দধীচি দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

তাহারা যুগে যুগে আসে

বিধাতার নির্দেশে

সত্য, ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাগি

পরার্থে সর্বস্ব ত্যাগি’

মৃত্যুসাথে করে আলিঙ্গন৷

সশ্রদ্ধ চিত্তে তাহাদের করি’ স্মরণ

নিতে হবে সবে কঠিন শপথ

জগৎ কল্যাণে দধীচি-ব্রত৷

কালচক্র এগিয়ে চলেছে অনাদি থেকে অনন্তের পথে৷ এই অনন্ত চলার পথে সমাজে আসে বহুমাত্রিক পরিবর্তন৷ সময়ের ধারাপ্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজজীবনে সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকারের খেলা চলে৷ মানুষ সমাজবদ্ধ জীব৷ নিজের প্রয়োজনেই মানুষ সমাজ সৃষ্টি করেছে৷ মানব সমাজের কল্যাণে বিভিন্ন সময়ে বহুবিধ নিয়মনীতিরও প্রচলন হয়েছে৷ কিন্তু সমাজ জীবন বা মানব জীবন সরলরৈখিক গতিতে চলে না---জীবন প্রবাহে আসে উত্থান-পতনের তরঙ্গায়ন৷ এই কারণেই মাঝে মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলার চরম বিচ্যুতিতে সমাজে দেখা দেয় ঘোর অন্ধকার৷ একশ্রেণীর মানুষের লোভ ও অন্যায়ের শিকার হয় সাধারণ নিরীহ ধর্মাশ্রয়ী মানুষজন৷ নিপীড়িত মানবতার আর্তনাদে দিগবিদিগ হয় ব্যাপ্ত৷ এই পরিস্থিতিতে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে অপরের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার মানসিকতা তীব্রভাবে জেগে ওঠে৷ এইসব পরোপকারী মানুষেরা নিঃস্বার্থভাবে জগৎকল্যাণে এগিয়ে আসেন৷ নিজেদের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে তারা অপরের মঙ্গল সাধনের ব্রত গ্রহণ করেন৷ তাদের এই কর্তব্য পালনের ও ধর্মযুদ্ধের পথে যদি মৃত্যুও আসে তারা তা অবলীলাক্রমে বরণ করে৷ এই মানসিকতাসম্পন্ন মানুষগণকে সংসৃকতে দধীচি বলা হয়৷ পুরাণে কথিত আছে ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত বৃত্রাসুরের দাপটে যখন দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ করছেন তখন মহর্ষি দধীচি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন৷  প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা দধীচির দেহাংশ দ্বারা নির্মিত বজ্রস্ত্রের আঘাতে ভয়ংকর অসুরকে হত্যা করেন ও স্বর্গরাজ্য ফিরে পান৷ এটি একটি শিক্ষণীয় গল্প৷ দুষ্ট, অহংকারী, অধার্মিক, অত্যাচারীর হাত থেকে মানব সমাজকে পরিত্রাণ  করার জন্যে যুগে যুগে যে সকল ধার্মিক সত্যাশ্রয়ী, নীতিবাদী মানুষেরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হন ও আত্মবলিদান দেন, তাদেরও দধীচি নামেই অভিহিত করা যায়৷ এইসব মহাত্মা দধীচিকুলের  ত্যাগ ও তিতিক্ষার পূতাগ্ণির স্নিগ্ধ আলোকে মানুষের মনে জগৎকল্যাণের ভাবনা জাগ্রত হয়ে সমাজের দীর্ঘস্থায়ী প্রভূত উপকার সাধিত হয়৷

আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ সুদূর অতীত থেকেই আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যমণ্ডিত, মৈত্রী ও সম্প্রীতির আদর্শে সমৃদ্ধ দেশ৷ এই দেশের সাধক, মণীষী, মুনী-ঋষিগণ মানুষকে প্রেম, প্রীতি ভালবাসা ও মিলনের শিক্ষাই দিয়ে এসেছেন বহুকাল ধরে৷ তাঁদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, ত্যাগ-সেবা এই দেশকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে৷ এই জন্যে যুগে যুগে বহু মানুষের দল বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে এদেশে এসেছেন শান্তির ও ভালবাসার আকর্ষণে৷ তবে কালের বিবর্তনে সময়ের ব্যবধানে মানুষের জীবনে ও মনে  দেখা দিয়েছে পরিবর্তন৷ বিশ্বায়নের যুগে, গতিময়তার প্রাবল্যে, বিজ্ঞানের অবদানে সমগ্র পৃথিবী আজ মানুষের হাতের মুঠোয়৷ চতুদির্েক ছড়ানো-ছিটোনো সহজলভ্য বিলাস-ব্যসনের উপকরণ৷ চটকদারি ভোগ বিলাসের জীবন ও স্বাচ্ছন্দ্যের মোহময়ী আগ্রাসন মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে---যেন হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে৷৷ অতীতের ঐতিহ্যকে ভুলে মানুষ ভোগের পিছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত, বিধবস্ত৷ একশ্রেণীর মানুষ ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়, বিশাল অট্টালিকা, ভোগ্যবস্তুর হাজারো আয়োজন৷ আর তাদের দুর্নীতি ও শোষণের শিকার হচ্ছে বৃহত্তর জনসমুদায়৷ কোটি কোটি মানুষ অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা বাসস্থানের অভাবে অমানুষিক যন্ত্রণায় কালাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে৷ অশিক্ষা-কুশিক্ষার প্রভাবে কুসংস্কার ও ভাবজড়তার অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়ে ধূর্ত, স্বার্থপর শোষকের হাতের পুতুলে পরিণত হচ্ছে৷ এইসব বঞ্চিত, শোষিত মানুষগুলো প্রতিনিয়ত পরিত্রাণের পথ খঁুজে চলেছে৷ একদিকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, সামান্য লাভের আশায় সমস্ত রকম সামগ্রীতে ভেজাল---আর অন্যদিকে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে জল, স্থল, অন্তরীক্ষে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়িয়ে এই সব দুষ্ট নরপিশাচের দল সমগ্র সমাজকে পঙ্কিলতার আবর্তে ডুবিয়ে ধবংসের পথে নিয়ে চলেছে৷ তাদের শোষণের যন্ত্রটাকে সচল রাখার জন্যে সাধারণ জনগণের মধ্যে জাত-পাত, বর্ণ-গোষ্ঠী, ধর্মমত-সম্প্রদায়গত ভেদাভেদের বিষবাষ্প নিক্ষেপ করে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলেছে৷ লোভী পুঁজিবাদী শোষকদের এই সর্বনাশা কর্মকাণ্ডে সহায়করূপে পেটুয়া সংবাদ মাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছে৷ তারা সমাজের মধ্যে আরো বেশী বিভাজন, অহিষ্ণুতা, হিংসা, ভয় ছড়িয়ে দিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে৷ শুধু তাই নয়, তাদের এই অপকর্মের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন তাঁরা হয় দেশদ্রোহী নতুবা বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে যাচ্ছেন ওই সব দুষ্ট ও ভণ্ডদের চক্রান্তে৷

বিংশ শতাব্দীতে একদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শোষণের ষ্টীমরোলার আর অন্যদিকে জড়বাদী কমিউনিজমের অমানবিকতা ও অসংবেদনশীলতার চাপে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, মানুষ প্রায় জড়ের পর্যায়ে পর্যবসিত---সেই যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হলেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ হতাশা জর্জর মানুষের কল্যাণে প্রবর্তন করলেন ‘আনন্দমার্গ’ দর্শন৷  ভারতীয় সংসৃকতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তি যে আধ্যাত্মিকতা, যা ক্রমশ বিলীয়মান অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল, আনন্দমার্গ দর্শনের সোণার কাঠির পরশে তার মধ্যে আবার নতুন প্রাণের সঞ্চার হ’ল৷ আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতির মাধ্যমে নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মধ্যে তিনি জাগিয়ে তুললেন আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ৷ আনন্দমার্গের সহজ, সরল, ও বিজ্ঞানসম্মত সাধনা পদ্ধতির আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এলেন ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রহণ করলেন আধ্যাত্মিক জীবন চর্যার নিগূঢ় পাঠ৷ পুঁজিবাদী ধনতন্ত্র ও জড়বাদী কমিউনিজমের শোষণ ও নিপীড়নের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে ১৯৫৯ সালে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করলেন সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন---‘প্রাউট’ বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷

