দেবযোনি মাইক্রোবাইটাম

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

পাঞ্চভৌতিক শরীর গঠিত হয় ক্ষিতি, অপ, তেজ,  মরুৎ ও বোম এইপঞ্চভূতের সমন্বয়ে৷ এখন যেহেতু পঞ্চভৌতিক উপাদানে গঠিত শরীরে ক্ষিতিভূত ও অপভূত বর্তমান আছে অতএব এই শরীরকে  রক্ষা করার জন্যে খাদ্য ও জলের নিশ্চয়ই প্রয়োজন হবে ও স্থূল শরীরে স্নায়ু কোষ Nerve  cell) থাকবে ও নার্ভসেলের সাহায্যে মন mind) কাজ করবে৷ কিন্তু যাদের  ত্রিভৌতিক  শরীর অর্র্থৎ তেজভূত, মরুৎভূত ও বোমভূত নিয়ে যাদের শরীর গঠিত তাদের শরীরে যেহেতু ক্ষিতি ও অপ এই দুটি ভূত নেই, সুতরাং  এই ত্রিভৌতিক শরীরের  জন্যে খাদ্য  ও জলের প্রয়োজন নেই৷ অর্র্থৎ এদের শরীরে  কোন নার্ভ সিস্টেমের প্রয়োজন  হয় না৷ কারণ  নার্ভ  দরকার  হয় কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক  শরীরের জন্যে৷ এরূপ ত্রিভৌতিক শরীরকে বলে ‘দেবযোনী’ মাইক্রোবাইটাম৷ দেবযোনী শব্দটির মানে  দেবসুলভ গুণের সমাবেশ৷

মাইক্রোবাইটাম একটি অতিসুক্ষ্ম জীব৷ এদের মধ্যে যারা স্থূলতম তাদের  দ্বারাই মহাকাশ  হ’তে জীবপ্রাণ উৎসারিত হ’য়ে এসেছে ও এসেছে প্রাণ স্পন্দন৷ যে সকল মাইক্রোবাইটাম আরও সূক্ষ্ম অর্থাৎ অতি শক্তিশালী  অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা পড়ে না, তারা দুই প্রকারের  হয়৷ 

(১) এক প্রকারের মাইক্রোবাইটাম কাজ করে অনুভূতিতে  অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ  এই পাঁচটি তন্মাত্রের মাধ্যমে ৷ (২) আর একধরনের  মাইক্রোবাইটাম  কাজ করে আরও সূক্ষ্মতর লোকে অর্থাৎ মানসিক সংবেদনে৷

এখন ত্রিভৌতিক শরীর Luminous body) এতটাই সূক্ষ্মতর যে, এদের শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা যায় না কিন্তু তন্মাত্রে অণুভূত হয়৷ এই  কারনেই ত্রিভৌতিক  শরীরকে দেবযোনি  মাইক্রোবাইটাম বলা হয়৷ এই মাইক্রোবাইটামেরা কারুর কোন ক্ষতি করে না, উপরন্তু উপকার করে  তাই এরা পজেটিভ মাইক্রোবাইটাম  বলে বিবেচিত হয়৷

এই যে ‘দেবযোনি’ এরা ভূত-প্রেত নয়, ভূত-প্রেতের  সঙ্গে এদের কোন  সম্পর্ক নেই৷ এখন, কোন অবস্থায় যদি  কোন মানুষ এই ধরণের  দেবযোনি কে দেখে ফেলে, সে ভাববে যে, সে ভূত দেখছে৷ কিন্তু  মোটেই ভূত দেখছে না৷ সে একটা দেবযোনি কে দেখছে৷ তবে  দিনের বেলায়  কখনও দেবযোনিকে দেখা যায় না৷ কখনও কখনও  রাতের অন্ধকারে এদের  কেউ কেউ  দেখে থাকেন৷ এই দেবযোনিরা  মানসিকতার ভিত্তিতে তৈরী হয়৷ ঐ দেবযোনিরা  সাতপ্রকারের হয়৷ এরা হ’ল---

