ভারতীয় গণতন্ত্র এখন কোন পথে?

লেখক
জগদীশ মন্ডল

যাঁরা দেশ-দশের কথা ভাবেন, যাঁরা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক  ও সামাজিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে তাঁরা  আজ তা  ভাবতে বসেছেন৷  কারণ ,১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাষ্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ  করল, ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হলো আর ১৯৪৯ সালে ১৫ই অক্টোবর ব্রিটিশের  করদ রাজ্য ত্রিপুরা পূর্ব সিদ্ধান্ত  মোতবেক ভারতে যোগ দিল--- কিন্তু আজও ভারতে সঠিক গণতন্ত্র  স্থাপিত হয়েছে কি?

ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ, সূর্যসেন প্রমুখদের  মতো  শত শত  শহীদের প্রাণের  বিনিময়ে  আমরা ৪৭ সালে যে  রাজনৈতিক  স্বাধীনতা পেয়েছি, আজ তার ৭২ বছর পরও কেন এসব প্রশ্ণ আসে, গলদটা কোথায়, দোষটা কার বা দায়ী কে? ---কথাটা একবার ভেবে দেখা উচিত নয় কি?

বেশীদিন আগের কথা হলেও, ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু  সভাপতি নির্বাচিত  হন৷ পুনঃ ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসেও  সুভাষচন্দ্র সভাপতি নির্বাচিত হন৷ পরপর দু’-দু’বার সভাপতি নির্বাচিত হবার পরও কেন সুভাষবসু কংগ্রেস ছেড়ে চরমপন্থা বেছে নিলেন? কেন ১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ সরকার গঠন করেন? কারণ---(১) নেতাজী দেখলেন আবেদন নিবেদন বা ভিক্ষার  দ্বারা অধিকার  লাভ হয় না৷ ১৯৪২ সালের ‘‘ভারতছাড়ো’’ আন্দোলন কেন ফ্লপ করল তা সবারই  জানা৷ সেদিনের সে আন্দোলন যদি সফল হতো তবে অখণ্ড ভারতই স্বাধীন হতো৷  এসব দেখে নেতাজীর  মাথায় চরমপন্থা গ্রহণের চিন্তা এলো৷

(২) আন্দোলনের বিজ্ঞান বলে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব যুব সম্প্রদায়ের হাতে চলে   আসে৷ সোণার চামচ মুখে করে জন্ম গ্রহণ করা কংগ্রেস নেতারা নেতাজীর কথায় রাজী হতে পারলেন না৷ বরং নেতাজীর বিরোধিতা শুরু করলেন৷ কারণ, পেছনের কথাটা হলো সশস্ত্র আন্দোলনে কে মরে, কে বাঁচে তার ঠিক নেই৷ বলা বাহুল্য ওই নেতারা যে গদীতে বসার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন.

(৩) নেতাজী চেয়েছিলেন--- এমন  আন্দোলন করতে হবে যাতে একদিকে যেমন খণ্ড ভারত স্বাধীন হবে অন্যদিকে ব্রিটিশ পুঁজিবাদের  সাথে সাথে ভারতীয় পুঁজিবাদ ও তাদের শোষণ শেষ হবে৷ দেশীয় পুঁজিপতিদের দালাল তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব নেতাজীর প্রস্তাবে রাজী হতে পারলেন না৷

পারলেন না তো পারলেন না৷ নেতাজী তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়৷ ১৯৪৪ সালের জানুয়ারী মাসে  পূর্বভারতের  মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের দিকে ৫৪ হাজার সৈন্য নিয়ে আজন্ম আশাবাদী নেতাজী সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দবাহিনী নিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন করতে ফরোয়ার্ড মার্চ করলেন৷ মণিপুরের মৈরাংয়ে স্বাধীন ভারতের  পতাকা তুললেন৷ তারপর? তারপর ভারতীয় নেতাদের  কোন সহযোগিতা পেলেনই না৷৷ বরং কেউ তাঁকে ব্রিটিশের পঞ্চম কাহিনী বলল৷ কেউ জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কুকুর -কুইসলিং ইত্যাদি বলে তাঁকে অপবাদ দিল৷ ফলে খাদ্যপানীয়  ও সহযোগিতার অভাবে আজাদ হিন্দু ফৌজের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল৷ অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা  অধরাই রয়ে গেল৷ পেছনের দরজা দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়েই রাজনৈতিক গণতন্ত্র করতে স্বাধীন হলো৷ দেশীয় পুঁজিবাদ বহাল  তবিয়তে ভারতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেল বাঙলা ও পঞ্জাবকে ভাগ করে’৷

পঞ্জাবের  শরণার্থীরা ধর্মমত ও প্রাণ বাঁচাতে ভারতে এসে সবধরণের  সুযোগ সুবিধা পেল৷ আর বাঙালীদের বেলায় জুটল শুধু  লাথি ঝাঁটা বিদেশী বহিরাগত ইত্যাদি বদনাম আর লাঞ্ছনা!