মানবজাতির ইতিহাস পর্র্যলোচনা করে দেখা যায় যে সর্বদাই মনুষ্যসমাজে  শুভ ও অশুভ উভয় প্রকার শক্তি ক্রিয়াশীল থাকে আর  এই বিপরীতধর্মী শক্তির মধ্যে চলে নিরন্তর সংগ্রাম৷ মানবজাতির এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় অধিকাংশ  সময় অশুভশক্তির প্রাবল্য পরিলক্ষিত হলেও শুভশক্তির প্রবাহ নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে গেছে অন্তঃসলিলারূপে ৷ তা না হলে মনুষ্যনামক প্রাণী অন্যান্য বৃহদাকার অগণিত প্রাণীকুলের মতো পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেত৷ তাই যখনই অশুভ শক্তির চরম আঘাতে মানব সমাজের অস্তিত্ব ধবংসের মুখোমুখি হয়েছে তখনই কোন এক মহান পুরুষের আবির্র্ভব ঘটেছে৷ সেই মহাসম্ভূতির নেতৃত্বে সকল শুভ শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে চন্ডশক্তি তথা পাপ শক্তির বিনাশ ঘটেছে ও বিশ্বে সাত্ত্বিকী শান্তি  ফিরে এসেছে৷ এছাড়া মানুষ বিচারশীল, বিবেক প্রধান জীব হওয়ায় ব্যষ্টিগতক্ষেত্রেও প্রতিটি মানুষের মধ্যে প্রতিমূহূর্তে চলেছে শুভ-অশুভের লড়াই৷  মানব মনের এই শুভ ভাবনাগুলোর উন্মেষের জন্যে,  মানবসমাজের মঙ্গল সাধনে যখনই কোন ব্যষ্টি বা সংঘটন  উদ্যোগী হয়েছে তখনই পাপশক্তি ও পশুশক্তির আক্রমণ নেমে এসেছে তাঁদের ওপর নির্র্যতন, নিপীড়ন, কুৎসা, এমনকি মৃত্যুরূপেও৷ মানুষের ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে ও সমগ্র মানব সমাজের মঙ্গল সাধনে নিবেদিত অধ্যাত্মবাদী সংঘটন আনন্দমার্গের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ ১৯৫৫ সালে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের জন্ম লগ্ণ থেকেই সম্মুখীন হতে হয়েছে বহুবিধ সংঘাত ও প্রতিকুলতার৷ অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের ধবজাধারীরা এই সংঘটনে প্রচার,  প্রসার ও  সাধারণ মানুষজনের  অকুন্ঠ সমর্থনে  ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে ও আনন্দমার্গের সর্র্বত্মক বিরোধিতায় সর্বশক্তির প্রয়োগ করে৷  কিন্তু পাপশক্তির বাধাবিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে সংঘের নিঃস্বার্থ ,সৎ, নীতিবাদী, একনিষ্ঠ, দৃঢ় সংকল্প কর্মীগণ মানবজাতির কল্যাণে সেবামূলক প্রকল্পগুলির রূপায়ণে আত্মনিয়োগ করেন৷

বিশ্বজুড়ে বহুমুখী সেবাকার্য পরিচালনার জন্যে সংঘটনের একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও বিশাল সেবাকেন্দ্র স্থাপন করার প্রয়োজন অনুভূত হয়৷ এই উদ্দেশ্যে পুরুলিয়া জেলার গড়জয়পুরের   রাজা রঘুনন্দন সিংদেও-এর পত্নী রাণী প্রফুল্লকুমারী দেবীর  দান হিসাবে বাগলতা মৌজার জমিটি এই মহৎ কাজের জন্যে সংঘকর্তৃপক্ষ  গ্রহণ করেন৷ ঘন জঙ্গল পরিবেষ্টিত পাথুরে টিলা ও ডুংরি সন্নিবিষ্ট অঞ্চল নির্বাচন ও সেখানে সংঘের প্রাণকেন্দ্র আনন্দনগর প্রতিষ্ঠার পিছনে কতকগুিিল বিশেষ কারণ ছিল৷

