বিভিন্ন মতবাদ বনাম মানবধর্ম

লেখক
আচার্য অমৃতবোধানন্দ অবধূত

এই ধরাপৃষ্ঠে মানুষের আবির্র্ভব দশ লক্ষ বছর পূর্বে হলেও মানবসভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে মাত্র পনের হাজার বছর পূর্বে ঋগ্বেদের আমলে৷ তার পূর্বে মানুষকে একটা বন্য ও প্রকৃতির প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ অসহায় জীবন কাটাতে হয়েছিল৷ সভ্যতার সূত্রপাত তখন হলেও, বিধিবদ্ধ দাম্পত্য জীবন বা পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে সাত হাজার বছর পূর্বে তারকব্রহ্ম সদাশিবের আবির্ভাবের পরে৷ তার পূর্বে সুসংবদ্ধ কোন পারিবারিক জীবন ছিল না৷ সমাজে সন্তানের মায়ের পরিচয় থাকলে জন্মদাতা পিতার কোন পরিচয় ছিল না৷ সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব একা মাকেই বহন করতে হতো৷ এই বিশ্বে শিবই প্রথম বিবাহিত পুরুষ ছিলেন৷ তিনি এইভাবে পরিবার জীবনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ জীবনেরও রূপরেখা দিয়ে যান৷ ৷ তিনি তন্ত্র, যোগ, নৃত্য, বাদ্য, গীত, সুরসপ্তক, বৈদ্যক চিকিৎসা শাস্ত্র সহ সমাজ কল্যাণে অনেককিছু দিয়ে গেছেন৷ তার ভূমিকাকে আমরা যথার্থ সমাজগুরু রূপে আখ্যায়িত করতে পারি৷ তাই বলা হয় আদিগুরু সদাশিব৷

তার পরে আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে তারকব্রহ্ম রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ৷ তিনি মূলতঃ রাষ্ট্রগুরুর ভূমিকা পালন করেন৷ তাঁর আমলে সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও যথার্থ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি ৷ তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য পরস্পরের মধ্যে দখলদারীর লক্ষ্যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতো৷ ফলে রাজ্যগুলোতে কোন উন্নয়ন বা শান্তি বলে কিছু ছিল না৷ তিনি শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মধ্যদিয়ে মহাভারতের সৃষ্টির মাধ্যমে একটা দৃঢ় ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে যান৷

পরবর্তীকালে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ ও বিভিন্ন মুনি-ঋষি তারকব্রহ্মদের বাণীর উপর আধার করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহাপুরুষেরা ধর্মীয় মতবাদের জন্ম হয়৷ সারা পৃথিবীতে এইভাবেই বিভিন্ন মহাপুরুষদের ও তাঁদের মতবাদের আবির্ভাব হয়েছে৷ যেমন হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান ও শিখ ইত্যাদি৷ গৌতমবুদ্ধের বাণী সম্বলিত ত্রিপিটক ধর্মগ্রন্থ তথা তাঁর বিভিন্ন বাণী নিয়ে তাঁর শিষ্যগণ বৌদ্ধ মতবাদের জন্ম দেন৷ হজরত মহম্মদ তাঁর কোরাণ ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে ইসলাম মতবাদের জন্ম দেন৷ পরবর্তী সময় জড়বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্যে, ভোগমুখি মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় কিছু নাস্তিক জড়বাদী দর্শনের৷ এই মতবাদগুলোকে একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে যে তাদের পক্ষে মানব সমাজের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী সার্বিক কল্যাণ একেবারেই অসম্ভব৷

