চার প্রকারের সেবা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

মানুষের করণীয় কী? জীবন একটা ব্রত৷ আমি বলেছি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ অর্থাৎ মানব জীবন একটা ব্রত–জীবন মানেই ব্রত অস্তিত্ব মানেই ব্রত৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’–মানুষ যা–ই করুক না কেন, তা করা উচিত আত্মমোক্ষের জন্যে–তার নিজের মোক্ষের জন্যে, আর করা উচিত সমগ্র বিশ্বের উন্নতির জন্যে৷ মানুষের এই দু’টো কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানুষের ব্রত হচ্ছে এই দু’টো কাজ৷

‘‘আত্মমোক্ষার্থং’’৷ তোমরা জান, পৃথিবীর সব কিছুই চলমান, বিশ্বের সব কিছুই চলে চলেছে৷ একে চলতেই হবে৷ মনে কর কেউ যদি বলে, ‘‘না, আমি চলব না,’’ তবুও সে স্থির থাকতে পারে না, তাকে পতনের পথে চলতে হবে৷ সেইজন্যে তোমাদের উচিত সামনের দিকে এগিয়ে চলা, তা না হলে পিছনের দিকে চলতে হবে৷ কারণ পৃথিবীর কোন কিছুই স্থানু বা স্থির নয়, সবকিছুই চলে চলেছে, সবকিছুই চলমান৷ যদি তুমি ওপরের দিকে না যাও তাহলে তোমাকে নীচের দিকে যেতে হবে৷ তাই ‘‘আত্মমোক্ষার্থং’’৷ যে যা–ই করুক না কেন তা মোক্ষের জন্যে করতে হবে৷ মোক্ষ মানে ঙ্মনির্বিকল্পক্ষ চিরকালীন মুক্তি৷

তারপর ‘জগদ্ধিতায় চ’৷ মানুষ সবকিছুই তার নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে, নিজের মুক্তির জন্যে, সম্পূর্ণ মুক্তির জন্যে করছে৷ সে যে তার নিজের মুক্তির জন্যে সবকিছু করছে–এটা খুবই ভাল কথা কিন্তু মানুষ কী স্বার্থপর? সে সবকিছু তার নিজের মুক্তির জন্যেই করবে? অন্যের জন্যে সে কিছুই করবে না, তোমরাই বল, এটা কি ঠিক? মানুষ তো তাহলে স্বার্থপর হয়ে গেল৷ নিজের মুক্তির জন্যে কোন কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের সেবাও করতে হবে৷ কীভাবে সেবা করবে? সেবার মধ্যে সর্বোত্তম সেবা বিপ্রোচিত সেবা ঙ্মক্ষৌদ্ধিক সেবাক্ষ৷

তোমরা জান, সেবা চার প্রকারের ঃ–

১) শূদ্রোচিত সেবা হ’ল শরীর দিয়ে কারো সেবা করা৷ শারীরিক সেবা, অসুস্থকে সেবা করা৷ শূদ্রের যে সেবা তা শূদ্রোচিত সেবা৷

২) ক্ষত্রিয়োচিত সেবা হ’ল নিরাপত্তা দেওয়া, দুর্বলদের সাহায্য করা৷

৩) বৈশ্যোচিত সেবা ঙ্মর্থনৈতিক সেবাক্ষ হ’ল ত্রাণকার্য, নারায়ণ সেবা তথা প্রয়োজনে কাউকে সাহায্য করা৷

৪) বিপ্রোচিত সেবা হ’ল নীতি–শিক্ষা দেওয়া, শিক্ষাদান, আদর্শের প্রচার, ধর্মপ্রচার৷ এ সব বিপ্রোচিত সেবা৷