প্রথমত ঃ সাবেক মানভূম জেলার এই অঞ্চলটি বিশ্বের সর্বপ্রাচীন ভূমি রাঢ়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ পরবর্তীকালে এখানে ডায়নোসরের  ফসিলও পাওয়া গেছে৷  এককালে সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, দামোদর, ইত্যাদি নদী ও এদের শাখানদী - উপনদীর তীরে তীরে এই অঞ্চল ও সন্নিহিত চতুষ্পার্শ্বস্থ অঞ্চলে ব্যবসাবাণিজ্য কেন্দ্র ও  সংসৃকতির পীঠ গড়ে উঠেছিল৷  এই অঞ্চলের উন্নতি হলে  রাঢ়ের সমৃদ্ধ ও বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস  বর্তমান পৃথিবীর মানুষের সামনে উন্মোচিত হবে৷

দ্বিতীয়তঃ এই অঞ্চলের সুদীর্ঘ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য রয়েছে৷ শৈব, বৌদ্ধ ও জৈন তন্ত্রের বহু নির্দশন এই অঞ্চলের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন--- আনন্দনগর হচ্ছে সাধনার জন্যে পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান৷ এখানে নদীর তীরে, কোন পাথরের উপর, পাহাড়ের উপর বসে সাধনা করলে  মুহূর্তেই মন একাগ্র হয়ে যাবে৷  এছাড়া এই অঞ্চল মহাসম্ভূতি সদাশিব ও শ্রীকৃষ্ণের চরণস্পর্শে ধন্য আর  তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন ‘‘আমি আনন্দনগরের আনন্দমূর্ত্তি’’৷ আনন্দনগর এলাকায় শতাধিক তন্ত্রপীঠ ও গুহা আবিষৃকত হয়েছে যেখানে বহু হাজার বছর ধরে বহু মুনি-ঋষি-সাধক তন্ত্র সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন৷   তিনি তাঁর ‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’ গ্রন্থে এও বলেছেন---

‘‘ মানব সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়, মানব সংসৃকতির চক্রনাভি রাঢ় ৷ সেই রাঢ় আবার স্বীয় গৌরবে উদ্ভাসিত হোক৷  সেই রাঢ় আবার ফলে-ফুলে -সম্পদে, মানবিকতায়- আধ্যাত্মিকতায় উপচে পড়ুক৷ তার চলার পথের কুজ্ঝটিকার আবরণ সরে যাক, তার বিষাদ মলিন মুখে হাসির ঔজ্বল্য ফুটুক৷ ’’

তৃতীয়ত ঃ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা হচ্ছে সবচেয়ে অনুন্নত জেলা আর পুরুলিয়ার ঝালদা ও  গড়জয়পুর ব্লক  সর্র্বপেক্ষা উপেক্ষিত৷  এই অঞ্চলের মানুষের কাছে  শিক্ষা-দীক্ষা-উন্নয়নের সুফল ছিল সুদূরপরাহত৷  তাই  আনন্দনগরে স্কুল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, ছাত্রাবাস, শিশুসদন, কৃষিগবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে উঠলে তার সুফল এইসব স্থানীয় মানুষজনের সেবায়  বিস্তৃত হবে ও তাঁদের শিক্ষা-সংসৃকতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি বিধান  সম্ভব হবে৷

