ভারতে বিপন্ন বাঙালী

লেখক
এইচ.এন. মাহাত

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৪ বছর অতিক্রান্ত৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সব থেকে বেশী যারা আত্মত্যাগ করেছে, স্বাধীনতার বেদিমূলে জীবন  উৎসর্গ করেছে, স্বাধীন ভারতে সেই বাঙালী জাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন৷ স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই বাঙালী ভারতে বৈষম্যের শিকার৷ কারণ আর কিছুই নয়, বিদেশী বেনিয়া স্বদেশী বণিকের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশ ছেড়ে গেছে৷ সেই স্বদেশী শোষক শাসকের কাছেও বাঙালী ততটাই আতঙ্কের, যে আতঙ্কে ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে গেছে৷

তাই স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলা ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতি এমকি বাঙালী জাতিটাকেই বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে স্বাধীনতার জন্ম লগ্ণ থেকেই৷ বাঙালীর এই সংকট থেকে বেরবার পথ কী? বাঙালীস্তান ও পঞ্জাব মায়ের বুক চিরে তৈরী হয়েছিলো স্বাধীন ভারত৷ বাঙালীস্তানের  ভৌগোলিক সীমানা দুই ভাগ হলেও ওপার বাঙলা বা এপার বাঙলা সকলের মাতৃভাষা বাংলা৷  দুই বাঙলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে মাছে ভাতে বাঙালী বা ভেতো বাঙালী৷ দুই বাঙলার ভাষা বাংলা ও সংস্কৃতি একই ধরনের৷ নদীমাতৃক দেশ হওয়াতে ঢিলঢালা পোষাক যেমন ধুতি হোক বা লুঙ্গি হোক সঙ্গে পাঞ্জাবি ব্যবহার করবে৷ বাংলা ভাষায় বারটি ডায়ালেক্ট বা উপভাষা প্রচলিত থাকলেও একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সুদ্ধ বাংলায় কথা বলে৷

বাঙালীস্তান ছয়টি জাত বাঙালীর (আদি বাসিন্দা) বিমিশ্রিত সংস্কৃতির একটি মহামিলনের ক্ষেত্র৷ জাত বাঙালী মানে (১) মাহাত -যারা মানব সভ্যতার প্রগতি এনেছে যেমন আগুন, চাকা (প্রগতি), পাথর দিয়ে বাঁচবার জন্য অস্ত্র, কৃষি ব্যবস্থায় হাল, জাল, কাপড়, মূল্যবান ধাতু-ব্যবহার করে গহনা আবিষ্কার করেছে৷ আজ একবিংশ শতাব্দীর মানুষ সেই আবিষ্কারের উপর ভর করে চাঁদে যাচ্ছে৷ (২) কৈবর্ত বা কেওট-যারা বাঙলা তথা বিশ্বের মানুষকে জলের প্রয়োজন বুঝিয়ে মৎস চাষ, জলের নানা ব্যবহার শিখিয়েছে৷ (৩) সদগোপ- যারা বাঙলায় সামাজিক সাংসারিক কাজকর্মকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে যেমন বয়ানশিল্পে তাঁতি, লৌহশিল্পে কামার, মৃৎশিল্পে কুমার ইত্যাদি৷ (৪) রাজবংশী-যারা ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত৷ (৫) নমশূদ্র-যাদেরকে একসময়  রাজা বা জমিদারেরা দেশের সুরক্ষার জন্য লেঠেল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে৷ চাকমা বা সাক্ষ্যমা এরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে পরিচিত৷ এই ছয়টি জাত বাঙালীর মিলিত প্রয়াসে শুধুমাত্র বাঙালীস্তান সমৃদ্ধ হয়নি, সারা ভারতবর্ষের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্ব উপকৃত হয়েছে৷

বাঙালীস্তান তিনটি ব-দ্বীপ সভ্যতার মিলনক্ষেত্র৷ গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র বাহিত সভ্যতা ও বাঙালীর নিজস্ব রাঢ় সভ্যতা যার পার্বত্য সমতল ও ব-দ্বীপ স্তর এই বাঙলাতেই অবস্থিত৷ যার ফলে এখানে সৃষ্টি হয়েছে সুতীক্ষ্ন মেধা, বৈপ্লবিক চেতনা ও কর্মতৎপরতা, পরোপকারী মানসিকতা, পরকে আপন করার আবেগ, শিক্ষা,শিল্পকলা, সাহিত্যে, কৃষি, সমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী ও প্রাচ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার মিলন ভূমি ইত্যাদিতে বিশ্বের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে এই বাঙালীস্তান৷ ভারতের স্বাধীনতায় আত্মবলিদানের সংখ্যা দুই বাঙলায় জগৎ স্রেষ্ঠ৷ এটাই শোষকের কাছে আতঙ্কের কারণ৷ তাই বাঙলা মায়ের জয়ধবনির উচ্চারণ ‘জয় বাঙলা বললে শোষক ও তার তাঁবেদার রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে৷

ভারত  স্বাধীন হয়েছে যে বাঙালীর বলিদানে তাদের বিপ্লবী আত্মারা জানতো না যে তাদের উত্তরসূরি বংশধররা স্বাধীন ভারতে দেশভাগের  বলি হয়ে  হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের সুকৌশল কূটচালে একই ভাষা সংস্কৃতি থাকার পরেও বাঙালী বিদ্বেষীরা বাঙালীকে উদ্বাস্তু, বহিরাগত, ঘুচপেটিয়া ইত্যাদি নামে ভূষিত হতে হবে সত্যি বলতে আজ ভারতবর্ষে বাঙালীর অবস্থা ব্রিটিশ আমলেরচেয়ে করুণ৷ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বাঙালীকে নিজের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতির পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে  হবে৷ এখনই সময় এসেছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের শাসন, শোষণ বন্ধ করতে ও অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক  রাজনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারতের সংবিধান মোতাবেক স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল বাঙালীস্তান ঘটন করা৷ যা সমগ্র বিশ্বের শোষিত মানুষকে পথ দেখাবে৷