ভাত দেবার নাম নেই কিল মারার গোঁসাই

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

ত্রিপুরা রাজ্যে সিপিআই (এম)নেতৃত্বাধীন উল্লেখযোগ্য অপকীর্তি সমূহের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ অপকীর্তিটা ছিল, তাদের স্বজন-তোষণ ও ক্যাডার -তোষণ অপকর্মের জাজ্জ্বল্যমান’ দৃষ্টান্ত---১০,৩২৩ জন শিক্ষক-নিয়োগ প্রচলিত নিয়ম-রীতি, দেশের আইন ও শিক্ষানীতি, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ইত্যাদির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই স্রেফ গায়ের জোরে চালিয়ে দেওয়া৷ বস্তুতঃ স্বজন-পোষণসহ অহংকার প্রমত্ততা যে কতই বেসামাল হয়ে উঠতে পারে, এরও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া ত্রিপুরার উচ্চ ন্যায়ালয় তথা হাইকোর্টের রায়কেও রীতিমত অবজ্ঞা করে ভারতের শীর্ষ আদালত সুপ্রীমকোর্টে গিয়ে আপীল করা৷ শিক্ষক-নিয়োগের ক্ষেত্রে যে নীতিলাঞ্ছিত হয়েছিল তাও ছাপিয়ে  গিয়েছিল প্রশাসনিক গোষ্ঠী-তোষণের দুষ্টনীতি৷ তাই মাননীয় ত্রিপুরা হাইকোর্টের সুচিন্তিত রায় ছিল, যুক্তিসিদ্ধমতে বঞ্চিত হয়ে যারা আইনমাফিক প্রতিবাদ  জানিয়েছিলেন, সেই সমস্ত বেকার প্রতিযোগীদেরও রিক্রুটমেন্টের  অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়া৷ কিন্তু, ওই যে অহংকার প্রমত্ততা৷ দুর্র্যেধনীয় বৃত্তির মোহগ্রস্ততা! ত্রিপুরা সরকার ছুটে গেলেন সুপ্রীমকোর্টে বেচারা বেকার ছেলে মেয়াদের ‘‘দেখিয়া দেবেন’’ এই মনোভাব নিয়ে৷ শেষ পর্যন্ত কিন্তু সুপ্রীমকোর্টও ত্রিপুরা হাইকোর্টের রায়টিই বজায় রাখলেন অর্থাৎ ওই নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই অবৈধ বলে ঘোষিত হল ও উক্ত ১০৩২৩ জনকেই বরখাস্ত করার নির্দেশ জারী হল৷ আর উক্ত মামলার চাক্ষুস ফল দাঁড়াল--- ত্রিপুরা সরকার পক্ষ-কর্ত্তৃক ত্রিপুরা রাজকোষ তথা পাব্লিক মানির অজস্র অর্থব্যয় আর অপরপক্ষে চাকুরি প্রাপ্তদের চাকুরি বাঁচাবার প্রত্যাশায় নিজেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক বা বিক্রী করে ও ধার কর্জ করে নিঃস্ব থেকে রিক্ত হয়ে যাওয়া৷

