিক প্রশ্ণের উত্তর দিতে হবে৷ নইলে কোনো এন.আর.সি মানা হবে না৷ কোনো বাঙালিকে তার বসবাস এলাকা থেকে  বিতরণ  করা  চলবে না৷ প্রয়োজনে বাঙালিরা  বৃহত্তর  বাঙালিস্তান  আন্দোলন গড়ে তুলবে৷

আমার মনে হয়, আর কাল বিলম্ব  নয় এখনই  সময় এসে গেছে  ‘‘বাঙালিস্তান’’ আন্দোলন গড়ে তোলার৷ আর  কালবিলম্ব  করলে বাঙালীর সপ্তডিঙ্গা মধুকর তরীর  সর্বনাশের  ভরাডুবি ঘটবে৷

এমনিতেই  বাঙালির  শীতঘুম অনেক  কিছু কেড়ে  নিয়েছে৷ স্বাধীন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম-বঙ্গ, ঝাড়খণ্ড-বঙ্গ, ত্রিপুরা-বঙ্গ, মণিপুর-বঙ্গ, ওড়িষ্যা বঙ্গ, আন্দামান বঙ্গ কোনো বঙ্গেরই  বাঙালিরা ভালো নেই৷

বিদেশি  ইংরেজ  শাদা শোষকেরা  বাঙলা  ভাগ করে  বাঙলার  সর্বনাশ  করে দিয়ে গেছে৷ দেশি  বাদামি  শোষকেরা  সেই  বিভক্ত  বিচ্ছিন্ন বাঙলাকে  বিভিন্নভাবে  শোষণ  করে চলেছে৷ অসম, মণিপুর,ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, আন্দামান,  দণ্ডকারণ্যের বাঙালীদের খুব  সহজেই বিদেশী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে

পশ্চিমবঙ্গে বাঙালীর ভাষা-সংসৃকতির ওপর তো প্রত্যক্ষ শাসন শোষণ চলছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের কুর্মী, মাহাত, মতুয়া রাজবংশী ইত্যাদি করে করে  সর্বনাশের  কিনারে  নিয়ে গেছে৷

বাংলাদেশ স্বাধীন  হয়েও  বাংলাদেশের  বাঙালিরা হিন্দি  বলয়ের  পুঁজিপতি  শাসক  শোষকদের পরোক্ষ শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত নয়৷  বাংলাদেশের  ভাষা-সংসৃকতিতে আজ অকারণ  সাম্রাজ্যবাদী হিন্দি ভাষা ও অসংসৃকতি ঢুকে যাচ্ছে৷ আবার অন্যদিকে  বিশুদ্ধ ইসলামিকরণের নামে  বেমানানভাবে বাংলাদেশের ভাষা-সংসৃকতিতে অনুপ্রবেশ ঘটছে  হাজার  হাজার কিলোমিটার দূরের  মরু ঝড়! আর এতসব  চাপানো  মানসিকতায়  বাঙালি জাতি  ভুলেই  গেছে  তার অতীত গৌরব, সমৃদ্ধ ইতিহাস  ও ঐতিহ্য৷ বাঙালি জাতির  অমিত  সম্ভাবনা  থাকা সত্ত্বেও বাঙালি  আজ সর্বত্র মার খাচ্ছে ৷ উর্বর  খনিজ ও বঞ্চিত  বাঙলা ও বাঙালি আজ সর্বত্র অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত৷ তবে বাঙলাদেশের বাঙালীদের সার্বিক শোষণমুক্তির প্রসঙ্গ আলাদা৷ সেটা ওখানকার বাঙালীতের করতে হবে৷

বঞ্চিত বাঙালিকে  এখনই  জাগতে  হবে৷ বিচ্ছিন্ন ভৌম বাঙলাকে  নিয়ে অবিলম্বে অখণ্ড বাঙালিস্থান গঠন  আন্দোলন  ঝাঁপিয়ে  পড়তে  হবে৷ রাজনৈতিক ঐক্যটাই সব কিছু নয়৷ অর্থনৈতিক ও সাংসৃকতিক শোষণমুক্তির ঐক্যটাই বড় কথা৷

