ভারতীয় অর্থনীতিতে  মন্দার ছায়া---সমাধান কোন্ পথে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমার কিন্তু স্বীকার করেছেন ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে৷ এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে বিগত ৭০ বছরে এমন দূরবস্থা আসেনি৷ তাঁর মন্তব্য উৎপাদন শিল্প থেকে কৃষি---সর্বক্ষেত্রে মন্দার পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে৷ অটোমোবাইল থেকে বিসুকট শিল্প প্রায় সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইয়ূনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ পার্লে জি. কোম্পানী জানিয়েছে দশ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে৷ ব্রিটানিয়ার মত বিসুকট কোম্পানী বা হিরো, মারুতি, টাটা মোটরস্, হুণ্ডা প্রতিটি সংস্থা তাদের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছে৷ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বর্তমান অর্থনীতির এই দূরবস্থার কথা স্বীকার করেছে৷

কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এখন এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্যে মরিয়া ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ অর্থমন্ত্রক থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ড্যামেজ কণ্ট্রোলের জন্যে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থাগুলিকে সত্তর হাজার কোটি টাকা অবিলম্বে দেওয়া হবে৷ বিদেশ থেকে আরো লগ্ণি টানবার মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে৷ বিভিন্ন শিল্প সংস্থাকে উৎসাহিত করতে তাদের ওপর থেকে অনেক মামলাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে৷

কিন্তু এইভাবে কী মূল সমস্যার সমাধান হবে? দেশে বেকার সমস্যা চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে৷ ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷

অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ হ’ল সম্পদের অতি সঞ্চয় বা অতি কেন্দ্রীকরণ৷ আর দ্বিতীয় কারণ হ’ল টাকার চক্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করা৷ মূলধন যদি মুষ্টিমেয় কিছু ব্যষ্টি বা রাষ্ট্রের হাতে সঞ্চয় হয, তবে জনগণের বৃহৎ অংশ অল্প কিছু ব্যষ্টির দ্বারা শোষিত হতে থাকে৷ এই ধরণের তীব্র শোষণের ধারায় দেখা দেয় এক বিস্ফোরণ৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণকে বলা হয় মন্দা, depression)৷

তাই ভারতের অর্থনৈতিক সংকটের প্রকৃত সমাধান পুজিবাদীর শক্তি বৃদ্ধি করে’ বা দেশী বিদেশী পুঁজিবাদীদের দ্বারা নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করে’ সম্ভব নয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে এই রীতিতেই বরাবর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কোনও সুরাহা হয়নি৷ বরং সমস্যা ধীরে ধীরে জটিলতর হচ্ছে৷

প্রাউট-প্রবক্তা স্পষ্টতই বলেছেন---মুষ্টিমেয় ব্যষ্টির হাতে ধনের বা সম্পদের কেন্দ্রীকরণ নয়, বরং ধনের বা সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে৷

ভারতের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বেকার সমস্যার সমাধান৷ মানুষের কর্ম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে, তার ক্রয়ক্ষমতাও আসবে৷ পুঁজিবাদীরা পুঁজি বিনিয়োগ করে বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য নয়, অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের জন্যে৷ তাই তারা আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তাতে বেশী মূলধন লাগিয়ে যত  কম নিয়োগ করা যায় তারই চেষ্টা করে৷ তাই দেখা যায় সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে পুঁজিপতি লগ্ণীকারীদের অভাব না থাকলেও সর্বত্র বেকার সমস্যা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷

তাই প্রাউট-প্রবক্তা এক্ষেত্রে অর্থের বিকেন্দ্রীকরণের কথাই বললেন৷ তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর গুরুত্ব বেশী দেন৷ আর ওইসব ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের দিকে সরকারী ভাবে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলেন৷ তাঁর পরামর্শ---স্থানীয় কাঁচামাল যাতে স্থানীয় ভাবে উৎপাদন শিল্পে নিয়োজিত হয়, যাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থের বহিঃস্রোত না ঘটে সেদিকে সরকারকে কঠোর নজর দিতে হবে৷ তাঁর বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্লক ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে নয়৷ তিনি বলেন, ব্লকভিত্তিক সমীক্ষা করে স্থানীয় কাঁচামাল থেকে স্থানীয়ভাবে শিল্প গড়ে প্রতিটি ব্লকের বেকার সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এ জন্যে কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প Agro Industry), কৃষির সহায়ক শিল্প Agrico Industry) ও অকৃষি শিল্প---এগুলির বিকাশ ঘটাতে হবে৷ তার সঙ্গে এও বলেছেন প্রথমে পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে কৃষিতে ওই এলাকার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়৷ কৃষি ভিত্তিক শিল্প (অর্থাৎ চালকল, তেলকল, কাগজ কল প্রভৃতি) যা কৃষি উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর ভিত্তি করে চলবে---জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান এখানে হবে৷ এবার কৃষি সহায়ক শিল্পে (কৃষিতে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি যেমন কোদাল, কুড়ুল, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার প্রভৃতি) ২০ শতাংশ মানুষ, ব্যবসায় ১০শতাংশ, ও বুদ্ধিজীবী চাকুরীতে ১০ শতাংশ নিয়োগ করা যায়৷ এরপর ওই এলাকায় অকৃষি শিল্পের কী কী কাঁচামাল রয়েছে তার সমীক্ষা চালিয়ে অকৃষি শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷ প্রাউট-প্রবক্তার মতে এই শিল্পে জনসংখ্যার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কর্মসংস্থান হবে৷ ২০ শতাংশের কম হলে অর্থনৈতিক উন্নতির মান কম হবে আর ৩০ শতাংশের বেশী হলে উৎপাদিত পণ্যের বাজারের অভাব পড়বে৷ আর এও মনে রাখতে হবে অকৃষি শিল্প গড়ার জন্যে যে কর্মী নিয়োগ করা হবে---প্রয়োজনে কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্পের জন্য নির্ধারিত জনসংখ্যা থেকে লোক টেনে এনে অকৃষি শিল্পে নিয়োগ করতে হবে৷ একে বলা হবে সুসন্তুলিত অর্থনীতি Balanced economy)৷

কৃষি ও এইসব শিল্পে ব্যাপক ভাবে সমবায় অর্থনীতি চালু করাই বাঞ্ছনীয়৷ কেবল মূল শিল্প অর্থাৎ(Key Industry)- যেগুলোর ওপর অন্যান্য শিল্প নির্ভরশীল হবে সেগুলো পরিচালনার ভার রাষ্ট্রের হাতেই থাকবে৷

এই বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া প্রকৃত জনকল্যাণ মূলক অর্থনীতি গড়ে তোলা যাবে না ও বর্তমানে দেশের যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তার প্রকৃত সমাধানও এছাড়া সম্ভব নয়৷