শুধু তাই নয়৷ উনুনে বসানো তপ্ত কড়াইতে দুয়েক ফোঁটা জল পড়ামাত্রই যেমন তা বাষ্প হয়ে উবে যায়, তদ্রূপ বর্তমানের চাকরির দুর্মূল্য বাজারে যারাই বা যেমন করেই হোক চাকরিটা জুটিয়েছিলেন, দীর্ঘদিনের বেকারত্ত্বের জ্বালা ভুলতে গিয়ে তাদের শুকিয়ে যাওয়া জীবনবৃক্ষে কিছুটা হয়তো নতুন পাতা, ফুল ও ফলও গজাতে শুরু করেছিল৷ অর্থাৎ ‘চাকুরিটা তো হয়েইছে,’ এইটুকু মনের জোর রেখে কেউ কেউ নিজের ইচ্ছায় হোক কিংবা বাপ-মায়েদের ইচ্ছায়ই হোক বিয়ে-শাদী করে সংসারী হয়ে গেলেন ও যথারীতি বিবাহিতদের দাম্পত্য জীবনে অনেকের ক্ষেত্রেই নোতুন আগন্তুকদেরও আগমন ঘটেছে৷ অনেকে আবার চাকরির উপর ভরশা রেখেই ব্যাঙ্ক থেকে  ঋণ নিয়ে ঘর-বাড়ী বানাবার ও সাজাবার ব্যবস্থা করেছেন৷ সুতরাং ওইসব হতভাগা-হতভাগীরা তো চাকরি পেয়ে চাকরী চলে যাবার যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে বাঁচবার পথেরও সন্ধান চেয়েছেন! কী বলা যায়! নিঃসন্দেহে এটি বামফ্রন্টীয় অবিমৃষ্যকারিতার রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, তাই তো?

জীবমাত্রেই বাঁচতে চায়--- বাঁচতে চাওয়াটাই জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য৷ তাই গাছেরাও বাঁচতে চায়৷ আবার মানুষের ক্ষেত্রে এই বাঁচতে চাওয়া থেকেই মানব-জীবনের অগ্রগতি, উন্নয়ন , সংবৃদ্ধি, ঋদ্ধি---সমৃদ্ধি ইত্যাদি সম্ভব হয়েছে, আর হয়েছে বলেই তো মানুষের সভ্যতারও উন্মেষ ঘটা সম্ভব হয়েছে৷ নতুবা গুহামানবের আজকের দুনিয়ার বাসিন্দা কিছুতেই হয়ে উঠা সম্ভব ছিল না৷ কিন্তু আজকের পৃথিবীতেও মানুষের দুর্দৈব মানুষই ডেকে এনেছে---পুঁজিবাদী শোষক-মনোবৃত্তির জন্যে৷ আবার সমাজের বৃহত্তর অংশের  মানুষের জীবনে দুর্র্ভেগেরও স্থায়িত্বকাল বেড়ে চলেছে মূলতঃই সেই দুর্র্ভগ্য-পীড়িত মানুষদেরই সমাজ সচেতনতা ও ঐক্যবোধ এই দুইয়ের কারণে৷ ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘‘বিড়াল’’ প্রবন্ধটি-এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য৷ কারণ, প্রবন্ধকার এখানে বলেছেন---মানুষের চর্ব-চুষ্য-লেহ্য-পানীয় সহযোগে খাবারের পাতের কিনারায় বসেই বেড়াল ‘মিউ মিউ’ করে অনুনয় জানাচ্ছে---‘আমায় একটু দাও না গো!’ বলে৷ কোনটা আবার একটু রুষ্ট হয়েও সুর তুলছে ‘ম্যাও’ বলে৷ কিন্তু মানুষটির তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ শেষ পর্যন্ত খাদ্য-রসিকের এক পলকের অসতর্কতারই সুযোগে সেই বেড়ালই মানুষের থালা থেকে মাছের টুকরো মুখে তুলে নিয়ে দে চম্পট! মানুষের খিদের জ্বালার রূপ দিয়েছেন--- তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য--- ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’--- কবিতার পংক্তিতে৷ আরেক বাঙালী কবিই কবিতার পংক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছেন খিদের তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পাওয়ার বিদ্রোহ---‘ভাত দে শ্যালা’ বলে৷