আজ যে কথাটা বলার জন্য এত কথা বলা তা হলো--- আজও ভারতীয় রাজনীতি, ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের উত্থান পতন কন্ট্রোল করে ওই ভারতীয় পুঁজিপতিরা৷ ওরা যখন যাকে চাইবে তাকে ক্ষমতায় রাখবে৷ এটাই ভারতের রাজনৈতিক গণতন্ত্র--- বেনামে পুঁজিবাদ! যদি ত্রিপুরার উদাহরণ নিই, তবে দেখা যায়--- এখানে কেন্দ্রের লোকসভা নির্বাচন, রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, পুরসভা নির্বাচন, ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েৎ নির্বাচন  পাশাপাশি  সমান্তরাল জেলা  পরিষদ বা সংক্ষেপে  ‘এডিসি’ নির্বাচন৷ এতগুলি নির্বাচনের পেছনে রয়েছে শুধু শাসন ক্ষমতা দখল ও বেনামে অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে হাতে পাওয়া৷ তাই তার পেছনে সবাই ছুটল আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থার পর এন্টি কংগ্রেস সেন্টিমেন্টে ১৯৭৮ সালে কংগ্রেসকে নিশিহ্ণ করে দিয়ে রাজ্য ক্ষমতায় আসে সিপিএম নেতৃত্বধীন বামফ্রন্ট সরকার৷ সঙ্গে বিধানসভায় প্রবেশ করে চারটি আসন তখন অর্থের সঙ্গে ‘‘মাসল-পাওয়ার ’’-এরও দেখা যায় মাটির উপরে  ‘এ’-টিম আর মাটির নীচে বি.টিম৷ টি.এন.এন, এ.টি.টি.এফ এন.এল.এফ.টি---কত তাদের নাম, কাজ কিন্তু একটাই খুন অপহরণ, গৃহদাহ, চাঁদার জুলুম করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো ও নিজ নিজ ‘এ’-টিমকে রাজনৈতিক ভাবে সাহায্য করা ৷ ১৯৮৮ সালে শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত সন্তোষ মোহন দেবের পরোক্ষ প্ররোচনায় আসে  বিরোধী দলের সদস্যদের প্রকাশ্যে ভয়-ভীতি দেখানো ও মারধর করা৷ বর্তমানে তার আরও উন্নত সংস্করণ আবিস্কৃত হয়েছে৷ সেই উন্নত সংস্করণটা  কেমন হয়েছে তা ভালো ভাবেই  টের পেয়েছে--- আগে দশবছর, মাঝে ১৯৮৮-৯৩ বাদ দিয়ে বাকী ত্রিশ বছর ত্রিপুরার বুকে  শেকড় গেড়ে রাজত্ব করা সি.পি.এম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট পার্টি৷ তারপর ‘‘চলো পাল্টাই’’ শ্লোগান পাল্টে গেল কম্যুনিষ্টরা৷ এন্টি-কম্যুনিষ্ট সেন্টিমেন্ট এর সঙ্গে অবশ্য পেছন থেকে সাহায্য করলে ও পেছনে  আর কী কী  ছিল সাধারণ জনগণ তা জানবে কী করে?

২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পর ২০১৮ সালে ত্রিপুরার ক্ষমতায় বসে আই.পি.এফ.টির  হাত ধরে বিজেপি৷ ক’দিন পর ছুঁ-মন্ত্র বলে পুর পরিষদগুলো পদত্যাগ করল আবার ছুঁছুঁ  মন্ত্রবলে  বিনা নির্বাচনে  বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নূতনভাবে পুর সংস্থাগুলি গড়ে ওঠে৷ এখন এটাই কি ভারতীয় গণতন্ত্র? এ তথ্যাভিজ্ঞ মহলের  সবার৷  কিন্তু উত্তর?