যাইহোক, রাণী প্রফুল্লকুমারী দেবীর মহৎ দানে এই ভূমিখন্ডটি আনন্দমার্গ সংঘটনের হাতে আসা মাত্রই সেবামূলক প্রকল্প রূপায়নের কাজ শুরু হয়ে গেল৷ সেবাব্রতী সন্ন্যাসীগণ, অন্যান্য সর্বক্ষণের কর্মীদল ও আনন্দমার্গের সাধারণ ভক্ত সম্প্রদায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় কর্মযজ্ঞে সামিল হলেন৷ মানুষের দানে মানুষের কল্যাণে একে একে গড়ে উঠতে লাগল বিদ্যালয়, কলেজ, অনাথ-আশ্রম, ছাত্রাবাস, হাসপাতাল, কুষ্ঠাশ্রম, প্রেস ইত্যাদি৷ এই বিশাল কর্মকান্ডে স্থানীয় মানুষেরাও যোগদান করলেন , তাদের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার আলো পেতে শুরু করল, হাসপাতালের মাধ্যমে  চিকিৎসার ব্যবস্থা হল, দুঃস্থ শিশুরা হোমে থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ পেল৷ সংঘের কর্মীবর্গ দিনরাত পরিশ্রম করে জঙ্গল কেটে, পাথর ভেঙ্গে যাতায়াতের রাস্তাঘাট  তৈরী করতে লাগলেন৷  সামগ্রিকভাবে আনন্দনগর ও চারপাশের গ্রামগুলিতে  উন্নয়নের জোয়ার গ্রামবাসীদের কাছে আশীর্বাদ রূপে নেমে এল৷ স্থানীয় মানুষেরা মার্গের সেবাপ্রকল্পগুলির ব্যবস্থাপনায় উপকৃত হয়ে মার্গের ঘনিষ্ট হতে শুরু করলেন৷ এইসবের ফলে  গ্রামগুলির দাদনদার ধনী ব্যষ্টিদের স্বার্থে ঘা লাগল  কারণ  তাদের মৌরসীপাট্টা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছিল৷  স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে জোট বেঁধে সংঘের কাজ কর্ম বন্ধ করার ফন্দি ফিকির খঁুজতে লাগল৷ সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল যুক্তফ্রন্টের শাসনাধীন---কমিউনিষ্ট দল সিপি.এম-সি.পি.আই ছিল যার মুখ্য চালিকা শক্তি৷ জড়বাদী কমুনিষ্টরা শুরু থেকেই  অধ্যাত্মবাদী আনন্দমার্গের বিরোধিতায় ছিল এক পায়ে খাড়া৷  তাঁরা তাদের পছন্দমত কমিউনিষ্ট মতানুসারী অফিসারদের মাধ্যমে  আনন্দমার্গ সংঘটনের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টা  সর্বদাই করে গেছে৷  গড়জয়পুরের বিডিও অশোক চক্রবর্তী ছিলেন কট্টর কমিউনিষ্ট সমর্থক ও আনন্দমার্গের প্রতি সম্পূর্ণ বিদ্বেষভাবাপন্ন৷ স্থানীয় ব্লকের উচ্চতম কর্র্ত হয়েও আনন্দনগরের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে কোনরকম মাতববরী করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না৷ বিভিন্ন প্রকল্পের কোন বোর্ড বা কমিটিতে তাঁর কোন স্থান হয় নি--- আনন্দমার্গ সংঘটনের এই ধৃষ্টতার যথাযোগ্য জবাব দেওয়ার জন্যে তিনিও কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন৷ সরকারী জিপে চড়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে পঞ্চায়েত প্রধান, সদস্য ও নেতা মাতববরদের সহায়তায় সরল গ্রাম্য মানুষজনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে শুরু করলেন৷ বাছাই করা লোকেদের সরকারী প্রকল্প গুলির সুবিধা পাইয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলেন ও সংঘের ওপর চরম আঘাত হানার  প্রস্তুতি চালাতে লাগলেন৷ এইভাবে আনন্দনগরে আক্রমণের  চক্রান্তের নিখঁুত পরিকল্পনা সেরে বিডিও অশোক চক্রবর্তী সব ঘুঁটি সাজিয়ে ফেললেন৷  শ্রী চক্রবর্তীর এই চক্রান্তের কথা সংঘ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় শুভানুধ্যায়ী মানুষজনের কাজ থেকে জানতে পেরে গড়জয়পুর ও ঝালদা থানার দারোগা, এস.ডি . ও, ডি .এস.পি ও পুরুলিয়ার ডেপুটি কমিশনারকে আক্রমণের আশঙ্কার বিষয়টি জানান ও যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলেন৷ ওই অফিসারেরা মুখে আশ্বাস দিলেও প্রকৃতপক্ষে কোনরকম সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন নি৷