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙলার কর্ষকদের উপর যে জোর-জুলুম, অমানবিক শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতন চলছে তা শুধু ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেই নয় এরও পূর্বাকাল সামন্তপ্রথাও জমিদারী অমল থেকে শুরু হয়ে আজ অবধি চলে এসেছে৷ তাইতো, অতীতের নীলবিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ও নৌবিদ্রোহের মত আজকের গণতান্ত্রিকযুগেও ভারত আজ দিল্লীর কর্ষক বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছে৷ এই কর্ষক-বিদ্রোহের পেছনে মূলত কারণ কিন্তু--- গণতন্ত্রের রামাবলীর আড়ালে চরম পুঁজিবাদী শোষণ,অনাচার ও ব্যভিচার৷ তাই  আন্দোলনকারী আজ বেপরোয়া হয়ে মরণপণ লড়াইতে নেমে এসেছেন তাদের কৃষি-যন্ত্র সমেত কৃষিক্ষেত্র থেকে রাজধানীর রাজপথে, মৃত্যু হোক কুছ পরোয়া নেই এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে৷ তাঁরা সিদ্ধান্ত  নিয়েছিলেন সাংসদ ভবন ঘেরাও করবেন বলে৷ কিন্তু পুঁজিবাদী শোষণের হাতিয়ার স্বরূপ শাসকগোষ্ঠী তাঁদের নিয়ে ধানাই -পানাই ,ছলা-কলা করেও কূল না পেয়ে এখন দ্বিমুখী আক্রমণ চালানো শুরু করেছেন--- একদিকে কর্ষকদের আন্দোলনে ফাটল ধরিয়ে বিপথগামী করে দেওয়া আর অপরদিকে তাদের নিষ্ঠুরভাবে মার দেওয়া৷ এর সামান্যতম মহড়ার সাক্ষী রইলেন বিশ্ববাসী গত ২৬শে জানুয়ারীতে শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নমুনা প্রত্যক্ষ করে৷ এটা কিন্তু, রামভক্তদের ক্যারিশমার এক ঝলকমাত্র৷

এবারে আসুন, আমরা সেই রামভক্ত ও রামরাজত্বের দ্বিতীয় নজীরটা দেখে নিই ত্রিপুরার রাজধানী-শহর আগরতলার সিটি সেন্টারের সম্মুখস্থ শিবিরে পূর্র্বেক্ত ‘১০৩২৩’’---তক্‌মাধারী আন্দোলরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের সহ তাঁদের শিশুদের উপর অতীতে ‘ব্রিটিশ’ নামে বিদেশী শাসক ও শোষকদের ‘জালিয়ানবালাবাগী’ নিষ্ঠুর নির্মম, মানবতা বিরোধী আক্রমণ-কায়দাকেও লজ্জা দিয়ে কীভাবে ত্রিপুরার বর্তমান বিজেপি শাসকগোষ্ঠীর রাতের  অন্ধকারে ঘুমন্ত অবস্থায়  আন্দোলনরত শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করলেন৷ এরপরও কি কেউ ভাববেন না! ভাবতে পারছেন যে ত্রিপুরার বর্বর-শাসনব্যবস্থা কায়েম হতে বাকী রয়েছে?

মাত্র কিছুদিন আগে, রাতের বেলায় ঘুম থেকে তুলে শিশুদের তাদের মা-সহ পিটিয়ে কাঁদিয়ে দামছড়ার লিটননাথকে তুলে নিয়ে রিয়াং সন্ত্রাসবাদীরা খুন করে ফেলল৷ ঠুঁটো জগন্নাথ পুলিশ পরে অবশ্য লিটনের লাশের পচা-গলা -মাংস ঝরে পড়া কংকাল তুলে এনে দিয়ে তাঁদের কর্তব্য-সম্পাদন করার দৃষ্টান্ত রেখেছে৷

গন্ডাছড়া রাস্তা থেকে তিনজন শ্রমিক উগ্রপন্থীরাই অপহরণ করে নিয়ে ত্রিশলাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের বিনিময়ে অবশ্যই জীবিতাবস্থায়ই অপহৃতদের ফিরিয়ে দিয়েছে৷ রাজধানী শহরে প্রায়শঃই সিঁধেল চুরি থেকে দরজায় তালাভাঙা চুরি, বাইক চুরি ছিনতাই চলছে৷ পুলিশ সর্বদাই কর্মক্লান্ত!