১) যক্ষ ২) গন্ধর্ব ৩) কিন্নর ৪) বিদ্যাধর ৫) প্রকৃতিলীন ৬) সিদ্ধ ৭) বিদেহলীন৷

এখন, ধরা যাক, কোন মানুষ নিয়মিতরূপে ও ঠিক্ ঠিক্ ভাবেই সাধনা করছে৷ মনের মধ্যে নিষ্ঠা ও প্রেরণা এসবও আছে৷ এরূপ  সাধকের  মনে আধ্যাত্মিক ইচ্ছাও প্রবল ভাবে আছে৷ হয়তো প্রবল ইচ্ছা ছাড়াও কিছু সুপ্ত কামনা-বাসনার তাড়না রয়েছে৷ যেমন -কারো মধ্যে টাকা পয়সা, ধনদৌলত প্রভৃতির  প্রতি তীব্র কামনা-বাসনা  গোপনভাবে কাজ করছে৷ এই ধরনের  মানুষের  ক্ষেত্রে এদের মৃত্যুর পর আর পাঞ্চভৌতিক শরীর অর্র্থৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ,মরুৎ, বোম্ তত্ত্বে গঠিত শরীর পায় না৷ এরা ত্রিভৌতিক শরীর পায়, অর্থাৎ তেজ , বায়ু ও বোম তত্ত্বের দ্বারা গঠিত শরীর পায়৷ এরাই দেবযোনি নামে পরিচিত৷

যক্ষ ঃ যে সমস্ত মানুষ এমনিতে খুব ভাল, প্রত্যহ্য নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা ভজনা ক’রে  চলেছে ও সাধনার প্রতি বেশ আন্তরিকতাও  আছে, তথাপি এই মানুষের মধ্যে  যদি টাকা-পয়সার প্রতি তীব্র কামনা বাসনা  মনে গোপনভাবে থেকে যায়, তবে এই ধরনের  মানুষগুলো  ত্রিভৌতিক শরীর পায়৷ অর্থাৎ এই ধরনের মানুষগুলো মৃত্যুর পর এদের শরীরের ক্ষিতিতত্ত্ব ও অপতত্ত্ব ক্ষিতিমহাভূত ও অপমহাভূতে বিলীন হয়ে যায়৷ কিন্তু  বাকি তিনটি তত্ত্ব (তেজ, বায়ু ও বোম্) থেকে  যায় তার বিদেহী মনের সঙ্গে৷ এই তিনতত্ত্বে গঠিত বিদেহী মানস সত্তাকে  বলা হয় যক্ষ মাইক্রোবাইটাম ৷ এরূপ মাইক্রোবাইটামেরা  শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্রেও ধরা পড়ে না৷ যেহেতু এরা তন্মাত্রিক, তাই এদের অধিক্ষেত্র হ’ল মানব-মন৷ মানুষের মনে বিত্ত সঞ্চয়ের তীব্র আকুতি  এনে দেয় এই যক্ষ মাইক্রোবাইটাম৷ যে সমস্ত মানুষের মনের মধ্যে এই যক্ষ মাইক্রোবাইটা ভিড় করে তারাই এই অর্থ সঞ্চয়ের জন্য উন্মাদ, পাগল, হয়ে যায় ও কালক্রমে এরাই টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা হ’য়ে যায়৷ এই রোগটি যক্ষা রোগের  চাইতেও ভয়ঙ্কর রোগ৷ এই রোগের কারণেই মানুষ মানুষকে শোষণ  করে৷ এই যক্ষ রোগের  ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদ আর বৈশ্যের সর্বগ্রাসী অভ্রংলেহী বুভুক্ষা৷  এই যক্ষকে নিয়ে একটি প্রবাদ আছে--- ‘যক্ষের ধন’ বা ‘যখের ধন’৷

