বিষ্ণুর আবাস

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

শাস্ত্রে পরমপুরুষের একটি নাম ‘বিষ্ণু’৷ সংস্কৃত ‘বিশ্’ (প্রবেশ করা) ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘বিষ্ণু’ শব্দের অর্থ হ’ল ব্যাপনশীল অর্থাৎ যিনি প্রতিটি সত্তার ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন৷ অসীম অনন্ত অখণ্ড সর্বগ সর্বব্যাপী এই সত্তার জন্যেই বিশ্বের অন্যান্য খণ্ড সত্তাগুলো টিকে রয়েছে৷ জল না থাকলে যেমন মাছ থাকতে পারে না তেমনি পরমপুরুষ ছাড়া জীবও বাঁচতে পারে না, কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না৷ বস্তুতঃ তাঁর অস্তিত্বের জন্যেই সব কিছু অস্তিত্ববান৷ তবে একথাও ঠিক যে তিনি কোথাও প্রকট, কোথাও অপ্রকট৷

শাস্ত্রে আছে, দেবর্ষি নারদ নাকি একবার বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–হে প্রভু, তুমি তো সর্বত্রই আছ৷ তবে সব জায়গাই তোমার পছন্দমত নাও হতে পারে৷ আমার জানার খুব আগ্রহ তোমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান কোন্টি? ভক্তিশাস্ত্রে আছে, তার উত্তরে বিষ্ণু বলেছিলেন–

‘‘নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে

            যোগিনাং হৃদয়ে ন চ৷

মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি

            তত্র তিষ্ঠামি নারদ৷

বলছেন–হে নারদ, আমি বৈকুণ্ঠেও থাকি না, যোগীদের হৃদয়েও থাকি না৷ আমার প্রিয় স্থল সেইটা যেখানে আমার প্রিয় ভক্তরা প্রাণ খুলে আমাকে স্মরণ করে ভজন–কীর্ত্তন করছে৷

পরমপুরুষ বৈকুণ্ঠেও থাকেন না, যোগীদের হৃদয়েও থাকেন না–ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে পুরাণে বৈকুণ্ঠই সবচেয়ে উঁচু জায়গা৷ সেখানটাই তো তাঁর থাকবার কথা৷ তবু বলছেন–সেখানে তিনি থাকেন না৷ এই যে বৈকুণ্ঠ বা গোলোক, এই তথাকথিত বৈকুণ্ঠ বা গোলোক বলে কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই৷ তবে ‘বিগতা কুণ্ঠা যস্মিন্’ এই অর্থে বৈকুণ্ঠও হয়৷ কুণ্ঠা মানে সংকোচন (contraction)৷ এই অর্থে বৈকুণ্ঠ মানে ভক্তের হৃদয়৷ পরমপুরুষকে স্মরণ করে ভক্ত নাচ–গান, হাসি–কান্নায় মেতে ওঠে৷ তার লজ্জা–শরম, কুণ্ঠা–জড়তার লেশমাত্র থাকে না৷ বৈকুণ্ঠের এই অর্থ নিলে পরমপুরুষ অবশ্যই সেখানে থাকেন৷ বৈকুণ্ঠ বলে ত্রিভুবনে কোথাও কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই৷ পরমপুরুষের খোঁজে বৈকুণ্ঠ নামধেয় কোন স্থানে যাবার দরকার নেই৷

বর্তমান সভ্যতায় একটা মেকি ভাব, একটা কৃত্রিমতার বেশ প্রচলন আছে৷ এখানে সুখ–দুঃখ, হাসি–কান্না, লজ্জা–শরম রেখে ঢেকে প্রকাশ করতে হয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়৷ তাই সকল মানুষের হৃদয় বৈকুণ্ঠ নয়৷ যোগীদের ব্যাপারটা কী? ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’৷ সমস্ত চিত্তবৃত্তিকে নিরুদ্ধ করাই যোগের প্রক্রিয়া৷ এই ধরনের অর্থ নিলে যোগীর হৃদয়–দুয়ার তো বন্ধ৷ পরমপুরুষ তাতে ঢুকবেন কী করে?  তাই বলছেন, ‘‘যোগিনাং হৃদয়ে ন চ’’৷ পরমপুরুষের প্রতি প্রেম–ভালবাসা না থাকলে সে হৃদয় তো নীরস৷ তাই সেই শুষ্ক্ কঠোর হৃদয়ে পরমপুরুষ অধিষ্ঠান করেন না৷ পরমপুরুষের সবচেয়ে প্রিয় অধিষ্ঠান–স্থল ভক্ত হৃদয় যেখানে ভক্ত হেসে খেলে নেচে গেয়ে তাঁর প্রিয় হরিকে আকুল হৃদয়ে ডাকছেন৷ আর যেখানে ভক্ত ও ভগবান ছাড়া তৃতীয় কোন সত্তার অস্তিত্ব নেই, সেখানে লজ্জা–কুণ্ঠার অবকাশ কোথায়

