ভারতীয় রাজনীতির কর্কট ব্যাধি

লেখক
একর্ষি

পূর্বপ্রকাশিতের পর,

শুরুতেই লক্ষ্য করা দরকার,---৪২তম সংবিধান সংশোধনে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (সেকুলারষ্টেট্‌) হিসাবে  ঘোষণা করা হ’ল এর সরলার্থ ও বিশিষ্টার্থ হল ধর্মহীন রাষ্ট্র৷ মানে---রাষ্ট্রে কোন ধর্ম থাকবে না,এটা একটা বিকৃত মস্তিষ্কের মানবতা বিরোধী, সমাজ বিরোধী বিজ্ঞান বিরোধী উদ্ভট ভাবনা৷ যেকোন সত্ত্বাকে তার ধর্ম (প্রপার্টি) ধরে  রাখে, অর্থাৎ তার অস্তিত্বকে বজায় রাখে৷ তাহলে ধর্ম ছাড়া মানুষ! মানুষের -ধর্ম না থাকলে মানুষটাই তো থাকবে না৷ মানুষটাই যদি নাথাকল তবে কাদের জন্য সমাজ, শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান? কিম্ভূত ব্যাপার!

পরের কথা হল, সংবিধানের ধর্ম সংক্রান্ত ধারাগুলো (২৫থেকে ২৮ অনুচ্ছেদ) অনুসারে পরিষ্কার যে, ‘ধর্মমত’কে ‘ধর্মে’র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে৷ ধর্ম হ’ল যে কোন সত্তারই সত্তাগত গুণ বা বৈশিষ্ট্য---যা কোন অবস্থাতেই পালটানো যায় না বা পরিবর্তন করা যায় না৷ বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘প্রপার্টি৷ মানুষের ধর্ম হ’ল বৃহতের এষণা৷ অর্থাৎ মানুষ যা চায় অনন্তভাবে চায়৷ নাল্পে সুখম্‌ অস্তি, ভূমৈব সুখম্‌৷ সব যুগে, সব কালে,সবদেশে, সব মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য আছে৷ এককথায় একে বলা যায় মানবধর্ম৷ কোন মানুষের থেকেই এই গুণকে আলাদা করা যায় না৷  যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয়---যায়, তাহলে সে আর মানুষ থাকবে না--- মনুষ ছাড়া অন্য প্রাণীতে রূপ নেবে৷ লোহা থেকেই মরিচা’র সৃষ্টি , কিন্তু  মরিচা আর লোহার ভৌতধর্ম আলাদা আলাদা৷ দুধের শ্বেতত্বকে দুধ থেকে, আগুনের দাহিকা শক্তিকে আগুন থেকে কি আলাদা করা যায়? যায় না৷ কিন্তু  ধর্মমত পাল্টানো যায়৷ ধরা যাক ---একজন মানুষ সকালে হিন্দু ছিল, দুপুরে  মসজিদে গিয়ে মুসলমান হল, বিকালে গির্জায় গিয়ে খ্রীষ্টান হল, রাত দুপুরে গুম্ফায় গিয়ে বৌদ্ধ হল, আবার সকালে উঠে গুরুদুয়ারে গিয়ে শিখ মতাবলম্বী হয়ে গেল৷ অর্থাৎ ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীষ্ট ইত্যাদি  সবই হ’ল ধর্মমত৷ আসলে যুগে যুগে  বিভিন্ন  অঞ্চলে  বিভিন্ন  মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল৷ তাঁরা তাঁদের সাধনমার্গের মানসআধ্যাত্মিক স্তর, আর বোধহয় সমকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সমকালীন আর্থ-সামাজিক  অবস্থা  ও সমকালীন মানুষের মানসিক ঘটন ইত্যাদি বিচার বিবেচনা করে মানুষের আত্মিক ক্ষুধা মেটানোর জন্যে যুগোপযোগী করে কতগুলো জীবনাচার অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন ও ঈশ্বর সম্পর্কিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন৷ সেগুলোই পরবর্তীকালে ধর্মমত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে৷ যেমন গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম ২৪ জন তীর্থঙ্করের জৈন ধর্ম, যীশু খ্রীষ্টের খ্রীষ্ট ধর্ম ইত্যাদি৷ অর্র্থৎ ধর্মমতের স্রষ্টা আছে, আর আছে তাঁদের নির্দেশিত বাণীর সমাহার রূপ ‘ধর্মগ্রন্থ’ নিয়মাবলী আছে ইত্যাদি৷ কিন্তু ‘ধর্ম’ স্বয়ং-সম্ভূত সত্তা-বৈশিষ্ট্য যা প্রকৃতির  দান, কোন মানুষ বা মহামানব সৃষ্টি করননি৷ কেউ কি  মানুষসহ যেকোন জীব বা সত্তার ‘প্রপাটি’ বা  নিদর্শক  নিয়মাবলী -নির্দেশনা গ্রন্থ বা ধর্মগ্রন্থ দেখেছেন যাকে ভিত্তি করে  ইসলাম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্ট প্রভৃতি ধর্মমতের মত জীব, অজীব, জড় অজড় সত্তা সৃষ্টি হয়েছে? শুধু তাইই নয়,, প্রকৃত ধর্মসাধনায় যে পথ তা হল  আধ্যাত্মবিজ্ঞান--- যার ব্যবহারিক নিত্যপ্রয়াস (প্র্যাকটিক্যাল্‌ কাল্ট বা প্রসেস্‌) হল ‘যোগ ও তন্ত্র’৷ এটা ধর্মসাধনার প্রয়োগবিজ্ঞান৷ এর একটা মৌখিক বা লিখিত বা তাত্ত্বিক রূপ আছে ঠিকই  তবে পুরোটাই গুরুনির্ভর, অর্থাৎ শিক্ষক বা আচার্য বা গুরু কাছে ব্যবহারিক রূপটা বা প্রয়োগকৌশলটা শিখতে হয়, আলপটকা কারে মুখে শুনে বা বই পড়ে হয় না৷ এটা কোন ধর্মমতের বা ধর্মগ্রন্থের এক্তিয়ারভুক্তও নয়৷ এটা সমগ্র মানবজাতির  পৈতৃক সম্পদ৷ মজার কথা হল, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগুরুই বা ধর্মমতের স্রষ্টারাই এই আধ্যাত্মবিজ্ঞানকে আশ্রয় করেই মহাপুরুষ বা যুগাবতার বা ধর্মগুরুর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন৷ অথচ  তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ওই অমৃত-ভাণ্ডারটি দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন৷ আর তাঁদের ধর্মমতের যাঁতাকলে পড়ে মানুষ নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তুলেছে৷ ধর্মমত নিয়ে পৃথিবীতে যত রক্তপাত হয়েছে দু’দুটো মহাযুদ্ধে তা হয়নি৷ এ হানাহানি আজো চলছে৷ সংবিধান এই সংকীর্ণ ভাবজড়তা আশ্রয়ী ধর্মমতকেই মান্যতা দিয়েছে, মানুষের  ধর্মকে বিসর্জন দিয়েছে৷

