দিশাহীন কেন্দ্রীয় আয়-ব্যয় মাত্রিকা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

গত ১লা ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২০-২০২১ আর্থিক বৎসরের জন্যে আয়-ব্যয় মাত্রিকা (বাজেট) প্রকাশ করলেন৷ বর্তমানে দেশে যে অভূতপূর্ব আর্থিক মন্দা চলছে এই সমস্যার সুরাহার জন্যে কেন্দ্র কি পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারই প্রকাশ ঘটেছে এই আয়-ব্যয় মাত্রিকায়৷

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার মূল কারণ দু’টি৷ প্রথমটি হ’ল সম্পদের অতি সঞ্চয় বা অতিকেন্দ্রীকরণ আর দ্বিতীয় কারণ হ’ল, টাকার চক্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করা৷ দেশের মূলধনের বেশীর ভাগটা যদি মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতিদের হাতে সঞ্চিত হয় তবে জনগণের বৃহদংশ অল্প কিছু ব্যষ্টির দ্বারা শোষিত হয়৷ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় উৎপাদনেও ভাঁটা পড়ে৷ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়৷

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘অক্সফ্যাম-এর রিপোর্ট, এ দেশের সর্বমোট সম্পদের ৭৭.৪ শতাংশের মালিকানা আছে  দেশের সব থেকে ধনবান ১০ শতাংশ মানুষের কাছে৷ অপরদিকে সব থেকে গরীব ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ সম্পদ৷

সদ্য প্রকাশিত ক্ষুধা সূচকের তালিকায় ভারতের অবস্থান ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩ নম্বর স্থানে৷ বিস্ময়ের ব্যপার প্রতিবেশী  রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের স্থানও ভারতের চেয়ে ওপরে৷ অর্থাৎ ভারতের ক্ষুধার্ত মানুষের  হার এই দুই দেশের ক্ষুধার্তের হারের চেয়ে বেশী৷ গত ৪৫ বছরের মধ্যে বর্তমানে বেকারত্বের হারও সবচেয়ে বেশী৷ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত৷ জাতীয় উৎপাদনে কৃষির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ অথচ, প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজারেরও বেশী কর্ষক (কৃষক) অভাবের তাড়নায় বা ঋণভারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করছে ৷ এই অবস্থায় এই কর্ষকদের মুখে হাসি ফোটানো ও বেকার সমস্যা সমাধনটাই দেশের অর্থনৈতিক পরিরকল্পনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ অথচ বর্তমান আয়-ব্যয় মাত্রিকায় কৃষি ও কর্ষকদের দূরবস্থা দূর করার কোন আশাপ্রদ বার্তা নেই৷ মুখে প্রতিশ্রতুি দেওয়া হয়েছে, এ বছর কর্ষকদের রোজগার দ্বিগুণ করা হবে৷ অথচ কার্যত সে ধরণের কোন পরিকল্পনার উল্লেখ নেই৷ পরন্তু ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ও প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে৷ পি.এম. কিষাণ প্রকল্পেও বরাদ্দ বাড়ানো হ’ল না৷ গ্রামের গরীব ও কৃষিজীবী পরিবারগুলি এই সব প্রকল্পের দ্বারা কিছুটা উপকৃত হ’ত৷ তাই এই সমস্ত খাতে বরাদ্দ হ্রাস বা বৃদ্ধি না করা তাদের হতাশ করেছে৷ চাষীরা যাতে সারা বছর চাষ করতে পারে তার জন্যে সারা বছর সেচের জলের ব্যবস্থা করাটা কৃষি উন্নয়নের প্রধান অঙ্গ৷ সে ব্যাপারেও কোন আশার আলো তারা পায়নি৷ যাতে তারা আশানুরূপ ফসলের দাম পেতে পারে৷ এই ধরণের কোন কার্যকরী প্রতিশ্রুতিও নেই৷

দেশের ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রয়োজন ছিলে বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মধ্যেমে ব্যাপকভাবে কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্পের বিকাশের পরিকল্পনা নেওয়া৷ সরকার যে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের লগ্ণী টানার জন্যে মরিয়া, ওই পুঁজিপতিরা কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ নীতি মেনে কৃষি বিষয়ক শিল্পে উৎসাহী নয়৷ বেকার সমস্যা সমাধানে তারা বিন্দুমাত্র উৎসাহী নয়, তারা বরং যতদূর সম্ভব শ্রমিক নিয়োগ করে শিল্পস্থাপনে আধুনিকতম প্রযুক্তিতে বেশী আগ্রহী৷ তাই এই জন্যে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ও উৎপাদক সমবায়কে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত৷ কিন্তু সরকারের সেইদিকে নজর নেই৷ তাহলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে কী করে?

সরকার গরীব জনসাধারণের দিকে না তাকিয়ে বড় বড় শিল্পপতিদের সুবিধা দানের পথে হেঁটেছেন৷ তাই বর্তমান বাজেটে ৩৪ শতাংশ কর্পোরেট কর কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে৷ আর নূতন ম্যানুফ্যাকচারিং ইয়ূনিটের কর ২৫ শতাংশ থেকে ১৭.১৬ শতাংশ করা হয়েছে৷ ধনীরা অধিক সুযোগ-সুবিধা পেলে ও তাদের ব্যবসা বাড়লে তার সুফল সর্বসাধারণ পাবে৷ কার্যত এ তত্ত্ব অন্তত বেকার সমস্যা সমাধানে যে আদৌ ফলপ্রসূ হয়নি, তা সারা পৃথিবী জুড়ে প্রমাণিত৷ তাই আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ডের মত দেশেও ব্যাপক বেকার সমস্যা ও যুব অসন্তোষ৷

এবারে আয়-ব্যয় মাত্রিকার ভাষণে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, এতদিন যে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবনবীমা সংস্থা  (এল.আই.সি.) সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল অর্থাৎ ১০০ শতাংশ শেয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল, এইবার তার কিছু অংশ বেসরকারী হাতে বিক্রি করে দেওয়া হবে৷ কত শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হবে পুরোপুরি না বললেও এতে স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণের মনে দারুণ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ত্ত্বাধীন বলে আশা করে তাঁরা যে তাঁদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় জীবন বীমা সংস্থায় গচ্ছিত রেখেছেন তা শেষ পর্যন্ত মার খাবে না তো! মুনাফাখোর পুঁজিপতিদের বহু বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটেছে৷ তাই এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি!

এদিকে আয়-ব্যয় মাত্রিকায় দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা খরচ বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের কিন্তু কার্পণ্য নেই৷ এ ব্যাপারে গত আর্থিক বর্ষে ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল৷ অবশ্য ইতোমধ্যে এ বাবদ ৫৪০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ ২০২০-২০২১-এ এই বাবদ ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্যে সরকার অতি মাত্রায় চিন্তিত, কিন্তু জনসাধারণের নিরাপত্তায় চিন্তিত নয়৷