তিন ধরনের ভক্তের সন্ধান মেলে৷ এক ধরনের ভক্ত ভাবে– পরমপুরুষ সবাইকার, তিনি সর্বত্র বিরাজ করেন৷ আর যেহেতু আমি এই সবাইকার মধ্যে একজন আর এই জগতের মধ্যে রয়েছি, তাই পরমপুরুষ আমারও৷ এরা খুব বড় ভক্ত নয়৷ আরেক ধরনের ভক্ত দেখতে পাই, যারা বলে–ভগবান আমার ও সেই সঙ্গে অন্যান্য সকলেরও৷ এও খুব উঁচু ধরনের ভক্তি হ’ল না৷ আরেক ধরনের আছেন যাঁরা বলেন–পরমপুরুষ কেবল আমারই, আমার বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি৷ আমি কারো সঙ্গে এই সম্পত্তির ভাগ–বাঁটোয়ারা করতে চাই না৷ মনে রাখতে হবে, পণ্ডিত ও পুস্তকের মধ্যে বৈকুণ্ঠ নেই, সেখানে ঈশ্বর বিরাজ করেন না৷

ভক্তদের একটি পৃথক জগৎ আছে৷ বিশ্বের সমগ্র ভক্ত–কুলের সেখানে জায়গা৷ তাদের মধ্যে কোন ভেদরেখা, কোন কৃত্রিম গণ্ডি নেই৷ জাতিভেদ, কুলভেদ, বর্ণভেদ, দেশভেদ–সমস্ত ভেদরেখার ঊর্ধ্বে সে জগৎ৷ তার নাম ‘হরিপরিমণ্ডল’৷ যাতে সবাই সেই হরিপরিমণ্ডলের সদস্য হতে পারে তাই সকলেই চেষ্টা করুক৷ এই হরিপরিমণ্ডলের মধ্যমণি হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ তাঁর মধুর ভাবধারাতেই সকলে হাসে কাঁদে নাচে গায়৷ সেই ভাবসমুদ্রে বা রসসমুদ্রের মধ্যেই চলছে পরমপুরুষের রাসলীলা৷ এই রাসলীলাতে অংশগ্রহণ করাতেই মানবজীবনের সার্থকতা৷ এই বৈকুণ্ঠ থাকলেই সব থাকবে৷

কোথায় এই বৈকুণ্ঠ ব্রজের সেই ভক্তমণ্ডলীর, সেই সহজ সরল গোপীদের কাহিনী জান তো৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার অসুস্থতার ভান করলেন৷ কোন ওষুধে কৃষ্ণের রোগের উপশম হচ্ছে না৷ নারদ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–প্রভু, বলুন কী করে আপনার রোগ সারতে পারে? কৃষ্ণ বললেন–দেখ নারদ, যদি কোন ভক্তের পায়ের ধুলো আনতে পারো তবেই আমার এই মাথাব্যথা সারবে৷

নারদ ভক্তপদরজের সন্ধানে সর্বত্র ঘুরলেন৷ কিন্তু যেখানেই গেলেন সেখানেই নারদের প্রস্তাব শুণে সবাই, এমনকি বড় বড় তাগড়া তাগড়া ভক্তরাও বললেন, ‘‘নারদ, একথা শোণাও যে পাপ৷ ভগবান আমাদের পরম আরাধ্য৷ তাঁর মাথায় লাগাবার জন্যে আমরা পায়ের ধুলো দিতে পারি–এ যে কত বড় ধৃষ্টতা, ভাবাই যায় না৷’’

শেষ পর্যন্ত নারদ ব্রজের গোপীদের কাছে গেলেন৷ প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, ‘গোপ্’ বা ‘গোপী’ শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘গোপ’ ধাতু থেকে৷ ‘গোপ’ ধাতুর অর্থ আনন্দ দেওয়া৷ গোপায়তে যঃ সঃ গোপঃ অর্থাৎ ভগবানকে যে আনন্দ দেয় বা দিতে পারে সে গোপ বা গোষ্ঠী৷ ভগবানকে দেওয়ার নামই ভক্তি৷

যাই হোক, গোপীরা নারদের কথা শুণেই পদধূলি দিতে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেল৷ নারদ বললেন, ‘‘তোমরা যে পায়ের ধুলো দিচ্ছ ভগবান এই ধুলো যখন মাথায় দেবেন তখন তোমাদের পাপ হবে না’’ গোপীরা অকুণ্ঠচিত্তে জবাব দিল, ‘‘পাপ হয় হোক ঠাকুর, আমাদের প্রভুর অসুখ তো সেরে যাবে৷ প্রিয় প্রভুর জন্যে আমরা সব পাপ সহ্য করতে রাজী’’৷ একেই বলে প্রকৃত ভক্তি৷ এই ধরনের প্রকৃত ভক্তহৃদয়ই বিষ্ণুর আবাসস্থল৷

৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭১, কলিকাতা