চীনের আগ্রাসন ঠেকাতে উন্নয়নেও নজর দিতে হবে

লেখক
সুকুমার সরকাব

গালওয়ানে চীন-ভারত মল্লযুদ্ধে কুড়িজন ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়েছে । দাবী করা হচ্ছে চীনেরও অনেক সেনার মৃত্যু হয়েছে। কুড়িজন ভারতীয় সেনার মধ্যে দুজন পশ্চিমবঙ্গের । তারমধ্যে একজন উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার। উত্তরবঙ্গ হিমালয়ের পাদদেশে হিমালয়ে নেপাল বাদ দিলে তিববত থেকে এখন চীন আগে তিববতের  সাংসৃকতিক যোগ ভারতের সঙ্গেই বেশি ছিল। সেই বেশিরভাগটাই রক্ষিত হতো এই উত্তরবঙ্গ দি... এখনো চীনের অবৈধ বাণিজিক আগ্রাসনের বেশিরভাগটাই  হয়ে থাকে উত্তরবঙ্গ দিয়েই। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরে চীনা পণ্যের নির্দিষ্ট বাজার পর্যন্ত আছে। যার বেশিরভাগটাই ওই অবৈধ পথে আসা। সম্প্রতি গলওয়ান কাণ্ডের জের হিসেবে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরে চীনা পণ্যের হংকং মার্কেটের নাম পাল্টানোর  সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিলিগুড়ির  ব্যবসায়িক মহল। খুবই সাধু উদ্যোগ। তবে শুধু নাম পাল্টালেই হবে না। সত্যিকার অর্থে চীনা পণ্য বয়কট করতে হবে।  বিশেষ করে  অবৈধভাবে যেগুলো আসছে। বৈধ পণ্য আমদানিতেও সরকারকে ভাবতে হবে। যে কারণে প্রভূত চীনা পণ্য আসে, তার প্রধান কারণ চীনা পণ্য সস্তা ও চীনারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে পণ্য উৎপাদন করে অর্থাৎ যে দেশে যে ধরণের জিনিসের চাহিদা বেশি চীনারা সেই সব জিনিস তৈরি করে। যেমন ভারতের পর্যটন ক্ষেত্রগুলিতে গেলে মানুষ সেখানকার দেবতার মূর্ত্তি কিনবেন। চীনারা সেই সব দেবতার সুদৃশ্য মূর্ত্তি বানিয়ে এ দেশে চালান করে দিচ্ছে। দেওয়ালিতে প্রদীপ, আলোর মালা, বাজি, বিয়ের তত্ত্ব তালাশের চালুন-ডালা কী নেই সেই তালিকায়। সবকিছুই চীন তৈরি করে পাঠাচ্ছে। শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে চীন এই মনস্তত্ত্ব নিয়ে ব্যবসা করছে। প্রচলিত একটি কাহিনি আছে। চীন প্রথম যখন প্রত্যক্ষ করল, তাঁদের দেশের  অযত্ন লালিত চা গাছের পাতা যত্রতত্র প্রচুর জন্মে। সেই পাতা জলে ফুটিয়ে সাধারণ মানুষ খায় কিছুটা ওষধি হিসেবে। চীনের অর্থনীতিবিদরা ভাবলেন এই পাতা প্রতিবেশি দেশগুলিতে রপ্তানি করলে প্রচুর অর্থ আস। তাঁরা তখন কিছু লোক দিয়ে ভারতে তা পাঠালেন । ভারতের বিভিন্ন শহরের মোড়ে মোড়ে তাঁরা  চা-পাতা জলে সিদ্ধ করে মানুষকে বিনা পয়সায় খেতে দিলেন। কিন্তু কটু স্বাদযুক্ত ওই চা ভারতবর্ষের মানুষ গ্রহণ করলেন না ।তখন তাঁরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন। কিন্তু চীনারা দমবার পাত্র নন। তাঁরা আবার লোক পাঠাল এবার চা পাতা নিয়ে নয়, কিছু মহিলাকে পাঠাল। ভারতীয়দের খাদ্যাভাস জানতে। চীনা মহিলারা ভারতীয়দের হেঁসেলে ঢুকে দেখলেন ভারতবর্ষের মানুষ দুধ আর মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। ব্যস, সূত্র পেয়ে গেলেন চীনারা এবার আবার এলেন  চা পাতা নিয়ে আবার তাঁরা শহরের মোড়ে মোড়ে বসে চা পাতা সিদ্ধ খাওয়াতে লাগলেন। তবে এবার শুধু চা পাতা জলে সিদ্ধ নয় চা পাতার সঙ্গে মেশালেন দুধ আর চিনি, যা ভারতীয়দের প্রিয় খাদ্যাভাস। ব্যস, তাতেই বাজার মাৎ! এই মনস্তত্ত্বেই চীনারা সমগ্র বিশ্বে ব্যবসা করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে।

