চুক্তিচাস শুরু ঃ অশনি সংকেত

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

কেন্দ্রের আনা কৃষিবিল বাতিলের দাবীতে প্রায় ২মাস ধরে দিল্লির রাস্তা দিবারাত্র অবরোধ করে হাজার হাজার কর্ষক এই প্রচণ্ড শীতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ৷

কেন্দ্র কর্ষকদের দাবী মানতে নারাজ৷ উত্তেজনা ক্রমে তুঙ্গে উঠছে৷ একের পর এক কর্ষক তাদের দাবীতে অনড় থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে৷ গত ৯ই জানুয়ারী সিংঘুতে কর্ষকদের প্রতিবাদ মঞ্চের সামনেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে পঞ্জাবের অমরেন্দ্র সিংহ৷

এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেল, কর্ণাটকের রায়চূড়ে রিলায়েন্স কোম্পানীর তরফে ‘স্বাস্থ্য ফার্মাস প্রডিউসিং কোম্পানী’ নামে সংস্থা স্থানীয় কর্ষকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে৷

১,১০০ জন চাষী এই চুক্তিপত্রে সই করেছে৷ একথা বিজেপি’র নেতারাই তাদের কৃতিত্ব বলে তুলে ধরে প্রচার চালাচ্ছে৷ সরকার দাবী করছে,কুইন্টাল প্রতি ৮২ টাকা করে দেওয়ার চুক্তি হয়েছে৷ তাই বিজেপি’র দাবী, চাষীরা উপকৃত হচ্ছে৷ কিন্তু কোন্‌ চালের জন্যে এই চুক্তি করা হয়েছে?

কর্ষকসভার জনৈক নেতা, বিজকৃষ্ণন জানান, সোনামাসুড়ি চাল,  অত্যন্ত উন্নতমানের তার জন্যে প্রতি কুইন্টালে ৮২ টাকা বেশি দাম মোটেই বেশি নয়৷ এ চাল তো গরীব-মধ্যবিত্ত মানুষ সচরাচর খায় না৷ অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশে রফ্‌তানীর দিকে দৃষ্টি দিয়েই এই ধানের চুক্তি-চাষ করা হয়েছে৷

এইভাবেই, পুঁজিপতিরা সাধারণতঃ চুক্তিচাষে সেই ফসল চাষের জন্যে চুক্তি করে যাতে তাদের মুনাফা ফুলে ফেঁপে উঠবে৷ জনসাধারণের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে নয়৷ এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখা দিতে পারে৷ আর পুঁজিপতিরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চুক্তি-চাষ করালেও তা হয়তো বিপুল পরিমানে মজুত করে ‘কৃত্রিম অভাব’ সৃষ্টি করবে৷ উভয়ক্ষেত্রেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য দেখা দেবে৷ দেশে উৎপাদন হলেও মূল্যবৃদ্ধি এত হবে যে তা সাধারণ মানুসের নাগালের বাইরে চলে যাবে৷

১৩৫০ সালে এইভাবেই পুঁজিপতিদের সৃষ্ট কৃত্রিম অভাবের ফলেই বাঙলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, যার ভয়াবহ চিত্র বিভূতিভূসণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসেও ফুটে উঠেছিল৷ আর সেইটাকেই অবলম্বন করে সত্যজিত রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছিল---তা প্রতিটি বাংলার সাহিত্য ও ইতিহাসবিদ্‌ জানেন৷

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের এদেশের চাষীদের সঙ্গে নীলচাষের চুক্তি-চাষ প্রবর্তন করা ও তার জেরে চাষীদের ওপর ব্রিটিশ সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পনে’ লিপিবদ্ধ রয়েছে৷ এই নাটকের অভিনয় সেইসময় বাঙালীদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল৷

একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুখে ‘আত্মনির্ভরতা’র শ্লোগান দিয়ে যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকার এদেশের অন্নদাতা চাষীদের পুঁজিপতি হায়নার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তা এদেশের চাষীরা সহজে মেনে নিতে পারছে না৷ তাই এই আন্দোলনের আগুন দাবানলের মত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে৷

এরমধ্যে ১০ই জানুয়ারী হরিয়ানার বিজেপি জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী খট্টরের ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’ সভা আন্দোলনকারী কর্ষকেরা তছনছ করে দিল৷ সভাস্থলে হেলিকপ্ঢারে করে নামতেই পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী৷ বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে হরিয়ানা সরকারের কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, লোহার ব্যারিকেড কোনোটাই কোনো কাজে লাগল না৷

কর্ষকরা এখন মরিয়া৷ কর্ষকদের আন্দোলনের চেহারা দেখে শীর্ষ আদালতও কেন্দ্রীয় সরকারকে তিন কৃষি আইন আপাততঃ স্থগিত রাখতে নির্দেশ দিয়েছে৷

কেন্দ্রীয় সরকার যদি কৃষিপ্রধান ভারতের কর্ষকদের দাবীর প্রতি কর্ণপাত না করেন তাহলে সারা দেশ জুড়ে তার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক৷ এই অশনি সংকেত যেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বুঝতে অসুবিধা না করে৷