যদি খ্রীষ্টান মতবাদের সূক্ষ্মভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে প্রতীয়মান হবে যে ‘‘পাপ’’ বোধ থেকে খ্রীষ্টান মতবাদের উৎপত্তি৷ ঠিক তেমনি দুঃখ বোধ থেকে বৌদ্ধ মতবাদের উৎপত্তি ৷ অর্র্থৎ উভয় মতবাদই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সৃষ্ট৷ নেতিবাচক কোন জীবনদর্শনের ভিত্তি হতে পারে না৷ ইসলামের কথা ধরলে , সেখানে তাদের অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে যে ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’৷ অর্র্থৎ ভালাবাসা বা প্রেম নয়, ভয় থেকেই আল্লাহ কে মান্য কর৷ যাকে ভয় করা হয়, সে কী কখনও আপনজন হতে পারে? তাই ইসলামেরও একটা নেতিবাচক জীবনবোধ থেকেই যাত্রা শুরু৷ আর সেই ভয়ের বাতাবরণই বিশ্বের সর্বত্র সৃষ্টি করে চলছেন এই মতবাদের অনুসারীরা৷ তাদের দৃষ্টিতে অমুসলিম মানেই ‘কাফের’৷ আবার তাদের মধ্যেকার সিয়া-সুন্নির বিভাজনের মধ্যেও একে অন্যের দৃষ্টিতে কাফের৷ আর এই কাফেরদেরকে শায়েস্তা করে’ ‘জেহাদি’ হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের কাছে পবিত্র কাজ বলে গণ্য হয়৷ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো গোষ্ঠীর কল্যাণ বা উন্নয়ন তাদের কাছে কাম্য নয়৷ তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না৷ বাংলাদেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে স্বাধীনতার সময় সেখানে হিন্দু ছিল ২২ শতাংশ তা বর্তমানে কমে ৬ শতাংশ হয়েছে৷ প্রবণতা নিম্নমুখী৷ আবার পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার সময় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১৯.৮৫শতাংশ বর্তমানে বেড়ে ৩১শতাংশ৷ প্রবণতা উধর্বমুখী৷

সম্প্রতি মূল্যায়নে উঠে এসেছে যে বুদ্ধ তার দর্শনে চারটি বড় ভুল করেছিলেন, তারমধ্যে একটি ছিল এই মতবাদকে রাজধর্ম করে দেওয়া৷ আর অহিংসার ভুল ব্যাখ্যা সহ কিছু ভুলের কারণে বৌদ্ধ মতবাদ আজ ক্রমক্ষীয়মাণ৷ সামান্য যে টুকু টিকে আছে, জীবনের কোন উত্তাপ নেই৷

তাই এই পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম ও হিন্দুরা, এই উপমহাদেশে যার যার মতবাদ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার প্রবণতা থেকে বিরত থাকা উচিত৷ তার পরিবর্তে উন্নয়ন ও শোষণ বিরোধী আন্দোলনকেই হাতিয়ার করা অধিক কল্যাণকর হবে৷ অন্যথায় সার্বিক প্রগতি ব্যাহত হবে, বিদ্বেষ স্থায়ী রূপ নেবে৷ বৈচিত্র্যই প্রকৃতির ধর্ম, তার বিরোধিতায় পতন অনিবার্য৷

মানব সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রথম দিকে এই মতবাদগুলোর নির্দেশেই পরিচালিত হত৷ ক্রমবিবর্তনের এই ধারায় কিছু প্রগতিশীল মানুষ লক্ষ্য করলেন যে, উক্ত শাসন ব্যবস্থাকে ঠিক যুক্তি ও বিবেক সঙ্গত উত্তম শাসন ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করা যায় না৷ তখন কিছু জনগোষ্ঠী, নিজেরা মতবাদের এই গণ্ডির বাহিরে গিয়ে,মতবাদ নিরপেক্ষ যুক্তি সংগত কিছু ‘‘সোস্যাল কোড্’’ তৈরী করে গণতান্ত্রিক ধাচে সংবিধান রচনা করে শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন৷ এইভাবে হিন্দু খ্রীষ্টান প্রভৃতি গোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘সোস্যাল কোড্’-কে মেনে নিলেও, একমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় এই রকম কোন সংস্কারের পথে না গিয়ে সাবেকি শরিয়ত মতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলছে৷ এটাই অন্যান্যদের সাথে মুসলিম বিশ্বের সংঘাত ও তাঁদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ৷

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা উল্লেখ করছি যে, কার কোন পবিত্র ধর্মগ্রন্থের দুর্র্বেধ্য ভাষায় কী কী ভাল কথা লেখা আছে সেটা বড় কথা নয়, (যার আবার মনগড়া ব্যাখ্যা, ব্যষ্টিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে) এখানে প্রগতিশীলদের কাছে বিচারে প্রাধান্য পেয়ে থাকে, বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আচরণের সমষ্টিগত প্রতিফলিত রূপকেই৷ তার মাধ্যমেই কোন জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব নির্র্ধরিত হয়ে থাকে৷

বৃক্ষের যথার্থ পরিচয় ফলের মাধ্যমেই পাওয়া যায়৷ ‘টক’ গাছের আম গলাবাজি করে বা কোন অজুহাতে মিষ্টি বলে প্রতিপন্ন করা যায় না৷