এখন সর্বোত্তম সেবা–যদিও সব সেবাই সমান মানের–কিন্তু বিপ্রোচিত সেবা চিরকালীন আর বাকী যে তিন ধরনের সেবা–শূদ্রোচিত, ক্ষত্রিয়োচিত ও বৈশ্যোচিত–এরা ক্ষণকালিক–এদের গুরুত্ব কিন্তু কম নয়, শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক স্বভাবের৷ একজন ক্ষুধার্ত্ত মানুষের কাছে সর্বোত্তম সেবা কোন্টা? তাকে খাওয়ানো৷ এই সেবা চিরন্তন প্রকৃতির না হলেও সেই সময়ে সেটি সবচেয়ে মূল্যবান৷ কেউ যদি ক্ষুধার্ত হয়, মনে কর সে কাঁদছে, মরতে বসেছে, তুমি কি তখন তাকে বলবে–‘‘যাও, ব্যাপক শৌচ করে ঈশ্বরপ্রণিধান কর৷’’ না, না, না তাকে তখন অন্ন দাও৷ হ্যাঁ, এর তাৎক্ষণিক গুরুত্ব আছে৷ কিন্তু বিপ্রোচিত সেবার গুরুত্ব চিরন্তন৷ তাই একে সর্বোত্তম সেবা বলা হয়৷

এই চার প্রকারের সেবাই ‘হিতের’ মধ্যে পড়ে৷ তাই বলা হয়েছে ‘জগদ্ধিতায় চ’৷ ‘জগৎ’ মানে ‘পৃথিবী’, ‘হিত’ মানে কল্যাণমূলক সেবা৷ যা কিছুই তুমি কর–না–কেন তা নিজের মুক্তির জন্যে করবে–‘‘আত্মমোক্ষার্থং’’৷ তারপরে ‘জগদ্ধিতায় চ’–জগতের হিতের জন্যে করবে৷ শূদ্রোচিত, ক্ষত্রিয়োচিত, বৈশ্যোচিত ও বিপ্রোচিত–এই চার প্রকারের সেবাই হিতের মধ্যে পড়ে৷ কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে যে বিপ্রোচিত সেবা চিরকালিক৷ একজন ভাল মানুষকে এই নীতি মেনে চলতে হবে অর্থাৎ তাঁর জীবন হক্ষে আত্মমোক্ষ ও জগতহিতের জন্যে–‘‘আত্মমোক্ষার্থং’’ ও ‘‘জগদ্ধিতায় চ’’৷

   তাহলে মানুষকে কী করতে হবে? দু’এর মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হবে৷ সন্ন্যাসীরা ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’ মেনে চলবে৷ যারা কেবল নিজেদের পেটের জন্যে বাঁচে তারা সন্ন্যাসী নয়৷ প্রকৃত সন্ন্যাসীরা সমাজের সেবা করে৷ যারা সমাজসেবা করে তারা কেবল ‘বিদ্যা’র জন্যে সংগ্রাম করে না, তাঁরা জগতের সেবাও করে৷ আর এটা বস্তুতঃ শুধু সন্ন্যাসীদেরই নয়, গৃহীদেরও করা উচিত৷

দু’জনের মধ্যে তফাৎটা কী? একজন গৃহীর জীবন কিছুটা কষ্টকর৷ কেন? গৃহীর দু’টো পরিবার–বড় আর ছোট৷ ছোট পরিবারটা কী? এটা বাবা–মা–ভাই–বোন–পত্ ও অন্যান্য আত্মীয়–স্বজন, যেমন কাকা–কাকী ইত্যাদি নিয়ে৷ ভারতীয় পরিবার বেশ বড়৷ ভারতীয় প্রথানুসারে বাবা–মায়ের বোনেরাও পরিবারের অন্তর্ভুক্ত৷ এটা হ’ল গৃহীর ছোট পরিবার৷

আর একটি পরিবার হ’ল সমগ্র বিশ্ব ও নিপীড়িত মানবতা৷ গৃহীদের কী করতে হবে? তাকে এই দু’টো পরিবারের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে৷ সর্বক্ষেত্রে তাকে ছোট পরিবারের দেখাশোণা করতে হবে ও দায়ভার নিতে হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বড় পরিবারের জন্যেও কাজ করতে হবে৷ যদি কেউ তার সমস্ত শক্তি ও সময় বড় পরিবারকে উপেক্ষা করে ছোট পরিবারের জন্যেই নিয়োগ করে দেয় তাহলে সে পতিত তথা স্খলিত গৃহী হবে৷ ঠিক তেমনি যদি কেউ বাবা–মা–ভাই–বোন নিয়ে গড়া ছোট পরিবারকে অবহেলা করে’ কেবল বড় পরিবারের দিকে মন দেয় তাহলে তারও পতন হবে৷      (আনন্দবচনামৃতম্ ২৯ খণ্ড)