বিশ্বের সব মানুষের ধর্ম এক

লেখক
প্রভাত খাঁ

আজ বলা হয় যে অত্যাধুনিক যুগে মানুষের সমাজ এসে পৌঁচেছে৷ সত্যই কি মানুষের সমাজ গড়ে উঠেছে? আর সত্যই কি মানুষ অতি আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে? যদি সত্যই মানুষের সমাজ অতি আধুনিক যুগে পৌঁছাতো তা হলে এতো ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ, নরহত্যা হ’ত না৷

মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য–এ কথাটি যেমন অতীব সত্য, ঠিক তার পাশাপাশি দেশ কাল পাত্রের পরিবর্ত্তনের সাথে সংগতি রেখে ও ভৌগোলিক পরিবেশের তারতম্য অনুসারে তাদের আচার, ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্যও আছে তাকে মান্যতা দিতেই হয়৷ তাই তো বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য৷

যদি সত্যই এটা অত্যাধুনিক যুগ হয় তা হলে সকল মানুষকে মেনে নিতেই হবে যে অনেক পার্থক্যের মধ্যে মানব সমাজ অবশ্যই এক অবিভাজ্য৷

পৃথিবীর সকল ‘মা’ একই ভাবে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন ও তাকে মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে স্নেহ মমতা দিয়ে প্রতি পালিত করেন৷ সেখানে কোন ভেদ নেই৷ পাশাপাশি জন্মদাতা পিতা কঠোর পরিশ্রম করে স্ত্রী পুত্র, কন্যাদের লালন পালন করে থাকেন৷ তাই প্রতিটি পিতা মাতাকে মানব ধর্ম পালন করে চলতে হয়৷

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ তাই তো বলা হয় সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই৷ মানুষই কেবল মাত্র তার বিবেক চৈতন্যের দ্বারা, মানবিক মূল্যবোধের দ্বারা, সূক্ষ্মতম অধ্যাত্ম অনুভূতির দ্বারা সৃষ্টির রহস্যকে জানতে পারে৷

তাই তো মানুষের সমাজে যুগে যুগে দেশে দেশে আধ্যাত্মিক মহান পুরুষদের আবির্ভাব ঘটেছে মানুষের সমাজকে আদর্শের পথ দেখাতে৷ মানুষ তো পশুর চেয়ে অনেক উন্নত প্রাণী৷ তার ঐশী শক্তির বিকাশের সম্ভাবনা থাকায় সেই মহান পুরুষেরা তাদের জীবনে আদর্শ ও লক্ষ্যের পথ দেখিয়ে গেছেন৷ সেই পথ–প্রদর্শকগণ প্রায় একই কথা বলে গেছেন৷ তাদের প্রদত্ত পথে কিন্তু কোন সংকীর্ণতা নেই৷ সেই বিরাটের ভাবনাকেই তাঁরা বার বার তুলে ধরেছেন৷ সেটাই তো সেই ঈশ্বরের বাণী হিসাবে খ্যাত৷

জগতের সব কিছুরই উৎস সেই বিরাট সত্তা, সেই মহান স্রষ্টাকে বিভিন্ন ভাষায় নাম দেওয়া হয়৷ তিনিই ঈশ্বর, ব্রহ্ম, আল্লাহ ও গড৷ আমরা সবাই তাঁরই সন্তান৷ আমাদের ধর্ম তাই এক৷ সেটি হলো সনাতন ধর্ম৷ এই সনাতন ধর্ম এর কোন দ্বিতীয় সত্তা বা রূপ নেই৷

আমাদের শরীরই হলো মন্দির৷ এই মন্দিরে সেই সনাতন ধর্মের অনুশীলন করতে হয়৷ তাই তো বলা হয়

‘‘ইদং তীর্থং ইদং তীর্থং ভ্রমন্তি তামসাঃ জনাঃ

আত্মতীর্থং ন জানন্তি কথং মোক্ষ বরাণনে৷৷’’

মানুষ সেই সনাতন ধর্মের ওপর বিভিন্ন খন্ড মত ও গোঁড়ামীকে চাপিয়ে তাকে নানা মতবাদে শৃঙ্খলিত করে  চলেছে৷ বিভিন্ন নামে সাম্প্রদায়িক মতবাদ হিসাবে প্রচার করে চলেছে৷ একেই বলে ধর্মমতের নামে গোঁড়ামী ও ভন্ডামী৷ কাজী নজরুল তাই বলেন –

‘‘হিন্দু না ওরা মুসলীম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার৷’’

আজ তাই সকল চিন্তাবিদ মুক্তিকামী মানুষকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে যুক্তির উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলতে হবে৷ আজ পৃথিবীকে মানুষের বাসের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছেন মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ তিনি ঘোষণা করেছেন ‘মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷’ জড়তা, কুসংস্কার মুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধর্মমতের বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে সেই এক মানবধর্ম সনাতন ধর্মকে জীবনের ধ্রুবতারা রূপে গ্রহণ করে জাত পাতের ঊর্ধ্বে উঠে এগুতে হবে৷ পৃথিবীর বুকে নব্য মানবতাবাদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মানবধর্মকে জীবনের ধ্রুবতারা রূপে গ্রহণ করে সকলকে এক সঙ্গে চলতেই হবে৷ এ ছাড়া পৃথিবীর বুকে মানব সমাজ গড়ে তোলার অন্য কোনই পথ নেই৷ মানব শিশু যখন মাতৃগর্ভ হতে জন্ম নেয় এই মাটির পৃথিবীতে তখন সে কোন সম্প্রদায়ই চিহ্ণিত হয় না৷ সেই শিশু এক পবিত্র মহান মানব শিশু৷ তাকে যদি জন্ম সূত্র হতে উপযুক্ত শিক্ষায় আচার আচরণে বড় করা হয় তা হলে সে অবশ্যই এক সংস্কার মুক্ত দেবশিশু হিসাবে মানুষ হবে৷ মানুষ আরোপিত সংস্কারের জালে তাকে বেঁধে ফেলে তাই সেই শিশু বড়ো হয়েও সংস্কার মুক্ত হতে পারে না৷ তাই বর্ত্তমানে যে অত্যাধুনিক যুগ চলছে এই যুগে প্রতিটি মানুষকে এক একজন সংস্কার মুক্ত বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে হবে৷ আজ পৃথিবীতে চরম অভাব হলো উপযুক্ত মানবতাবাদী মানুষের৷ মানব সমাজ ভাবজড়তার ঊর্ধ্বে উঠে যেন যুক্তিবাদী মানবতাবাদীদের সার্থক বাসস্থান হয়ে ওঠে৷ এই মহান উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী জগৎ কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন৷