এবার আসা যাক ‘‘আনন্দ মার্গ’’ দর্শনের প্রসঙ্গে৷ নামকরণ থেকেই একথা পরিষ্কার যে মানুষের আনন্দ প্রাপ্তির শাশ্বত এষণা থেকেই এ নামকরণ৷ অর্র্থৎ জীবনের একটা পজিটিভ ভাবনা থেকেই এই নামের উৎপত্তি৷ ধর্মকথার অন্তনির্হিত অর্থ কোন কিছুর স্বভাব বা তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্যকেই বোঝায়৷ যেমন জলের ধর্ম তরলতা, তৃষ্ণা নিবারণ করা, নীচের দিকে গড়ানো৷ আবার আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেয়া৷ বিভিন্ন প্রজাতি, যেমন হাতি তার খাওয়া খাদ্য, বংশবৃদ্ধি , সবকিছু মিলে তার যে স্বভাব, তাই তার ধর্ম৷ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত, আফ্রিকা সহ বিশ্বের সকল হাতীর স্বভাব ধর্ম একটাই হয়৷ সেই হিসাবে সকল মানবজাতির একটাই ধর্ম৷ একাধিক হতে পারে না৷ সেটাকে আমরা মানব ধর্ম বলতে পারি৷ এই বিশ্বে মনপ্রধান জীব মানুষের খাওয়াখাদ্য পোষাক-আশাকে জীবনযাত্রা প্রণালীতে কিছুটা স্থানীয় বা ভৌগোলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও, সত্তাগত দিক দিয়ে সকলের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে একটা গভীর মিল খঁুজে পাওয়া যায়৷ আর সেটা হচ্ছে আনন্দ পাওয়া৷ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেশিরভাগ মানুষই যেনতেন প্রকারেণ অর্থ রোজগারে ব্যস্ত৷

তার মানে অর্থ আয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে প্রয়োজনের সামগ্রী কিনে সুখসচ্ছন্দে জীবনযাপন করা৷ মাতাল নেশা করে সুখ পাওয়ার জন্যেই৷ এই জাগতিক বিষয় সোণা, গয়না, গাড়ি, বাড়ি, ভোগবিলাসের মধ্য দিয়ে মানুষ শুধু ক্ষণিকের সুখ পেলেও,শান্তি বা আনন্দ অধরাই থেকে যায়৷ সুখের সঙ্গে পর্যায়ক্রমিকভাবে কিন্তু দুঃখও আসে, যেমন দিনের পরে আবার রাত আসে৷ মানুষ কিন্তু এই সুখকে অনন্ত পরিমাণে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে পেতে চায়৷ অর্থাৎ মানব জাতির চাহিদা হল অসীম৷     দুঃখ স্বাভাবিকভাবেই এসে যাচ্ছে৷ ‘‘আনন্দসূত্রম্’’ গ্রন্থে বলা হচ্ছে, ‘সুখম্ অনন্তম্ আনন্দম্’৷ অর্র্থৎ অনন্ত সুখকেই আনন্দ বলা হয়৷ তাই সুখ ক্ষণিকের, আনন্দ চিরন্তন৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরম ব্রহ্মই একমাত্র অসীম ও আনন্দঘন সত্তা৷ উক্তগ্রন্থে বলা হচ্ছে , ‘‘আনন্দম্ ব্রহ্ম ইত্যাহু’’৷ তাই অসীম আনন্দঘন, এক ও অদ্বিতীয় পরম ব্রহ্মই মানুষের একমাত্র ধ্যেয় হওয়া উচিত৷ যম নিয়ম, অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনা ও জীবজগতের কল্যাণ সমাজ সেবার মাধ্যমেই তাঁকে লাভ করা সম্ভব৷ জগৎকে মিথ্যা বলে অবহেলা করলে চলবে না৷ জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পরমাগতির পানে এগোতে হবে৷ এই জগতে সৃষ্ট জড়চেতন সব কিছুই পরমপিতার অত্যন্ত স্নেহের সন্তান৷ সন্তানকে ভাল না বেসে অবহেলা করলে সেই সন্তানের পিতার মন যেমন জয় করা যায় না, ঠিক তেমনি এই জগতে সৃষ্ট জীবজন্তুকে খাদ্য বা ধর্মের নামে হত্যা করলে পরমপুরুষের পিতৃহৃদয়ও সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়, ও উদ্দিষ্ট ব্যষ্টিবর্গ তার বিরূপ ভাজনই হয়ে থাকেন৷

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার নির্গলিতার্থ দাঁড়াচ্ছে, আনন্দের পথে চলে, আনন্দ লাভই মানুষেরএকমাত্র ধর্ম৷ পথকে সংসৃকতে বলা হয় মার্গ৷ তাই আনন্দমার্গই হচ্ছে সকল মানুষের অনুসরণীয় একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ধর্ম৷ হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান প্রভৃতি মতবাদ, মানব ধর্ম নয়৷