বিপন্ন বাল্যকাল

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

বর্তমান পৃথিবীতে ছোট ছোট  ছেলেমেয়েদের অবস্থা সর্বাপেক্ষা সঙ্গীন৷  একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই  তাদের জীবনে  একদিকে যেমন রয়েছে চরম অসহায়তা অন্যদিকে  তাদেরকে নিয়ে  বিভিন্ন পেশার মানুষের বহুবিধ অনৈতিক কাজকর্ম৷ শিশু জন্মানোর পর থেকেই  কখনো হয়তো মায়ের কোল ছাড়া হয়ে বিক্রি হয়ে যেতে হয় অন্য কারোর কোলে ঠাঁই পাওয়ার জন্যে  আবার কখনো  তাদের কোনো শিশুসদনে প্রতিপালন  করে বিভিন্ন রকমের অনৈতিক কাজকর্মের উপযুক্ত করে তোলা হয়৷ শুধু তাই নয়, অনেকসময়  তাদের শৈশব  অবস্থাতেই  দুশ্চরিত্র মানুষজনের পাশবিক লালসার শিকারও  হতে হয়৷ তারা না করতে পারে প্রতিবাদ--- না করতে পারে প্রতিরোধ৷ যারা ভাগ্যবান শিশু, তারাও মাতা-পিতার আশা অকাঙ্ক্ষার ক্রীড়ণক হয়ে জীবনের প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে বাধ্য হয়৷  একদিকে পড়াশোনার চাপ , কবিতা, গান, নৃত্য, খেলাধূলা ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শিতা  প্রদর্শনের প্রত্যাশা৷  তাদের শৈশবকে ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করতে থাকে৷ আর পিঠের বোঝাও যায় একটু একটু করে বেড়ে৷ এরফলে তাদের মনের সুকোমল বৃত্তিগুলো  পরিস্ফূরণের  সুযোগ না পাওয়ায়  ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে বাধ্য হয়৷ বর্তমানে নিউক্লিয়ার পরিবারের  সদস্য হওয়ার ফলে ঠাকুমা দিদিমাদের ভালোবাসা স্নেহ থেকে তারা হয় বঞ্চিত৷ ফলে বেশিরভাগ শিশুরই মানসিক উদারতা বিকাশের সুযোগ পায় না, তারা হয়ে পড়ে  জেদি ও খিটখিটে৷  অথচ তাদেরকেই  মা-বাবার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যে এই দরজা থেকে ওই দরজায় প্রতিনিয়ত ছুটে চলতে হয়৷

এছাড়া  শিশুরা যে পরিবেশে মানুষ হয়ে ওঠে তাও খুব একটা তাদের মানসিক সংরচনার অনুকূল না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে তারা অত্যাচারের শিকার হয়৷ পাঠশালা -বিদ্যালয়, কিংবা খেলাধূলার জায়গায় তাদের সুরক্ষার অভাব সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়৷  সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে এই সমস্ত ঘটনার কথা জানতে পারি৷ কখনো  বিদ্যালয়, কখনো খেলার মাঠে, ড্রেসিংরুমে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে৷ এগুলির ফলে শিশু মনের বিকাশ ও চরিত্র গঠনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে৷ সুন্দর পরিবেশে লালিত পালিত হলে  তাদের মনের জগতেও সুন্দরের ছোঁয়া লাগে৷ কিন্তু পরিবেশ যদি দূষিত ও বিষাক্ত হয় তার প্রভাব থেকেও তারা কোনভাবে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না৷

বর্তমান সমাজে  অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও  সুন্দর শৈশবের অনুকূল নয়৷  বিশেষতঃ ভারতবর্ষের মতো বিশাল জনবহুল দেশে,  একদিকে  যেমন শিশুর জন্মহার অত্যধিক বেশী অন্যদিকে  সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের  ও রোজগারের  ব্যবস্থা অত্যন্ত কম৷ যার ফলে গ্রামে গঞ্জে সাধারণ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পিতামাতার কাছে যেমন খাওয়ার জন্য একটি মুখ নিয়ে আসে, ঠিক তেমনি তাদের সঙ্গে থাকে দু’টি  ক’রে  হাত৷  আর এই হাতদুটিকে সম্বল করে একেবারে বাল্যকাল থেকেই  পরিবারের জন্যে অর্থোপার্জন  বা কর্মে সহায়তা করতে তারা এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়৷