হ্যাঁ, বাঙালিস্তান পশ্চিমে রামগড় পাহাড়ের  পাদদেশ  থেকে পূর্বে  আরাকান ইয়োমা, উত্তরে হিমালয়ের  পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বঙ্গপোসাগর  পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগই  হলো ভৌম  বাঙলার অঞ্চল৷ এটি কোনো মনুষ্যসৃষ্ট  বিভাজন নয় এটি প্রকৃতি সৃষ্ট বিভাজন ৷ সমগ্র  পৃথিবী এইরকম বহু প্রাকৃতিক  বিভাজনে  বহু বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ গ্রহ৷ এর প্রতিটি ভৌম অঞ্চল  ও তার ভৌম জাতিসত্তার  আর্থ-সামাজিক  ও  ভাষা-সাংসৃকতিক সকল বিষয়ের  সঠিক  উপযোগ গ্রহণ করে ও  যুক্তিসঙ্গত  বন্টন করে সমৃদ্ধ বিশ্ব পরিবার  গড়ে তুলতে  হবে৷ কোনো ভৌম জাতিকে  শোষিত বঞ্চিত করে তা  সম্ভব নয়৷

ক্ষুদ্র স্বার্থের  বশবর্তী  হয়ে আজ  যারা বাঙলা ও বাঙালির  প্রভৃতি  ক্ষতি  করছে অবিলম্বে  সকল বাঙালিকে  তার বিরুদ্ধে  প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে৷ নইলে  এই বাঙালি নিধন  যজ্ঞ বন্ধ  করা যাবে না৷  মনে রাখতে হবে, বাঙালি  বাঙালিই৷  হোক সে বাঙালি  আরাকানের, অসমের, ঝাড়খণ্ডের, ওড়িষ্যার, বিহারের, নেপালের. মণিপুরের, অনুদামানের,  বাংলাদেশের, পশ্চিমবঙ্গের, দণ্ডকারণ্যের৷

পৃথিবীর প্রতিটি ভৌম জাতিসত্ত্বার  মানুষের  নিজস্ব আবাসস্থল  আছে৷ যেমন  ইংরেজদের ইংল্যাণ্ড, ওলন্দাজদের  হল্যাণ্ড, খসদের  খশমির বা কশ্মীর৷ রুশদের রাশিয়া, আফগানদের আফগানিস্তান, রাজপুতদের রাজস্থান তেমনই  বাঙালিদের বাঙালিস্তান৷  এর মধ্যে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা  নেই৷ আছে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে  বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার  ইঙ্গিত৷

অতীত থেকে  আজ পর্যন্ত  ভারতবর্ষসহ সমগ্র  বিশ্বের  অপরাপর  জনগোষ্ঠী বদ্বীর বাঙলার  উন্নত মেধা ও মগজকে ঈর্র্ষ করে চলেছে৷ যখনই  বাঙলা  ও বাঙালি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে  চেয়েছে তখনই সকলে মিলে বাঙলা ও বাঙালিকে অবদমিত করেছে৷ কখনোই  বাঙালিকে  মাথাচাড়া দিতে দেয়নি৷ অতীতে  এর বহু উদাহরণ  আছে৷

বাঙলা ও বাঙালি শুধু অবদমনই করেনি, বদ্বীপ  বাঙলার  সমৃদ্ধ  অর্থনীতিকে  চিরদিন  শোষণ  করেছে৷ সেই শোষনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে আবারও উঠে পড়ে  লেগেছে বাঙালি নিধনে, বাঙালি বিতাড়ণে৷

সুতরাং আর মুহূর্তের  জন্যও কালবিলম্ব নয়! অবিলম্বে  বাঙলার  সকল বাঙালিকে বাঙালিস্তান আন্দোলন ঝাঁপিয়ে  পড়তে  হবে৷ এছাড়া পুঁজিবাদী শাসক ও শোষকদের জবাব দেবার জন্য  অন্য কোনো  পথ বাঙালিদের সামনে  খোলা নেই৷