বন্ধু হে, নিয়ে চলো.......

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

বর্তমান পৃথিবীর এক সংকটময় মুহূর্ত্তে মানব সভ্যতা যখন ক্রমশঃ মর্র্মন্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে, চতুর্দিকে অস্ত্রের ঝনঝনি, রাসায়নিক-পারমানবিক অস্ত্রের বিষবাষ্প, মানুষের লোভ, অহংকার ও বর্বরতা বিশ্বপিতার সুন্দর সৃষ্টি পৃথিবীর সর্বনাশে উদ্যত--- এই যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার মানব সমাজের কল্যাণে প্রদান করলেন যুগান্তকারী ‘‘প্রভাত সংগীত’’ যার প্রথম গানটি রচিত হল ১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর দেওঘরের মনোরম প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে ঃ

 ‘‘বন্ধু হে নিয়ে চলো,

আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷৷

আঁধারের ব্যথা আর সয় না প্রাণে৷৷

ঘুমের ঘোর ভাঙ্গানোর গানে গানে৷৷’’

এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কেউ একা থাকতে পছন্দ করে না---শুধু তাই নয়, কেউ একা থাকতে পারেও না৷ জীবন ধারণের প্রতিটি পর্র্যয়ে মানুষ , জীব, জন্তু উদ্ভিদ সকলেরই অপরের সাহচর্য, সাহায্য ও সহযোগ প্রয়োজন৷ জীবন পথে চলার সময় মানুষ বা মনুষ্যেতর সকলেরই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা অন্তরের আকুতি-অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়ার জন্যে অন্ততঃ অপর একজনের প্রয়োজন৷ সেই একজনই হ’ল তার বন্ধু, যে সর্বদাই সঙ্গে থাকবে৷ কিন্তু নশ্বর এই পৃথিবীতে কোন মানুষ বা অন্য কেউ চিরস্থায়ী নয়৷ পিতা-মাতা ভাই-বোন আত্মীয়-পরিজন অল্প কিছুদিন সঙ্গ দিলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী৷ বরং স্বার্থের সংঘাতের কারণে যে কোন সময় একজন পরম বন্ধু বা আত্মীয়ও শত্রুতে পরিণত হয়ে যেতে পারে৷ তাই পরমপিতা পরমাত্মাই একমাত্র চিরস্থায়ী বন্ধু হতে পারেন কারণ যে কোন সৃষ্ট সত্বার জন্মের পূর্ব থেকেই তিনি মাতৃস্তনে দুগ্দ ও প্রকৃতির বুকে আবশ্যকীয় খাদ্য সম্ভার সঞ্চিত করে রাখেন৷ তিনিই পরম যত্নে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি মানুষ, জীব-জন্তু, উদ্ভিদের দেহ-সংরচনা, শারীরবৃত্তীয় কর্মবিন্যাস, জীবনের প্রতি পদ বিক্ষেপের প্রয়োজনানুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ -ভান্ডার এমন নিখঁুতভাবে সুবিন্যস্ত করে রেখেছেন যা বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের চরমতম উন্নত মেধা শক্তির প্রয়োগেও সম্ভব নয়৷ সুতরাং সমগ্র বিশ্বের সুখ-দুঃখের সাথী ও সকলের মঙ্গলের জন্যে সর্বদা তৎপর পরমপিতাই প্রত্যেকের নিত্যসঙ্গী ও চিরন্তন প্রকৃত বন্ধু৷ প্রভাত সঙ্গীতের প্রথম গানটিতে সেই বন্ধুকে উদ্দেশ করেই প্রার্থনা ও আন্তরিক কামনা জানানো হয়েছে, যেন তিনি সকলকে সার্বিক অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে চলেন৷ আর সেই আলোকের ঝর্র্ণধারায় সকলে উদভাসিত হয়ে শুদ্ধ, পবিত্র ও আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারে৷

