চাই কর্মসংস্থান, ক্রয়ক্ষমতা ও সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

গত ৫ই জুলাই ২০১৯ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী দ্বিতীয় দফায় মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন সংসদে বাজেট পেশ করেছেন৷ অন্যান্য বছরের মত বাজেটের কাগজপত্র বহনকারী ব্রীফকেস পরিত্যাগ করে নতুন অর্থমন্ত্রী ফিতে বাঁধা কাপড়ের থলি হাতে সংসদে প্রবেশ করে এক নব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন৷ লোকসভা নির্বাচনে দেশবাসীর হাত-উপুড় করা ভোট পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে প্রত্যাশার আগ্রহ ছিল৷ যদিও প্রত্যাশা অনুপাতে প্রাপ্তির দিকটা খুব বেশী আলোকোজ্জ্বল নয়৷বাজেটের আগেই এক প্রস্থ স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কমানো হয়েছে৷ স্বল্প সঞ্চয়ে সাধারণতঃ কোনও বড় পুঁজিপতি অর্থলগ্ণী করে না---বরং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীবৃন্দ, সাধারণ মানুষজন, ছোট ব্যবসায়ীগণ ভবিষ্যতের জন্যে সামান্য সঞ্চয় করেন৷ সেই সঞ্চয়ের প্রাপ্ত সুদের টাকাই তাঁদেরধিকাংশের জীবন ধারণের একমাত্র রসদ৷ বাজেটের দিন অর্থমন্ত্রী পেট্রোল ডিজেলের ওপর প্রতি লিটারে এক টাকা অতিরিক্ত উৎপাদনশুল্ক ও এক টাকা সেস ঘোষণা করেছেন---এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিভিন্ন রাজ্যের ভ্যাট ও কর৷ জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমস্ত রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিবহনের খরচ বাড়বে ও সেগুলি মহার্ঘ্য হবে৷ অবশ্য বাজেটের অঙ্গ হিসেবে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করে ছাড়, কোন কোন জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যহ্রাস, জনসাধারণের বিশেষ বিশেষ অংশের জন্যে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার সংস্থান করা হয়েছে৷ যেমন,এবারের বাজেটে খুচরো ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের জন্যে পেনশনের প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে যার পোশাকী নাম ‘প্রধানমন্ত্রী কর্মযোগী মানধন প্রকল্প’৷ এছাড়া এই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে অন্তবর্তী বাজেটে অসংঘটিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্যে মাসে তিন হাজার টাকা পেনশনের ঘোষণাও করা হয়েছিল৷ বাজেট পেশের সময় মাননীয়া অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি গড়ে উঠবে৷

 এখন দেখা যাক, খুচরো ব্যবসায়ী বা অসংঘটিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্যে যে প্রকল্পগুলি ঘোষিত হয়েছে তা জনবহুল এই দেশের মানুষের কতটা দুঃখ-কষ্টের অবসান করতে পারবে৷ প্রথমতঃ উপযুক্ত উপভোক্তাদের নির্বাচন ও দ্বিতীয়তঃ ঠিকঠাকভাবে অনুমোদিত অনুদান তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা রীতিমত দুরূহ ব্যাপার৷ বর্তমানে সমগ্র ভারতবর্ষ এমন একটা সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করছে যে, এই অবস্থায় রাজনৈতিক দল-মত-গোষ্ঠীগত বাধা পেরিয়ে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে প্রকল্প রূপায়ন অত্যন্ত কঠিন৷ এরপর রয়েছে অনুদানের অঙ্কের ওপর বখরা সংক্রান্ত জটিলতা (এই বখরাকে  কাটমানি, তোলা বা কমিশন যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন)৷ কারণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নৈতিকতার মান আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নগামী৷ আর এই রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই এইসব অনুদান, পেনশন বণ্টনের ব্যাপারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে৷ শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় যারা বঞ্চিত হবে তাদের মনের ক্ষোভ সমাজে বিভাজন ও আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতির অবনতির কারণ হয়ে উঠতে পারে৷ সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সৎ ভাবে ব্যয় করার চেষ্টা করে, কিন্তু বিনাশ্রমে অনৈতিক পথে লব্ধ অর্থ অনেক সময় নেশাভাঙ বা অন্য কোনও দুষ্কর্মে ব্যয়িত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল৷ পুঁজিবাদী এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের সামনে বিপথগামী হওয়ার উপকরণ সর্বদা একেবারে হাতের নাগালেই উপস্থিত৷

