ভারতবাসীর মোহ নাশ ঘটবে কবে?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

১৯৪৭ সালে বছরের মাঝামাঝি পার হয়ে এসে ভারত ব্রিটিশশাসনের নাগপাশ তথা সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী বন্দী দশা থেকে মুক্তিলাভ করেছিল৷ তবে, যেহেতু অতটুকু মুক্তি পেতে গিয়েই বহু বছর ধরে লাখো লাখো ভারতবাসীকে শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক---সকল দিক থেকেই অপারিমেয় মাত্রায়  দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল৷ অনশনে, অর্ধাশনে অসংখ্য মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে নিজেদের শঁপে দিতে হয়েছিল৷ স্বাধীনতার দাবী নিয়ে আন্দোলন চালাতে গিয়ে হাজার হাজার প্রাণ বলি হয়েছে, দ্বীপান্তরে নির্বাসনে যেতে হয়েছে---ব্রিটিশের বুলেটের ঘায়ে মরণকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে---কাউকে বা আহত হয়ে পঙ্গুত্বকেও বরণ করতে হয়েছে সারাজীবনের মতো৷ মাতৃভূমিকে বিদেশীর পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে গিয়ে অনেক বিপ্লবীদের হাসি মুখে ফাঁসীর দড়িকেও কুর্ণিশ জানাতে হয়েছে আবার কেউ কেউ বা কারাগারের নিঝুম অন্ধকারে বর্বরোচিত অত্যাচারের ফলেও চিরবিদায় নিতে হয়েছিল পৃথিবী থেকে৷ অর্থাৎ মোদ্দা কথাটা হল---দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে গিয়ে, দেশবাসীকে একটা স্বাধীন জাতিরূপে খোলা হাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস টানা সুযোগ এনে দিতে হয়েছিল--- দুর্লভ মানবজীবনের  সাধ-স্বপ্ণ চিরতরে বিদায় জানিয়ে৷ কবিবর নজরুলের ভাষায় --- ‘‘ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান/আসি ’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তাঁরা দিবে কোন্‌ বলিদান?’’