মন্ত্রীবাবুরা রাস্তায় বেরোলে উঠতে নামতে স্যালুট ঠুকে মন্ত্রীবাবুর আগে ও পিছে এসকর্ট করে মাসোহারার বিনিময়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন৷ আবার, গণতান্ত্রিক উপায়ে রীতি-নীতি সব বজায় রেখেই বিরোধী রাজনৈতিক সংঘটন সমূহের মিছিল-মিটিং ইত্যাদিতে অনুমতি আটকে রাখার কাজ ‘উপরতলার নির্দেশ নেই’’ বলেই বিরোধী জনমতকে অবদমিত রাখার শাসকগোষ্ঠীর ফরমান মেনে চলে তাঁদের কর্ম-নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা দেখাতে ওস্তাদিপনাতে ওরা বিশেষ পারদর্শী৷ এটাকে কী বলা যায়? প্রশাসনকে দলদাস বানানো নয় বলবেন? গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনকারীদের রাতের অন্ধকারে ঘুমের মধ্যে তস্করের মত আক্রমণকারীদের ‘‘শাসন-শক্তি’’ বলবেন, না রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকারী বলবেন, ভেবে দেখুন৷

হয়তো ‘‘১০৩২৩’’-এর প্রেক্ষিতে কেউ যুক্তি দেখাতেই পারেন যে, কোর্টের রায় অমান্য করে তাঁদের চাকুরীতে পুনর্বহাল করা সম্ভব হবে কেন? এর উত্তরে বলা যায়, ‘কোর্টের রায় শিরোধার্য ও লঙ্ঘনীয় নয়’ এ জানা ছিল না বা বুঝতে পারিনি--- এসব কথাগুলো কি কোনমতেই প্রযোজ্য? দ্বিতীয়তঃ, যদি উপরি-উক্তযুক্তিই এ মুহূর্তে শাসকগোষ্ঠীর জবাব রাখার ইচ্ছা থেকে থাকে, তাহলে প্রশ্ণ ঃ- এমতাবস্থায় আপনারা বিগত রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনের প্রাক্‌-মুহূর্তে চাকুরী-বঞ্চিতদের মিথ্যে আশ্বাস শুনিয়ে পুলব্ধ করেছিলেন কেন? তবে কি শুধুই ১০৩২৩-এর পরিবারবর্গসহ আত্মীয় পরিজন ও কোন কোন রাজ্যবাসীদের বোট আদায় করে এরাজ্যে শাসকের চেয়ারগুলোতে নিজেরা বসে পড়বেন বলে? অবশ্য প্রতিশ্রুতি খেলাপ করলে সংবিধান এর যোগ্য জবাব পাবার মত কোনব্যবস্থার রাখা নেই বলেই বেঁচে যাচ্ছেন৷ তবে, পাপপুণ্য যদি আপনারের শ্রীরাম-সংহিতায় মানার প্রয়োজন মনে করেন, তবে ‘বিশ্বাস ঘাতকতাকে’ ও ‘প্রতিশ্রুতিতে খেলাপ’ আর ‘মিথ্যাচারের দ্বারা লোক ঠকানোর’ ব্যবসাকে পাপ, না পুন্য কোন্‌টা বলবেন একবার ভাবুন৷

পরিশেষে বলব---দেশ, রাজ্য,রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার সংবিধান--- এসবই কিন্তু মানুষের কল্যাণের নিমিত্ত শুধু সাইনবোর্ডের হিতার্থে, যুগ-হিতার্থে, বা মসনদ-লাভের উদ্দেশেও নয়৷ তাই, ভাত দেবার মুরোদ না থাকলে শুধুই কিল মারার গোঁসাই সাজাটা সঠিক কাজ হবে না৷ যেমন কাজ তেমনই ফলভোগ অনির্বার্য