২০১৯-এর বাজেট বত্তৃণতায় আগামী পাঁচ বছরে ভারতবর্ষকে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পুষ্ট করার স্বপ্ণ দেখানো হয়েছে৷ অবশ্য ভারতবর্ষের জনগণ শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদীকে স্বপ্ণ দেখানোর যাদুকর হিসাবে মানেন৷ গত ২০১৪ সালের নির্বাচনেও মোদীজী বিদেশের কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক দেশবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা দেওয়ার স্বপ্ণ ফেরি করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে এক কানাকড়িও দিতে পারেননি৷ দেশের বিশাল পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধার, সন্ত্রাস মোকাবিলা, ডিজিটাল ইকনমি ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে নোটবন্দীর খেলা খেলেছিলেন---যার ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানি, নোট বদলের লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের চরম দুর্দশা, কর্মহীনতা, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের সম্পূর্ণত বিপর্যয়, নগদের অভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা ইত্যাদি ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল সারা দেশ৷ পরবর্তীকালে দেখা গেল সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফেরত এসেছে, কালো টাকার পরিমাণ নগন্য, সন্ত্রাসও কমেনি---শুধুমাত্র দেশের মানুষের যন্ত্রণাটাই হয়েছিল সার৷ এহেন নরেন্দ্র মোদিজী আবার পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ণ দেখাচ্ছেন৷ দেশের সম্পদ বৃদ্ধি পেলে দেশবাসী অবশ্যই খুশী হবেন৷---কিন্তু সেই সম্পদ যদি সাধারণ দেশবাসীর বিশেষ কোন উপকারে না এসে শুধুমাত্র শিল্পপতি, পুঁজিপতি, মুনাফাবাজদের কোষাগারে সঞ্চিত হয়, তবে সেই সম্পদের উপযোগিতা কোথায়? দেশের অর্থনীতি যদি গণ অর্থনীতিতে পরিণত না হয়, প্রতিটি দেশবাসীর উন্নয়নে ব্যবহৃত না হয়, মুষ্টিমেয় কতিপয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে সেই অর্থনীতি মানুষের শোষণ, বঞ্চনা ও হাহাকারের অস্ত্র হয়ে ওঠে৷ বর্তমানে দেশের ৯০ ভাগ সম্পদ দশ শতাংশেরও কম পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের কুক্ষিগত৷ ---তাদের ঘরে সব ধরণের ভোগ বিলাসের বিপুল আয়োজন, আলোর রোশনাই৷ আর দেশের কোটি কোটি মানুষ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ছাদহীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন অবস্থায় নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত হয়ে চলেছে৷ এই অর্থনীতি দিয়ে হয়তো দেশের মোট সম্পদ ও দেশবাসীর গড় আয়ের উচ্চ হার বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে বাহবা কুড়ানো যেতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্দশার লাঘব হয় না৷

বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ, কর্মসংস্থানের চরম অভাব, দু-মুঠো অন্নের জন্যে  মানুষকে সর্বস্ব হারাতে হচ্ছে৷ শুধুমাত্র বেতন বৃদ্ধি, পেনশন, অনুদান দিয়ে দেশের মানুষের দুর্গতি ও কষ্টের সুরাহা করা সম্ভব নয়৷ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করার সাথে সাথে প্রতিটি দেশবাসীর নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা) নিশ্চিততা প্রদান করতে হবে৷ অর্থনীতির কেন্দ্রীকরণের দ্বারা এই সমস্যার সমাধান কিছুতেই সম্ভব নয়, কারণ এরফলে পুঁজিপতিরা আরো ধনবান ও গরীব আরো দরিদ্র হতে থাকে৷ একদিকে অন্যায়, দুর্নীতি, অনৈতিক কাজকর্ম, ধাপ্পাবাজীর দ্বারা পুঁজিবাদীরা জনগণকে বঞ্চিত ও শোষণ করে নিজেদের মুনাফা বাড়াতে থাকে---অপরদিকে অর্থশক্তির জোরে রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রশাসনকে কব্জা করে নিজেদের স্বার্থে দেশের অর্থনীতিকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়৷

এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্যে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ ও গণ অর্থনীতির প্রবর্ত্তন একান্ত প্রয়োজন৷ আর এর জন্যে সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষের নৈতিকতার মান যথেষ্ট উন্নত করার চেষ্টা করতে হবে৷ সেই সঙ্গে স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে৷ ব্লক ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের প্রকৃত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ও সমস্ত সম্পদের সর্বাধিক উপযোগের দ্বারা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটাতে হবে৷

ভারত সহ সমগ্র বিশ্বে যে সম্পদ রয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তার সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে’ সব মানুষের জন্যে সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারলে সকলের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানো সম্ভব৷ কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে সমস্ত অলাভজনক কৃষিজমিকে একসঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের ব্যবস্থা করলে প্রত্যেক জমি মালিকের লভ্যাংশ বৃদ্ধি পাবে, শ্রমের পৃথক মূল্যায়ণ করা যাবে, সকলের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে---সর্বোপরি জমির অপচয় রোধ করা যাবে৷ শিল্পের ক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তুলে স্থানীয় কাঁচামালকে ব্যবহার করে, স্থানীয় অধিবাসীগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ উৎপাদক সমবায় ও উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের প্রয়োজন, সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য স্থির করার বিষয়ে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হবে৷ এরফলে উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে কোনও মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল-ফড়েদের উপস্থিতি থাকবে না৷ অতি বৃহৎ শিল্পগুলি স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা চালিত হবে ও অতিক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলি ব্যষ্টিগত উদ্যোগে পরিচালিত হবে৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রাউট দর্শনের আদর্শে গড়ে তোলা উপর্যুক্ত কৃষি, শিল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷ ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার দ্বারা স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে স্থানীয় একশত শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান অবশ্যই সম্ভব হবে ও ক্রয়ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে৷ কর্মক্ষম মানুষ তার দুই হাত ও মেধাশক্তির ব্যবহার করে’ উপার্জন করার সুযোগ পেলে কোনও অনুদান বা দয়ার ভিক্ষা চায় না৷ তাই আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নৈতিক চরিত্রে বলিষ্ঠ সদ্বিপ্রগণের নেতৃত্বে সমবায় পদ্ধতিতে সমগ্র উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হলে গণ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে, পুঁজিবাদীদের শোষণ দূর হবে ও প্রতিটি মানুষের কর্ম সংস্থান তথা ক্রয়ক্ষমতা সুনিশ্চিত হবে৷ তাই সমগ্র দেশে প্রাউটের অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাকল্পে সমস্ত দেশবাসীকে এগিয়ে আসতেই হবে---আর এই কাজ সুসম্পন্ন করতে যত বিলম্ব হবে, সাধারণ মানুষের দুঃখের দিন ততটাই আরও দীর্ঘায়িত হবে৷