তাই আমরা দেখতে পাই ছোট ছোট চায়ের দোকান থেকে বড় বড় রেষ্টুরেন্টে  শিশুশ্রমিক , ষ্টেশনে-বাজারে শিশু হকার,  ক্ষেতে-খামারে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের শ্রম  দান৷  এছাড়াও  রয়েছে ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট ধরণের কাজকর্ম৷ যে শিশুরা লেখাপড়া করে  হয়তো পরবর্তীকালে দেশের সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারতো , তারা সুযোগ ও সহায়তার অভাবে জনরণ্যে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়৷  সাম্প্রতিককালে শিশু শিক্ষার প্রসার  ও বিদ্যালয়ছুটদের বিদ্যালয়মুখী করার  বিভিন্ন প্রচেষ্টা  চালানো হলেও  পিতা-মাতার আর্থিক অবস্থা ও দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ সেই উদ্দ্যেশ্য  সাধনের পথে একটি বড় অন্তরায়৷

বিভিন্ন সময় এই শিশুদেরকে নিয়ে বহুবিধ রাজনৈতিক খেলাও চলে৷ রাজনৈতিক সভা সমিতি ও মিছিলে  ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যোগ দিতে দেখা যায় ৷ এমনকি সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে (রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে) ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা  মাথায় ফেট্টি বেঁধে, হাতে শাণিত তরোওয়াল-ত্রিশূল ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে  সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করছে৷  এই সমস্ত সভাসমিতি -মিছিলে যারা শিশুদের নিয়ে আসেন, তাদের বোঝা উচিত যে এই শিশুগুলোর  মনে  সুকুমার বৃত্তির পরিবর্তে   হিংসা ও বিদ্বেষাত্মক  মনোভাব  তাঁরা প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন৷ ফলে  হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তির দ্বারা এই শিশুদের মন আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে একটি অপরাধী মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের জন্ম দেবে৷

কয়েকদিন আগে আমেরিকার ফ্লোরিডায় একটি স্কুলে  বন্দুকবাজের হামলায় বহুশিশু আহত ও নিহত হয়৷ অবশ্য আমেরিকার স্কুলগুলিতে মাঝে মধ্যেই এই ধরণের বন্দুকবাজের হামলা ঘটে থাকে যার কারণ হয়তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হয়৷ প্রকৃতপক্ষে আমেরিকায় আগ্ণেয়াস্ত্রের ব্যবহার অত্যধিক বেশী৷ তাদের দেশীয় আইনের বলেই  আমেরিকার অধিবাসীরা নিজেদের বাড়িতে আগ্ণেয়াস্ত্র রাখতে পারে ও প্রয়োজনে তার ব্যবহারও করতে পারে৷  সেখানকার শিশুরা কোন কারণে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত হলে  তাদের কাছে এই আগ্ণেয়াস্ত্রগুলি সহজলভ্য হয়ে ওঠে৷  তাই অনেক সময়ই আমেরিকার মতো দেশে এই নাবালকদের দ্বারা  সশস্ত্র হামলার ঘটনাগুলিও ঘটে৷ তবে আশার কথা এই যে, ফ্লোরিডার ঘটনার পরবর্তী অধ্যায়ে বেশকিছু ছোট ছেলেমেয়েদের উদ্যোগেই একটি শান্তি প্রয়াস সংঘটিত হয়েছে  আর  ওই দেশের বেশ কিছুমানুষ ও প্রোথিতযশা ব্যষ্টিরা এই আগ্ণেয়াস্ত্রের গণ লাইসেন্স দেওয়ার বিরুদ্ধে  সরব ও সক্রিয় হয়েছেন৷  একইভাবে আমাদের দেশসহ সমগ্র পৃথিবীতে  এই শিশু নিপীড়ন, অত্যাচার , নিগ্রহ ও শোষণের বিরুদ্ধে সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে অঙ্গীকারবদ্ধ  হতেই হবে, তবেই শিশুর ভবিষ্যত ও শৈশব সুরক্ষিত থাকবে৷

শিশু সুরক্ষার জন্যে বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে  এগিয়ে আসতে হবে ও বয়স নির্বিশেষে সকলের চরিত্র নির্র্মণের জন্যে   যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে৷ চরিত্র বলিষ্ঠ করতে হলে নীতিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার সংস্পর্শে মানুষকে নিয়ে আসতেই হবে৷  আধ্যাত্মিকতা ছাড়া নীতিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ও সম্যক চরিত্র নির্র্মণও  অসম্ভব৷ তাই শৈশবাবস্থা থেকে প্রত্যেককে আধ্যাত্মিকতার আদর্শে  গড়ে তুলতে হবে৷ শিশুদের মন অত্যন্ত সুসংবেদী ও নরম কাদার মতো৷ তাই এই শিশুমনকে অধ্যাত্মবাদের সুন্দর পরিবেশে সুকুমার কোমল বৃত্তিগুলির অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষরূপে  গড়ে তুলে দেশ, জাতি তথা পৃথিবীর সুসম্পদে পরিণত করতে হবে ও আজকের কল্যাণকামী মানুষের সামনে  এটিই  সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