অবশেষে সেই চরম মুহূর্তটি উপস্থিত হল৷ ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ, রবিবার, চরম আঘাত নেবে এল আনন্দনগরের বুকে৷ লোকমুখে সংঘের কর্মীগণ জানতে পারেন, ৪ঠা মার্চ ১৯৬৭, সারারাত ধরে  বাছাই করা ঘাতক শয়তানদের একত্রিত করে বিনা পয়সায় মদ ও মাংসের ভোজ খাওয়ানো হয়৷ পরদিন সকাল ১০ টা নাগাদ বিডিওর জহ্লাদ বাহিনী আনন্দনগরের পশ্চিমদিকের বনের পথে ধামসা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে টাঙ্গি, বল্লম, তীরধনুক, তলোয়ার ও আরও অনেক মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়৷ নরপিশাচদের  এই সংঘটিত নৃশংস আক্রমণে প্রায় ২৫ জন সংঘকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন ও  ৫ জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী --- আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, শ্রী অবোধ কুমার, শ্রী প্রভাস কুমার ও শ্রী ভরত কুমার নিহত হন৷ ঘাতক বাহিনী আনন্দনগরকে ধবংসস্তূপে পরিণত করে সন্ন্যাসীদের হত্যা ও মারাত্মক জখম করে, তাঁদের আরব্ধ কাজ সুসম্পন্ন করে  ফিরে যাবার সময়ে পুলিশ নড়াচড়া শুরু করে ও লোকদেখানো এক রাউন্ড শূণ্যে গুলিও ছোড়ে৷ এরপর আরম্ভ হয় প্রশাসনের দিক থেকে ঘটনাটি চাপা দেওয়ার  ও  জনরোষের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে  দেখানোর৷ সরকারের সর্র্বেচ্চ মহল থেকেও  এই মামলাটিকে খারিজ করার অপচেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু সংঘ কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজনের মিলিত প্রয়াসে কুচক্রী বিডিও অশোক চক্রবর্তীর ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও অন্যান্য ৮ জনের  যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়৷

 পাপ শক্তির আক্রমণে ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ,  বসন্তকালীন পলাশের আগুন ঝরানো প্রাকৃতিক পরিবেশে  সত্য, ধর্ম, সেবা ও আদর্শে র জন্যে পঞ্চদধীচি আত্ম বলিদান দিলেন৷ একইভাবে আনন্দনগরের পঞ্চদধীচি ও পরবর্তীকালে আরও আনন্দমার্গের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে জীবন উৎসর্গকারী দধীচিগণের আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়নি৷ মানবতার সেবায়  নিবেদিত আনন্দমার্গ পৃথিবীর ১৮২ টি দেশে প্রসারিত হয়ে জগৎ কল্যাণে বহুমুখী  কর্মধারার ব্যাপ্তি ঘটিয়ে চলেছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ  আনন্দমার্গের প্রদর্শিত পথে সাধনা ও সেবার মাধ্যমে মানব জাতির কল্যাণে ব্রতী হয়েছেন৷ পাপশক্তির আঘাত, আক্রমণ, চক্রান্ত আনন্দমার্গের গতিকে রুদ্ধ করতে পারে নি৷ বরং সংঘটনের ওপর যত বড় আঘাত এসেছে, আনন্দমার্গের বিজয়রথ  ততই দ্রুততার সঙ্গে  তার লক্ষ্যের পানে এগিয়ে গিয়েছে৷ অগণিত ভক্তগণ,  মানবতার পূজারী, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষেরা  অমর দধীচিগণের আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বসেবার মহান ব্রতে আত্মনিয়োগ করে চলেছেন৷  আর সেই নরকের কীট নরাধম দুর্বৃত্তের দল ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেতে বসেছে৷  অপরপক্ষে পরার্থে জীবনদানকারী  দধীচি গণের মহৎ আদর্শের অনির্বাণ দীপশিখা যুগ যুগ ধরে  মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল আলোকধারায় উদ্ভাসিত করে নব্যমানবতার আদর্শে মানুষ-জীব-জড়-উদ্ভিদসহ সমগ্র সৃষ্ট জগতের সেবায় এগিয়ে চলতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে ও ভবিষ্যতেও জোগাতে থাকবে৷  অন্তরের আলোয় দীপ্ত এই মানুষদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়  একদিন আনন্দমার্গ ও প্রাউট প্রতিষ্ঠিত হবেই আর  শোষণহীন সুন্দর মানব সমাজও গড়ে উঠবেই৷  এই মর্মে স্মরণ করি তারকব্রহ্ম  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর শাশ্বত বাণী---

‘‘অন্ধকার যতই ঘন হোক না কেন, তারপর প্রভাত আসবেই৷ অন্ধকারের পিশাচ যতই অট্টহাসি হাসুক না কেন, সূর্র্যেদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তার সবকিছু শূন্যে মিলিয়ে যাবেই যাবে৷ তেমনি মানুষজাতির দুঃখের রাত্রি যে রকমই হোক না কেন, তপস্যার সূর্র্যলোক তার সমস্ত  অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেবেই দেবে৷ মানুষের জীবনে অরুণোদয় হবেই হবে৷’’