ভারতের গণতন্ত্রের প্রহসন

লেখক
কৃষ্ণমোহন দেব

(পূর্বে প্রকাশিতেরে পর)

শাসকের সংখ্যা

স্বাভাবিক রূপ(সমাজের কল্যাণে শাসন)

বিকৃত রূপ-শাসকের কল্যাণে শাসন

একজনের হাতে

রাজতন্ত্র

স্বৈরতন্ত্র

কয়েকজনের হাতে

অভিজাত তন্ত্র

ধনিক তন্ত্র

বহুজনের হাতে

নিয়মতন্ত্র

গণতন্ত্র

অ্যারিষ্টটলের সরকারের উক্ত শ্রেণী বিভাগ খুব তাৎপর্যপূর্ণ৷ সরকারের রূপ যাহাই হোক না কেন আসলে দেখতে হবে সমাজের কল্যাণে শাসন হচ্ছে কিনা৷ আর যাঁরাই সমাজের কল্যাণে শাসন করবেন দলমত আপনপর নির্বিশেষে তাঁরাই হবেন আদর্শ শাসক আর অন্যেরা হলেন কু-শাসক৷

রাজতন্ত্রে সুশাসন ছিল৷ আদর্শ রাজন্যবর্গ মানবধর্মে প্রেষিত হয়ে আপন পর  বিচার না করে’ পুত্রবৎ প্রজাপালন করতেন---একে শাস্ত্রে বলা হয় রাজধর্ম৷ নীতিবাদী, সমাজ সচেতন ও আদর্শবাদী ব্যষ্টিগণ সম্মিলিত ভাবে জনগণের  কল্যাণে সুশাসন দিতে পারেন৷ বর্তমানের মানুষ মনে করে গণতন্ত্রই আদর্শ শাসন ব্যবস্থা৷ প্রচলিত গণতন্ত্র মানে জনগণের দ্বারা শাসন, কিন্তু দেশের সকল জনতা তো শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে না৷ আর পরোক্ষ গণতন্ত্রে অর্থাৎ প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রে সাধারণ জনগণ তাদের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে না ও জনস্বার্থ উপেক্ষা করে প্রতিনিধিগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে৷ যদি দেশের জনগণ বা অধিকাংশ মানুষ সমাজ সচেতক ও নীতিবাদী হয় তবে প্রচলিত অর্থে গণতন্ত্রের শাসন জনগণের কল্যাণ হতে পারে৷ আর তেমন শাসনকে অ্যারিষ্টটল গণতন্ত্র না বলে’ বলেছেন নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা৷ আবার যে শাসনে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ও আমলাদের স্বার্থে হয় তবে তা হলো বিকৃত  শাসন ব্যবস্থা৷ আর এরূপ বিকৃত শাসনই হলো অ্যারিষ্টট্‌লের মতে গণতন্ত্র৷ আজ সারাবিশ্বে তথা আমাদের দেশে দেখছি যে গণতান্ত্রিক শাসন হয়ে চলেছে তা মূলতঃ শাসকদের কল্যাণেই হচ্ছে৷ অ্যারিষ্ট্‌টল  গণতন্ত্র সম্বন্ধে যা বলেছেন তা তিনি সঠিকই বলেছেন৷

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘যারা গণতন্ত্রের সমর্থক তাদের মধ্যে এমন অল্প সংখ্যক আছে যাঁরা গোষ্ঠীতন্ত্র চান না৷ কিন্তু তাঁরাও কি বলতে পারেন তাঁরা যেমনটি চাইছেন ঠিক তেমনটি গণতন্ত্র  চলে বা পৃথিবীর কোন দেশে তেমনটি গণতন্ত্র আছে? না নেই৷ তাছাড়া রাজনৈতিক চেতনা যাদের নেই তাদের বোটের (ভোট) মূল্য বা কতটুকু? আর তাদের মধ্যে সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে বোট (ভোট) কিনে নেওয়া বা হাতড়ে নেওয়া কি খুব বেশী শক্ত? এধরণের ক্ষেত্রে কি ডেমোক্র্যাসি যে কোন মুহূর্তে ডেমোনোক্রেসি বা দানবতন্ত্রে পরিণত হতে পারে না?

