ডাকাতে কালী

লেখক
প্রণবকান্তি  দাশগুপ্ত

বাংলাদেশে এককালে ডাকাতদের দৌরাত্ম্য ছিল অপ্রতিহত৷ মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, লাল চোখ, মুখে মুখোশ, হাতে তৈলাক্ত লম্বা লাঠি, কারো হাতে ধারালো রামদা বা কুঠার, রাতের অন্ধকারে ‘হারে রে রে’ শব্দে ডাকাতি করে রণপায়েপালিয়ে যাওয়া---সেকালের সেইসব ডাকাতদের কথা মনে পড়লে কার না গা ছমছম করে৷

সেইসব ডাকাতরাই আবার খুব কালী মায়ের ভক্ত হত৷ ডাকাতির  কাজে শক্তি চাই৷ তাই শক্তির পুজো৷ তাদের আরাধ্য কালীরা আজো অনেক জায়গায়  ডাকাতে কালী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে৷

এককালে কাঁচড়াপাড়ার বীজপুর ছিল গভীর অরণ্যে আকীর্ণ৷ ঐ  অরণ্যে ডাকাতদের আস্তানা ছিল৷ বিখ্যাত রঘু ডাকাতের কোন সঙ্গী এই অরণ্যে বাস করত বলে অনেকে মনে করেন৷ ডাকাতরা একটি নিমগাছকে  সিঁদুর চন্দন মাখিয়ে কালীজ্ঞানে পুজো করত৷ নরবলি দিত৷ উত্তর প্রদেশের এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণের উদ্যোগে স্থানীয় লোকের অর্থসাহায্যে ওখানে পরে মন্দির গড়ে ওঠে৷ সেটিই আজ  কাঁচরাপাড়ার ডাকাতে কালী নামে প্রসিদ্ধ৷

হুগলি জেলার বলাগড়ের পর কেলেগড় বা কালীগড়৷ কালীর গড় আছে বলেই জায়গাটির নাম কালীগড়৷ অপভ্রংশের ফলে হয়েছে কেলেগড়৷ এখানেও ছিল গভীর অরণ্য৷ সেই অরণ্যে বাস করত  বিখ্যাত ডাকাত দল৷ ডাকাতরা কালীমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করে পুজো করত এবং নরবলি দিত৷

হুগলি জেলার সিঙ্গুরে কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে৷ মল্লিকপুরের কালীমূর্তি ডাকাতে কালী নামে বিখ্যাত৷ অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীর  হুগলী জেলা ছিল ডাকাতদের স্বর্গরাজ্য৷ তখনকার গগন সর্দারের নাম শুনলে কার না হৃদকম্প হত? চারিদিকে ছিল ঘনজঙ্গল৷ রাতে শোনা যেত বাঘের গর্জন৷ গগন সর্দারের দল সেই বনে একটা গাছে ঘট স্থাপন করে দেবীর পুজো করত ও নরবলি দিত৷ কেউ কেউ অবশ্য  সিঙ্গুরের ডাকাতে কালীর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে রঘু ডাকাতের কথা বলে থাকেন৷ বীরভূম-বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর অঞ্চলে এককালে ভীষণ ডাকাতের উপদ্রব ছিল৷ ডাকাতরা প্রায় সকলেই ছিল শক্তির সাধক ৷ তাদের আরাধ্যা দেবী কালী৷ ডাকারা দেবীপ্রতিমা, ঘট, বা  কোন প্রতীকের সামনে নরবলি দিত৷ বিষ্ণুপুরের অন্তর্গত ময়নাপুর গ্রামে ডাকাতকালী আছে৷ ডাকাতকালীর প্রতীক হিসাবে আছে নরমুণ্ডের ওপর স্থাপিত সিঁদুর মাখানো ত্রিশূল৷ ওখানে খুব ধুমধাম সহকারে কালীপূজো হয়ে থাকে৷