কিন্নর ঃ যে সমস্ত মানুষের রূপের অহংকার  আছে  অথবা পরমপুরুষের প্রতি মনোভাবকে গৌণ করে, রূপের জন্য লালায়িত হ’য়ে  পরম পুরুষের  কাছে প্রার্থনা করছে--- ‘‘আমায় রূপ দাও , রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’’ এই ধরনের ভাবনার দ্বারা  প্রেষিত হয়, তারা ত্রিভৌতিক ল্যুমিনাস  বডি পায়৷ এদেরই বলা হয় কিন্নর৷  এই সমস্ত কিন্নর মাইক্রোবাইটামেরা মানব মনে ঠাঁই নেয় ও মানুষের  রূপের  বাসনাকে  জাগিয়ে তোলে৷

গন্ধর্ব ঃ যে সমস্ত মানুষের উচ্চধরণের  সংগীতের মোহ আছে, তারা সাধারণতঃভাবে, সংগীত চর্র্চ্চ মানুষ বেশী করে করুক, পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে ৷ আর মনে মনে বলে হে পরমপুরুষ আমি তোমাকে চাই না, চাই শুধু সঙ্গীত বিদ্যা এই ধরণের মনোবৃত্তির মানুষ মৃত্যুর পর আর মানব জন্ম পায় না, পায় ত্রিভৌতিক শরীর৷  এরাই হ’ল গন্ধর্ব মাইক্রোবাইটাম৷

সিদ্ধ ঃ যে মানুষ সাধনা করছে পরম পুরুষের প্রতি ভালবাসাও খুব গভীর কিন্তু মনের মধ্যে  অহংকারের পাহার রয়ে গিয়েছে৷ গভীর সাধনার জন্য এই অবস্থায় মনে অলৌকিক শক্তি আসে৷ এই অলৌকিক শক্তির জন্য অহংকার আসে সাধকের মনে৷ এই সমস্ত সাধক মৃত্যুর পর আর মানব শরীর পায় না৷  পায় ত্রিভৌতিক শরীর অর্থাৎ ল্যামিনাস বডি পায় ৷ এরাই হল সিদ্ধ মাইক্রোবাইটাম৷

বিদ্যাধর ঃ যে সমস্ত মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অহংকার আছে অর্থাৎ এই ধরণের মানুষ পরমপুরুষের কাছে চাইছে  কেবল জ্ঞান, বিদ্যা, বলছে জ্ঞানং দেহি৷ এরূপ চিন্তা যুক্ত মানুষ মৃত্যুর পর এই ভাবনায় প্রেষিত হ’য়ে বিদ্যাধর দেবযোনিতে পরিণত হয়৷ এরাও একধরণের মাইক্রোবাইটাম৷

প্রকৃতিলীন ঃ যারা পৃথিবীর কোন বস্তুকে-মাটি হোক  যে কোনো ধাতুকে কিংবা মূর্ত্তিকে পরম পুরুষ জ্ঞানে পূজা করে বা সাধনা করে তারা শেষ পর্যন্ত সেই  স্বরূপই প্রাপ্ত হয় ৷ তাদের বলা হ’য় প্রকৃতি লীন৷

বিদেহিলীন ঃ যারা অলৌকিক শক্তির পেছনে ছুটে বেড়োয় আর ভাবে আমি অলৌকিক শক্তি পেয়ে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াবো, এরূপ মনের দ্বারা প্রেষিত ‘বিদেহীলীন’ ‘দেবযোনি’তে পরিণত হয়৷ এরা কিন্তু  কোনপ্রকার ভূত প্রেত নয়৷ এরা একধরণের মাইক্রোবাইটাম৷

এই সাত প্রকারের দোবযোনির মধ্যে সিদ্ধ মাইক্রোবাইট হ’ল সর্বোৎকৃষ্ট  দেবযোনিদের সিদ্ধের স্থান সর্র্বেচ্চ৷ কোথাও আধ্যাত্মিক সমাবেশ হলে সিদ্ধ মাইক্রোবাইটামরা সেখানে হাজির হয়ে যায়৷ সাধনায় সাধকের মন একাগ্র হলেও বা কীর্ত্তন করতে করতে  সাধকের মন একাগ্র হলে সাধক সিদ্ধের সান্নিধ্য  লাভ  করতে পারে৷