বলিদান দিতে হবে আমাদের? আমরাই দেব বলিদান? হায় কবি, ভারতবর্ষের পূণ্যভূমিতে জন্ম নিয়েও আপনি বোধ হয়, এদেশের সকল মানুষকে চিনে নিতে পারেন নি বলেই যুক্তিহীন অনুরূপ প্রশ্ণটি রেখে গেছেন৷ আমার এ মন্তব্যের উল্লেখ রাখতে গিয়ে যে অর্বাচীন-সুলভ স্পর্ধা দেখাবার  দুর্বিনীত মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে বাধ্য হলুম সেজন্যে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে নিচ্ছি৷ আমার এই স্পর্ধাকে স্পর্ধারূপে বিবেচনা না করে যদি ব্যথিত হৃদয়ের অব্যক্ত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ বলে কবি বা তাঁর শ্রদ্ধাভাজনদের  বোঝাতে পারি, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব৷ প্রশ্ণ থেকে যায়--- কেন এই ক্ষোভ৷ ক্ষোভের  সবচেয়ে বড় কারণ  একটাই৷ আশা করি, অনেকেরই হয়তো মনের গভীরে পুষে রাখা অব্যক্ত বেদনা আমারই মত ঘুষঘুষে আগুন হয়ে জ্বলছে একই কারণে৷ সেই কারণও আর কিছুই নয় এত ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্ততর্পন জীবন উৎসর্গের  বিনিময়ে অখণ্ড ভারতবর্ষকে ‘ভারত’ তথা ইন্ডিয়া আর ‘পাকিস্তান’ নামের আড়ালে যে খণ্ডীকরণ করা হয়েছিল ও তাছাড়া শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থাৎ আপামর সাধারণ ভারতবাসীদের বোট-প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দূরে থাকুক, নেহাৎ মানুষরূপে বাঁচারও অধিকার দেওয়া হল না৷ তদুপরি এত বড় একটা অমার্জনীয় হঠকারিতাকে ‘‘স্বাধীনতা’’ বলে ঘোষণা ভারতবাসীকে জানান দেওয়া হয়েছিল আর নির্বিবাদে সেদিন ভারতবাসীমাত্রেই মেনেও নিয়েছিলেন, এরপরেও সেই দেশটার সেই জনতার কাছ থেকে কোনরূপ ‘‘বলিদান’’ দেবার বা পাবার প্রত্যাশা কীরূপে ‘‘কাঙ্খিত’’ হতে  পারে? সামান্য একটি মাত্র দৃষ্টান্ত আমার যুক্তির  সপক্ষে এখানে তুলে ধরছি৷ ক্ষুদিরাম বা প্রীতিলতার মত যাঁরা হাসিমুখে প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন, এর পরে স্বাধীনোত্তর ভারতে যাঁরা মন্ত্রীত্বের জন্যে ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা দখলের জন্যে অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ  খতিয়ে নিতে সাধারণ দেশবাসীর রক্ত তথা প্রাণশক্তি নিংড়ে নিচ্ছেন, এ ধরণের  কারোর পক্ষেই কী সম্ভব ক্ষুদিরাম বা প্রীতিলতা প্রমুখদের মত উন্নত মন আর বলিষ্ঠ চরিত্রের প্রমাণ উপস্থাপিত করা? না---সেটা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ রেখে চলেছে৷ নেতাজীর মতো মহান ত্যাগবীর, তেজস্বী, নিষ্কলূষ দেশপ্রেমিক ও নিখুঁত চরিত্রের মানুষটির কার্যকাহিনী ও তাঁর জীবন-রহস্যই প্রমাণ করে চলেছে, যে  গোবরে পদ্ম ফুল ফোটে  সেই গোবরেই পোকারাও থাকে৷ আজ বুঝতে আদৌ অসুবিধার কথা নয় --- সক্রেটিসকে কেন বন্দীশালায় হেমলক বিষ পান করতে হয়েছিল কংসই বা কেন শ্রীকৃষ্ণ হত্যার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ জন্মদাত্রী দৈবকী দেবীর উপর জুলুম চালিয়েছিল ব্রিটিশ যদিও তাদের বিদেশী শত্রু বলে নেতাজীকে ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘যুদ্ধপরাধী’ ঘোষণা দিয়ে সন্ধান জারি রাখলেওে বর্তমান ভারত সরকারও সেই পথ ধরেই নেতাজী-বিরোধীতায় ন্যুউজ হয়ে রয়েছেন৷

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি তথা  মতিগতি ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা নিরিখে খুবই আশঙ্কার  কারণ দেখা দিয়েছে৷ বিগত প্রায় সাড়ে সাত দশক কাল ধরে ,‘গণতান্ত্রিক ভারত’, ‘প্রজাতান্ত্রিক ভারত, ‘সমাজতান্ত্রিক ভারত’, ‘জোট-নিরপেক্ষ ভারত’, সূদূর অতীতের ‘গোল্ডেন পিজিয়ান ভারত’, শান্তিলাভের উদ্দেশ্যে দ্বিখণ্ডিত ভারত, ‘ভারত মহান’, ‘ভারত মাতা’, অচ্ছা ভারত, স্বচ্ছ ভারত, ডিজিটাল ভারত, ক্যাশলেশ ইন্ডিয়া, শাইনিং ইন্ডিয়া, রাইজিং ইন্ডিয়া--- এসবের কোনটাতেই কিন্তু নিম্নবিত্ত,নিম্নমধ্যবিত্ত, স্বপ্ল ও সীমিত আয়-বিশিষ্ট, বুভুক্ষু, অনশন বা দেশে-বিদেশে পরিযায়ী বুদ্ধিজীবী শ্রমিক ও গায়ে-খাটা মেহনতি মানুষজন অজ্ঞ-নিরক্ষর, অবহেলিত-দলিত ভিক্ষাজীবী--- প্রমুখ ভারতবাসীর জীবনে কোনদিনই এতটুকু বাঁচার নিরাপত্তা বা অস্তিত্বরক্ষার নিশ্চয়তা আসে নি৷ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাণ-বিসর্জন আর দেশের এগিয়ে চলার নিমিত্ত, যারা খাদ্য-বস্ত্র তথা ভরণ-পোষণের কাজে--- সে চাষের জমিতেই হোক কিংবা কারখানায়ই হোক অকাতরে শ্রম বিলিয়ে যাচ্ছেন তাদের জীবন নিয়ে যারা ১৯৪৭-এর পর থেকে জুচ্চুরি ও জুলুমবাজি চালিয়ে যাচ্ছেশিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধি-জনপরিষেবা---আইন কানুন সহ নীতি-শৃঙ্খলপরায়ণতা ও বিচার ইত্যাদি নিয়ে প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিচারের কী হবে? কবে হবে? সর্র্বেপরি দেশ-শাসনের অছিলা করে  যারা চলমান গণতন্ত্রের পরিকাঠামোকে হাঁড়িকাঠ বানিয়ে, দেশের  ও বিদেশের পুঁজিবাদী চক্রকে অর্থাৎ ক্যাপিটালিষ্ট, করপোরেট মালিকানা সমূহকে মুনাফাখোর, মজুতদার, শোষক ও তাদের দালালগোষ্ঠী ও আমলাদের, আর তাদেরই পোষা ক্যাডার-মাফিয়াদের দেবতার আসনে বসিয়ে আপামোর সাধারণ -শ্রেণীর দেশবাসীদের বলি চড়াচ্ছেন--- সেই ‘বর্ণচোরা মানিক’ মুখে যারা কখনও মিষ্টি কথা বলে, কখনও অনুনয়-বিনয়ের চরম পরকাষ্ঠা দেখিয়ে আবার কখনও রুদ্রমূর্ত্তি ধারণ করে রক্তচোখ  বিস্ফারিত করে ছাতি ফুলিয়ে  ঘাড় গর্দান প্রদর্শন পূর্বক যারা নির্ভয়ে নির্বিবাদে---মামদোবাজি করেই চলেছেন--- সেই তাদের  নিয়ে যে গভীর  মোহজাল দেশবাসীদের  মনে অটুট রয়েছে সেই জাল ছিন্ন হবে কবে?