বাঁশবেড়িয়া ত্রিবেণীর কাছেই বাগাটি৷ পূর্বনাম বাঘাটি৷ একশ দেড়শ বছর আগে স্থানটি ছিল নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ৷ ডাকাতদের ঘাঁটি৷ তাই ভয়ে এই গ্রামে লোকজন বসবাস করত না৷ জঙ্গলে ডাকাতি করত রঘু ডাকাতের ভাই বুধো ডাকাত৷ এই বুধো ডাকাতই বাগাটির  কালী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ বাগাটির এই সিদ্ধেশ্বরী কালী নাকি খুবই জাগ্রত৷ শোনা যায়, বুধো ডাকাত ডাকাতি করতে যাবার আগে দেবীর কাছে মানত করে যেত৷ অধিকাংশ ডাকাতিতেই সফল হত৷  কিন্তু একবার বুধো সর্দার ডাকাতিতে ব্যর্থ হয়৷ তার বিশ্বস্ত কিছু সাকরেদ ধরা পড়ে , কিছু মারা যায়৷ সে নিজে কোনক্রমে প্রাণে রক্ষা পায়৷ ব্যর্থতাজনিত ক্রোধে সে খড়্গাঘাতে দেবীর অঙ্গহানি করে৷ পরে নাকি স্বপ্ণাদেশে অবশ্য সেই ক্ষত অঙ্গ আবার মেরামত করা হয়৷ বুধো সর্দার এই দেবীর সামনে নরবলি দিত৷ এবার বলি সাতভিয়া কালীর কথা৷ প্রায় ‘শ’ দেড়েক বছর আগে বারাসাত মহকুমার বনগাঁয় সাতভাইয়ের একটি ডাকাত দল ছিল৷ তাদের ছিল একটি মাত্র বোন৷ ঐ সাত ডাকাত তাদের বোনকে নিয়ে ডাকাতি করতে যেত৷ তারা সাধারণত নৌকায় চড়ে ডাকাতি করত৷ তারা ছিল কালীর ভক্ত৷ একটি বটগাছের নীচে তারা কালীমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তারা কালীর পুজো করত৷ মাঝেমধ্যে নরবলি দিত৷ সাত ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত কালী বলেই এর নাম হয়েছে ‘সাতভিয়া’ কালী অর্থাৎ সাত ভাইয়ের কালী৷

দেড়শ দুশ বছর আগে হুগলি জেলার আরামবাগ ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ৷ ছিল ডাকাত আর ঠ্যাঙারেদের উৎপাত৷ চক্রপুরের কাঞ্চন ডাকাত আর পঞ্চু ডাকাতদের স্মৃতি আজো মানুষের মন থেকে মোছেনি৷ এদের ডাকাতির ক্ষেত্র ছিল বহুদূর বিস্তৃত৷ তবে চক্রপুরের ডাকাতরা কখনো নারী নির্যাতন করত না৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপরও অত্যাচার করত না৷ অকারণে নরহত্যা করত না৷ কারণ এদের ধারণা ছিল, এইসব পাপ কাজ করলে তাদের ওপর মায়ের অভিশাপ বর্তাবে৷ চক্রপুরের ডাকাতরা ছিল কালীমায়ের ভক্ত৷ তারা ঘট স্থাপন করে কালীপুজো করত৷ পুজোর যাবতীয় আয়োজন হত ডাকাতির টাকায়৷ আজো তাই দেবীপূজোয়  যে কোন চোরাই বস্তু অর্ঘ্য হিসাবে দিতে হয়৷

চবিবশ পরগণার ভাতেণ্ডাকালী ডাকাতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত৷ মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে৷ লোকে  বলে ডাকাতে পুকুর৷

কলকাতার চিত্রেশ্বরী দেবী যে কোনকালে কার দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল বলা যায় না৷ কিংবদন্তী শোনা যায় ইনি চিত্ত বা চিতে ওরফে  চিত্রেশ্বর নামক দস্যু দলপতির দ্বারা স্থাপিত৷ তার নামানুসারেই দেবীর নাম হয়েছে চিত্রেশ্বরী৷ ডাকাত সর্দার চিত্রেশ্বরী দেবীর পুজো করে সম্মতিসূচক আশীর্বাদ পেলে তবেই ডাকাতিতে বের হত৷