দুবছর আগে আমার পরিচিত এক ডাক্তারবাবু আমেরিকা গিয়ে আমার জন্য স্ট্যাচু অব লিবার্টি কিনে এনেছিলেন। আমি দেখলাম সেই স্ট্যাচু অব লিবার্টির নিচে লেখা মেড ইন চাইনা। চীনাদের এহেন মনস্তাত্ত্বিক বাণিজ্যিক আগ্রাসন ঠেকানো মুশকিল। শুধু মার্কেটের নাম বদলালে হবে না। প্রয়োজনীয় এই সামগ্রীগুলির বিকল্পও আমাদের তৈরি করতে হবে। শুধু আধ্যাত্মিকতা আর যোগ দিয়ে বিশ্ব জয় করা যাবে না ।প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে সস্তায় সব কিছু তৈরির কৌশল শিখতে হবে। চীনদেশের স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের হাতের কাজ শিখতে ছোট ছোট যন্ত্রপাতি দিয়ে নানান খেলনাপাতি, ছোট ছোট যন্ত্র সামগ্রী তৈরি করে আনতে বলা হয়। সরকার সেগুলি কিনে নিয়ে বিশ্বের বাজারে বাজারে সস্তায় বিক্রি করে। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করে অর্থ পেয়ে উৎসাহিত হয়। আমাদের দেশের  স্কুলগুলি ছাত্র-ছাত্রাদের ঝাড়ু, মাটির পুতুল, আর থার্র্মেকল দিয়ে মডেল বানাতে শিখায়। যা কোনো কাজেই আসে না। ছাত্রছাত্রীরা নিরুৎসাহিত হয় ।চীনের সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টি হলেই চীনা পণ্য আমদানি হবার ছিদ্রপথগুলো বন্ধ করতে হবে । উত্তরবঙ্গের সমগ্র মার্কেটে নানান সস্তার চীনা পণ্যের ছড়াছড়ি। ট্রেনে বাসে হকাররা পর্যন্ত চীনা পণ্য ফেরি করে বিক্রি করে। আজ চীনের বাড়বাড়ন্তের।  প্রধান কারণ চীন দেশের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা। আর তার রসদ জোগাচ্ছে গোটা বিশ্ব।

ভারতকে চীন চিরকাল প্রতিপক্ষ মনে করেছে। প্রাচীনকালে তাই  ভারতের দিকে সুদীর্ঘ প্রাচীর তুলে রেখেছিল। আজ তুলে ধরছে বাণিজ্যিক আগ্রাসনের প্রাচীর। আর মাঝে মাঝে সামরিক আগ্রাসন করছে। বিশ্বে  দাদাগিরি ফলাতে ভারতকে চাপে রেখে ভারতের মধ্যে দিয়ে সমগ্র বিশ্বে বাণিজ্য আগ্রাসনবাদ টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা  চীনের । তাই চীনের মোকাবিলায় বয়কট তো করতেই হবে সেই সঙ্গে প্রযুক্তিতে চীনের বিকল্প হতে হবে। বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক ওই ধরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের দেশেও প্রচুর ম্যান পাওয়ার আছে । শিক্ষাকে কারিগরি ও প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। ঢালাই যন্ত্রে প্লাস্টিক বা ওই ধরনের জিনিস দিয়ে গণেশ, কালী,দুর্গা, হনুমান তৈরি করা খুব কঠিন নয়, সস্তায় কাপড়, বাসন-কোসন বা সস্তার যন্ত্রপাতি বানানো উত্তরবঙ্গেও তার প্রভূত কাঁচামাল আছে। সস্তার শ্রমিকও আছে। নেই শুধু পরিকল্পনা। কী রাষ্ট্রীয় ভাবে, কী বেসরকারিভাবে। ভারতবর্ষের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি ভারি শিল্প তৈরিতে বেশি। ব্যস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে দিতে তাঁদের তৎপরতা খুব কমই  চোখে পড়ে। অথচ অর্থনীতির মোদ্দা কথা প্রতি হাতে কাজ ।আর প্রতি হাতে কাজ দিতে পারে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র  ও মাঝারি শিল্প। ভারতবর্ষকে সেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি  শিল্পের ওপর নজর দিতে হবে। চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওই সমস্ত পণ্য উৎপাদন করে বিশ্ব অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে। ভারতকে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। বাজারে গেলে সম মানের সস্তার জিনিসটাই সবাই কিনতে চাইবেন। তখন দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের পকেটের সামর্থ বড় হয়ে দেখা দেবে। এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। যা করা খুবই দরকার । আর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের ভারতবর্ষ যেখানে ভূমিগত  উর্বরতায় বিশ্ব সেরা, সেখানে ভূমিজ উৎপাদিত ফল, ফসল পর্যন্ত  চীন থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। দার্জিলিং জেলার কমলা, কাশ্মীরের আপেল জগৎ বিখ্যাত হলেও চীনা আপেল কমলা বাজারে ।সস্তা চীনা মাল্টা কী নেই ।এ সব কিছু আমাদের দেখতে হবে ।দার্জিলিংয়ের কমলা বাগানকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করে ফলন বাড়াতে পারলে কে  চীনের কমলা খাবে। কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে এনে কাশ্মীরী আপেল চাষকে বাড়াতে পারলে কে চীনা আপেল খেত ।সবচেয়ে বড় কথা এগুলো আমদানিতে সরকারই বা ছাড়পত্র দেয় কেন? চীনা পণ্য তো বয়কট করতেই হবে। প্রয়োজনে চীনা পণ্য আমদানিতে যে সরকারের সায় থাকবে পরবর্তী নির্বাচনে সেই সরকারকেও বয়কট করতে হবে । সমুদ্র-পাহাড়ে ঘেরা ভারতবর্ষকে প্রকৃতিই সুরক্ষা দিয়েছে । তারজন্য ভারতবর্ষকে প্রাচীর তুলতে হয় না বহু ধর্মমত, বহু রক্ত-বর্ণের, বহু ভাষা-সংসৃকতির মিশ্রণে ভারতবর্ষ এক শক্তিশালী নেশনের দেশ চীনকে তা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে উৎপাদনেও সমানে সমানে পাল্লা দিতে হবে।

উত্তরবঙ্গের  মানুষ বিপুল রায়কে মনে রেখে চীনের তৈরি কোনো জিনিসই যদি আর না কেনেন ও সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী ও চীনাবাদী অর্থনীতির বিকল্প কোনো প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সহায়তা নিয়ে উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করেন তবেই চীনের আগ্রাসনে নিহত বিপুল রায়ের প্রতি সম্মান জানানো হবে।