দেশবাসীদের অন্ধমোহনাশ ঘটতেই হবে ও ঘটাতেও হবে৷ নতুবা ভবিষ্যৎ কিন্তু অশুভেরই অশনিসংকেত দিতে শুরু করেছে৷ সময় প্রত্যাসন্ন৷ কেননা, অন্নচিন্তা চমৎকারা৷ বাঁচা-বাড়ার জন্যেই মানুষ একদিন সমাজ রচনার কথা ভেবেছিল, শান্তি-স্বস্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়মশৃঙ্খলা, আইন-আদালত,সরকার -সংবিধান, রাজ্য-রাষ্ট্র দেশ প্রজা ইত্যাদি গড়ে তোলার স্বপ্ণ দেখেছিল৷ তারা তাদের সুস্থ মস্তিষ্কে কোনদিনই মেনে নিতে পারবে না যে, ১৩০ কোটি মানুষের দেশে নির্দিষ্ট কোন ব্যষ্টিবিে?র একমিনিটের উপার্জন দেশেরই একজন রেগা শ্রমিকের কিংবা কোন বিপিএল-ভুক্তের দু-বছরের উপার্জনের সমান  হোক বলে সেটি আর ‘অদৃষ্টের লিখন’’ বলে মেনে নিতে হবে৷ সুতরাং মনে হচ্ছে, আমাদের অচলায়তন--- বর্তমানের এই সমাজ-ব্যবস্থা, দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিরিখে এক সুপ্ত-আগ্ণেয়গিরি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যে কোন মুহূর্তে এর সুপ্তিভঙ্গ হয়ে যেতে পারে মোহনাশ ঘটে গেলেই বা বিভ্রান্তির রেশ কেটে গেলে৷ আর সেই  মুহূর্তটা হবে অতি ভয়াবহ তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই৷ শুধু সময়ের  অপেক্ষা মাত্র৷ কারণ, চিরদিন কারও সমান যেতে পারে না৷ ‘‘দুঃখানি সুখানি চ চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে৷’’ রাত যতই গভীর হোক আর অমানিশির আঁধার  যত নিশ্ছিদ্র হোক, ঊষার  আগমন অনিবার্য বলেই কেউ আটকাতে পারে না৷ বর্ষায় আকাশের রোদন যেমন স্বাভাবিক তদ্রূপ গ্রীষ্মের খরতাপে মাটির চৌচির হওয়াটাও স্বাভাবিক কিন্তু!

(আগামী সংখ্যায়)