সৃষ্টিচক্রের প্রতিসঞ্চর ধারায় জড়ত্বের ঘনান্ধকার থেকে জড়ষ্ফোটের মাধ্যমে প্রথম জীবনের উন্মেষ ও আলোর পথে প্রথম পদবিক্ষেপ৷ পরবর্ত্তী পর্র্যয়ে এককোষী থেকে বহুকোষী জীব, উদ্ভিদ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ পশু-পক্ষীর স্তর পেরিয়ে বিবর্ত্তনের ধারা বেয়ে আধুনিক মানবের উত্তরণ৷ মনুষ্যদেহ প্রাপ্তির প্রাক্-মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টি -প্রবাহ স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ক্রমবিবর্তনের স্তর অতিক্রম করেছে ভূমাসত্ত্বার আমোঘ আকর্ষণে৷ অবশেষে মানবাধারের সঙ্গে সে পেয়েছে একটি বিচারশীল মন৷ সেই কারণে মানুষকে বলা হয় মন-প্রধান জীব৷ অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে দেহধারণ, অস্তিত্ব রক্ষা ও বংশবিস্তার ইত্যাদি কর্মকান্ডের মধ্যেই জীবনচক্র সীমাবদ্ধ৷ প্রথম দিকের সৃষ্ট মানুষের মধ্যেও পাশবিকবৃত্তির দেহসর্বস্বতাই ছিল প্রকট৷ তারপর দিন যত গড়িয়েছে, মানুষের দেহে মনে পরিবর্ত্তন এসেছে অনেক ---ক্রমে ক্রমে দেহের উপর মনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, বিচারশীলতা ও বিবেকপ্রবণতার বিস্তার ঘটেছে , ভালমন্দের প্রভেদ বুঝতে শিখেছে৷ আজকের মানুষের একদিকে রয়েছে জন্ম জন্মান্তরের নিম্নস্তরীয় পশুজীবনের পরিচিত আকর্ষণ, অন্যদিকে এক আলোকোজ্জ্বল  উন্নত জীবনের  হাতছানি৷ একদিকে রিপু-পাশ-বৃত্তির সংস্কারাত্মক অন্ধকার, অপরপক্ষে মায়া, মমতা স্নেহ, দয়া, ক্ষমা, প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি শুভগুণাবলীর আলোকদীপ্ত বিচ্ছুরণ৷ অশুভবৃত্তিগুলির তাড়নায় লোভ, লালসা, হিংসা, হীন স্বার্থপরতা, মিথ্যা দম্ভ, কাম-ক্রোধ মানুষের জীবনকে পরিচালিত করেছে অন্ধকারময় পঙ্কিল আবর্ত্তের দিকে৷ ব্যষ্টিগত জীবনের অন্ধতমসা সমাজ জীবনেও চরম পঁুতিগন্ধময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে৷ ক্ষুদ্র ব্যষ্টিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে লোভী মানুষেরা সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনতেও দ্বিধা করছে না, অন্যদের বঞ্চিত করে নিজের ঘরে সম্পদের পাহাড় জমাচ্ছে৷

সামান্য লাভের আশায় খাদ্য ফল- মূল-শাক-সব্জি, পানীয়,ঔষধ, নির্র্মণ সামগ্রী প্রভৃতি অতিপ্রয়োজনীয় বস্তুতে ভেজাল ও ক্ষতিকর  রাসায়নিক মিশিয়ে আবাল -বৃদ্ধ-বণিতাকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ,প্রাকৃতিক সম্পদ-ধবংস, বায়ু জল পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্ব-উষ্ণায়ণ, জলবায়ুর পরিবর্ত্তন, হিমবাহের তরলীভবন ইত্যাদির পরিণামে ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের হ্রাস, ভূপৃষ্ঠস্থ জলের দূষণ-বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অকাল বর্র্ষ, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, অস্বাভাবিক বজ্রপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তরবৃদ্ধি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা কোটি কোটি মানুষের ক্ষতিসাধন করে চলেছে৷ এছাড়া যুদ্ধবিগ্রহ,পারমাণবিক-রাসায়নিক মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় সন্ত্রাস, হিংসা, খুন-রাহাজানি, যৌন-নির্র্যতন-ধর্ষণসহ বহুবিধ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের মধ্যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও ভাবজড়তার অন্ধকার৷ পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই নূ্যনতম প্রয়োজন যথা খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ কোটি কোটি মানুষ রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে , গাছের তলায়, সেতু , উড়ালপুলের তলায় শীত-গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতার মধ্যে অনাহারে অর্র্ধহারে দিনযাপন করে৷ পৃথিবীর মানুষের এই যে সামগ্রিক শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের সর্বগ্রাসী অন্ধকার---ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে কুপ্রবৃত্তির প্রভাবজনিত তমসা থেকে সত্য, ন্যায় , ধর্ম, সামাজিক সুবিচার সমৃদ্ধ আলোকময় জীবনের প্রতি প্রধাবিত হওয়ার আকুতিই প্রভাতসঙ্গীতের প্রথম গানের মূল উপজীব্য৷ মানুষ মনপ্রধান বিবেকবান জীব৷ ভাল-মন্দের বিচার করে তাকেই প্রকৃত কল্যাণের পথে এগিয়ে চলতে হবে৷ প্রবৃত্তিমূলক অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ পরিহার করে নিবৃত্তিমূলক সত্য, ন্যায় ও ধর্মের পথে দৃঢ়তার সঙ্গে পদসঞ্চার করতে হবে৷ প্রভাত সঙ্গীতের প্রথম গানে এই আলোর পথে চলার আত্যন্তিকী আগ্রহই পরমবন্ধু পরমব্রহ্ম পরমমঙ্গলময়ের উদ্দেশে প্রার্থনাতে মূর্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে৷  (ক্রমশঃ)