খ) কার্যত ঃ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সকল ধর্মমতকেই সমর্থন করা হয়৷ নয় কি? তাহলে ভারত সেকুলারকাণ্ট্রি হল কিভাবে?

গ) বহুধর্মমতের দেশ ভারতবর্ষ৷---ভারতের সংবিধান কোন একটি বিশেষ ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয় ধর্মমত হিসাবে গ্রহণ করেনি ঠিকই, কিন্তু ধর্মমতের জটিলতা এড়াতে গিয়ে ধর্মের বিজ্ঞান তথা আধ্যাত্মবিজ্ঞানকেই যে বিসর্জন দিয়ে বসেছে! এটাই হল ‘ধর্মচ্যুতি’ ভারত ও ভারতবাসীর স্বার্থে আধ্যাত্মবিজ্ঞানকে (স্পিরিচুয়াল কাল্ট্‌) শিক্ষায়-সমাজভাবনায়-রাজনীতি তথা প্রাত্যহিক জীবন চর্যায় সর্বত্র  আবশ্যিক পালনীয় -অধিকার করা দরকার ছিল৷ অথচ হয়নি এরফলে  যে বিষবৃক্ষ ভারতীয় রাজনীতিতে রোপণ করা হল, তার বিষফলগুলো কী কী এবার তা দেখা যাক---(ক্রমশঃ)