বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক  সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অশনি  সংকেত

লেখক
সুকুমার সরকার

শাসন-শোষণের ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজিবাদ  যা দেশীয় পুঁজিবাদও তা৷ স্বাধীনতা পূর্ব ভারতবর্ষ ছিল বিদেশি পুঁজিবাদীদের অধীন আর স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষ দেশীয় পুঁজিবাদীদের  খপ্পরে৷ দুইয়েরই ক্ষতিকারক  প্রভাব সমান৷ ব্রিটিশ শাসকেরাও অর্থ শোষণ করে বিদেশে নিয়ে যেত দেশীয় শোষকরাও দেশীয় শাসকদের সহায়তায় অর্থশোষণ করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে৷ তা হলে তফাৎ কোথায়?

১৯৪৭-এ স্বাধীনতার  পর খণ্ডিত ভারতবর্ষে যারা ক্ষমতায় এসেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারা নিজেরা পুঁজিবাদী নয় পুঁজিবাদীদের পুতুল সরকার৷ তারা বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষের আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির দিকে যতটা না নজর দিয়েছে, তার চেয়ে বেশী নজর দিয়েছে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ধবংস করে’ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শাসন শোষণের প্রভাব বিস্তারের দিকে৷ তারই ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ সত্তর বছরে ভারতের প্রায় বেশিরভাগ প্রদেশ হারিয়েছে তাদের আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য ও সাংসৃকতিক উত্তরাধিকার৷ বাঙলা,অসম, ওড়িশা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো যে কয়টি প্রদেশ ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে  অন্যদের চেয়ে বলিষ্ঠ ছিল, এতদিন পর্যন্ত কিছুটা হলেও যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ হতে শুরু করেছে বা করবে৷

পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-সংস্কৃতির যেটুকু  স্বাতন্ত্র্য এতদিন বজায় ছিল, বিজেপির  মতো প্রত্যক্ষ পুঁজিবাদী দল পশ্চিমবঙ্গে  ক্ষমতায় এলে সেটুকুর যে কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না তা হলফ করে বলা যায়৷

জাতি হিসেবে এবং ভাষা-সংস্কৃতির দিক থেকেও  বাঙালি চির অসাম্প্রদায়িক৷ বাঙালির জাতিতত্ত্ব, বাঙালির উৎসব, বাঙালির ভাষা,বাঙালির পোশাক, বাঙালির পঞ্জিকা,বাঙালির দায়াধিকার,বাঙালির পূজা-পার্বণ সবই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিমিশ্র জনজাতির ভাষা, সংস্কৃতির  মিশ্রণে৷  আর এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বাঙালির আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি৷ কোনো একক জাতির সর্বগ্রাসী  সংস্কৃতির  দ্বারা তা গ্রস্ত  হয়নি৷ কিন্তু এবার সেই সর্বগ্রাসী ক্ষতির অশনি সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এটা অবশ্য পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের শুরু  থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷

কর্পোরট পুঁজিবাদীরা কোনো জাতির ভাষা-সংস্কৃতির ও অর্থনৈতিক স্বতন্ত্রতা ধবংসের  জন্য সংশ্লিষ্ট ভৌম অঞ্চলে  বসবাসকারী  মানুষদের  দুর্বল সেন্টিমেন্টগুলিকে পুঁজি করে৷ পশ্চিমবঙ্গে  বসবাসকারী মানুষদের  বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু বাঙালি৷ বাঙলায় আধিপত্য বিস্তার ও বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতিক পরিবেশ ধবংস করে চিরস্থায়ী শাসন-শোষণ জারি রাখতে গেলে এই হিন্দুত্বের তাস খেলাটাই জরুরি ছিল৷ বিজেপি  সেটাই খেলছে৷ অবশ্য এর  প্রেক্ষাপট তৈরী করেছেন তৃণমূল৷ তৃণমূল সরকারের মুসলিম তোষণ হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক করে তুলতে সহায়তা করেছে৷ বিজেপি  সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে৷

এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, বিজেপি  পশ্চিমবঙ্গে  ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যাকাশে কী কী পরিবর্তন অশনি  সংকেত হয়ে দেখা দেবে?

এক৷ বাঙালির বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, সুকান্ত, লেলিনের মূর্তি ভেঙে হনুমানের মূর্তি বসানোর তোড়জোড় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা৷

দুই৷ পোশাক পরিধানে অবাঙালির পোশাক  পরিধান রীতি চলে আসবে৷

তিন৷ হিন্দি ভাষার ব্যাপকতা বাড়বে৷

চার৷ বাঙালির দূর্র্গপূজা, সরস্বতী পূজার, মনসা পূজা, নবান্ন, নববর্ষের জায়গায় দশেরা, হনুমান চালিশা পাঠ শুরু হবে৷

পাঁচ৷ বাঙালির হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে চিড় ধরবে৷

ছয়৷ এন.আর.সি  চালু হবে৷  আর এর ফলে  একাত্তর  পূর্ববর্তী  হিন্দু বাঙালি ও একাত্তর পরবর্তী হিন্দু বাঙালির  মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে৷

সাত৷ সামাজিক  ও রাজনৈতিক অস্থিরতা  বাড়বে৷

আট৷ হিন্দু মৌলবাদ  বাড়ার সঙ্গে পাল্লা  দিয়ে মুসলিম  মৌলবাদ  শক্তিশালী হতে থাকবে৷

নয়৷ বাঙালির  চাকরি ক্ষেত্রে  ও কলে কারখানায়  অবাঙালি কর্মচারি ও শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাবে৷

দশ ৷ বাঙলা থেকে অর্থের বহিঃস্রোত বাড়বে৷

এগারো৷ বাঙলা থেকে কলকারখানা সহ গুরুত্বপূর্ণ অফিস কাছারি  উঠে যাবে৷

বারো৷ বাঙলায়  অবাঙালির সংখ্যা বেড়ে যাবে৷

তেরো৷ বাঙলার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতি  ধবংস হয়ে কর্পোরট পুঁজিবাদের বাজারে অর্থনীতি বাড়বে৷

চৌদ্দ৷ পশ্চিমবঙ্গের  বর্তমান ভৌম মানচিত্র খর্ব হতে  পারে৷

পনের৷ সার্বিকভাবে  বাঙালির মেরুদণ্ডই ভেঙে যাবে৷ অতীতের শাসক  দলগুলি বাঙলার যে সর্বনাশ করে গেছে, বিজেপি সেই সর্বনাশ থেকে উঠে আসার সম্ভাবনোকেও শেষ করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে  সর্বনাশের  অতলে তলিয়ে দেবে৷

এতো মাত্র কয়েকটি  কারণ তুলে  ধরা গেলে৷ বাস্তবে এরচেয়েও  অনেক বেশি অশান্তি  ও অরাজকতার পরিস্থিতি  সৃষ্টি হতে পারে৷ সুতরাং বাঙালি সাবধান! পশ্চিমবঙ্গের আজকের বেহাল দশা থেকে বেরিয়ে  আসতে পশ্চিমবঙ্গের  বাঙালিরা বিজেপি নামক যে বিপদজনক রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন  হতে যাচ্ছে, তা বাঙলা ও বাঙালিকে আরও বেশি বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবে৷ এমতাবস্থায় বাঙালির উচিত আগত দিনে একুশ শতকের মহান বাঙালি দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রগতিশীল  উপযোগ তত্ত্ব (প্রাউট)-এর আলোকে গঠিত রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হওয়া৷