প্রকৃতক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই৷ রুশো বলেছেন জনসাধারণের ইচ্ছা  দ্বারা পরিচালিত যে-কোন রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবলে অভিহিত করা যায়৷ জনসাধারারণের ইচ্ছা দ্বারা কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না৷ দেশের জনসাধারণ সকলেই উন্নত বা উন্নত চিন্তা শক্তির অধিকারী নয়৷ তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক উন্নত চিন্তার অধিকারী ও দেশ তথা সমাজ সচেতক৷ যাদের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক চেতনা নেই তাদের ইচ্ছানুযায়ী দেশ পরিচালিত হলে দেশ তো উন্নত হবে না৷ দেশ-শাসনের উদ্দেশ্যে হবে সাধারণ মানুষকে উন্নত ভাবনায় উন্নীত করা, আদর্শবান -নীতিবান করে তোলা৷ সাধারণের ইচ্ছা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হলে দেশে তামসিকতা, অমানবিকতা-সমাজবিরোধী ও অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পাবে আর তা’ হয়ে চলেছেও ৷

আবার বিজ্ঞানী কার্র্লইন বলেছেন ‘‘গণতন্ত্র হল মুর্খদের জন্য মুর্খদের দ্বারা মুর্খদের শাসন৷’’ তাঁর ওই উক্তিটিতে সহমত হয়ে বলব যে মুর্খদের দ্বারা ক্ষমতালোভী স্বার্থন্বেষী সুবিধাভোগী, নীতিহীন, কপাটাচারী ও ধাপ্পাবাজীদেরই জন্য ওই সব ব্যষ্টিদেরই শাসন৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ, গণতন্ত্রের দোষগুলি সম্বন্ধে বলেছেন যে এ হলো অজ্ঞ ও অশিক্ষিতের শাসন, গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার কদর নেই৷ এ হ’ল দল বা গোষ্ঠীতন্ত্র৷ এ হল ব্যয় বহুল৷ এতে সংখ্যা লঘুদের স্বার্থহানি হয়৷ জরুরী অবস্থায় এ অনুপযোগী ইত্যাদি৷ জীববিজ্ঞানের দিক দিয়ে ‘‘সব মানুষ সমান’’ এই তত্ত্ব বা গণতন্ত্রের সাম্যনীতি যা প্রকৃতির বিরুদ্ধ৷ কারণ বৈচিত্র্যং প্রাকৃত ধর্ম সমাণং ভবিষ্যতি---অর্থাৎ সাম্য আনা অসম্ভব৷

বর্তমান যুগের মহান দার্শনিক যিনি অভিনব সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা হ’ল প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব, সংক্ষেপে প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা তিনি তাঁর প্রাউট দর্শনে গণতন্ত্র সম্বন্ধে যে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন তার কিছু এখানে আলোচনা করা হলো ঃ---

‘‘গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তোলার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে৷ প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য ও বোটদাতাদের প্রভাবিত করতে নিজ নিজ দলের ইস্তাহার প্রকাশিত করে৷ যে দেশের জনগণের বৃহত্তর অংশই শিক্ষিত ও তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা খুবই প্রবল সেক্ষেত্রে দল বিশেষের ইস্তাহার পড়ে ভালমন্দ বিচার করতে পারে৷’’ তবে কোন দল বিশেষের কাছ থেকে সুবিধাভোগী শিক্ষিতরাও ইস্তাহারের ভালমন্দ বিচার না করে ওই দলকে সমর্থন করে থাকে৷ ‘‘যে দেশে শিক্ষার মান নেই (শিক্ষার ডিগ্রি মাত্র আছে কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত গুণাবলী নেই৷) বা বেশীর ভাগ জনগণ অশিক্ষিত ও অজ্ঞ, রাজনৈতিক চেতনা নেই, সেখানে জনগণ নির্বাচনী ইস্তাহারের যথার্থ মূল্য ঠিকমত বুঝে উঠতে পারে না ও দলীয় প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে এমন সব রাজনৈতিক দলের অনুকূলে বোট (ভোট) দিয়ে থাকে যার ফল স্বরূপ সেই সব দল ক্ষমতাসীন হয়, যাদের আদর্শ ও কর্মসূচী জনস্বার্থ বিরোধী ও সামাজিক স্বার্থের প্রতিকূল৷’’

‘‘আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বয়সের ভিত্তিতে বোটাধিকার নির্ধারিত হয়৷ দেশের নাগরিক আঠারো বছরের হলে বোটাধিকার লাভ করে৷ অথচ তাদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব আর জনসমস্যার ধরণ ধারণ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ৷ তাই বোটাধিকার কখনও বয়সের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়৷ অথচ যারা শিক্ষিত ও রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে যথেষ্ট সচেতন  এমন অপ্রাপ্ত বয়স্করা বোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়৷ গণতন্ত্রের এইটাই হচ্ছে মারাত্মক ত্রুটি৷’’ (ক্রমশ)