দলতন্ত্রের আগ্রাসনে গণতন্ত্রের নাভিঃশ্বাস

লেখক
 প্রভাত খাঁ

দলতন্ত্র আর গণতন্ত্র যে এক নয় সেটা যতদিন না দেশের নাগরিকগণ মন থেকে উপলব্ধি করছেন ততদিন গণতন্ত্রের মুক্তি নেই৷ বর্তমানে দলতন্ত্র এমন এক নির্লজ্জ স্থানে এসে হাজির হয়েছে যা বলার নয়৷ অত্যন্ত বেদনা ও দুঃখের কথা, এই দলতন্ত্র প্রয়োজনে নিছক দলীয় স্বার্থে সংবিধানকে পর্যন্ত অস্বীকার করে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পদদলিত করতেও ছাড়ে না৷ এর উদাহরণ তো স্বয়ং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা জারী করে দেখিয়ে গেছেন৷ লোকসভাকে না জানিয়ে তিনি এ কাজ করেছিলেন৷

তাছড়া এদেশের বুকে যারা গণতন্ত্রকে সরাসরি অস্বীকার করে থাকে সেই কমিউনিষ্ট দল কয়েকটি রাজ্যে বামফ্রণ্ট তৈরী করে এমন শাসনব্যবস্থা চালু করে যা স্বৈরাচারিতার নামান্তর বিশেষ৷ এই পশ্চিম বাঙলা হ’ল তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ বর্তমানে কেন্দ্রে বিজেপি শাসক এসেছে৷ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যে সব কাজ করছে প্রায় সবক্ষেত্রেই চরম ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত রেখেই যাচ্ছে৷ কিন্তু খোলাখুলিভাবে সেই কাজগুলি করার পূর্বে  লোকসভায় আলোচনা হচ্ছে না৷ এরা বিরোধী পক্ষকে অস্বীকার করেই চলেছে৷ কিন্তু রাজ্যসভায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়াতে পদে পদে ধাক্কা খাচ্ছে৷

যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি যৌথভাবেই দেশ শাসন করে থাকে৷ যেখানে বিরোধী শাসন করে সেখানে কেন্দ্রের যেভাবে সম্পর্ক রক্ষা করার দরকার তা সঠিক হচ্ছে বলে মনে হয় না৷ তবে একথাও বলতে হয়, অনেক রাজ্য যেখানে বিরোধী দল শাসন করছে তারাও কিন্তু কেন্দ্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক রেখে চলা দরকার সেটাও দলীয় স্বার্থে করে না৷ ফলে দলতন্ত্রের নক্কারজনক প্রাবল্যে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অনেকখানি দুর্বল হয়েই পড়ছে৷ অত্যন্ত লজ্জার কথা জঘন্য দলবাজীটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায়৷ বর্তমানে সারা দেশে নেতা ও নেত্রীদের আচরণ ও কথাবার্তা অত্যন্ত নিম্নমানের৷ বিজেপির শাসনে জনগণ মনে করেছিল যে হয়ত পরিবারকেন্দ্রিক কংগ্রেসী আমলের শাসনে দেশ যতটা না নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন পেয়েছে সেটা এবার পাবে৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে মোদীজির হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের কট্টর শাসনে অহিন্দী রাজ্যগুলির নাভিঃশ্বাস উঠছে৷ শিক্ষাব্যবস্থায় নেমে এসেছে প্রচণ্ড অবক্ষয়৷ চরমভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জনগণ দিশেহারা৷ সব জিনিসের ওপর কর বৃদ্ধি পেয়েছে অত্যধিক৷ বড় নোট বাতিলে ধাক্কা খেয়েছে ছোট ছোট কারবারগুলি৷ কালো টাকা সাদা হয়েছে আর ধনী লাভবান হয়েছে৷ মার খেয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্তরা৷ বেকার সমস্যা বৃদ্ধি হয়েছে আরো বেশী৷ রেশনিং ব্যবস্থা বেসামাল৷

কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় সরকার দেশে অনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে চলেছেন৷ অনেক রাজ্য সেই হারে কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে না৷ ফলে ক্ষোভ বৃদ্ধি হচ্ছে দারুণভাবে৷ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনের দিকে নজর কেন্দ্রীয় সরকারের নেই৷ রাজ্যগুলির অবস্থা তথৈবচ৷ আইন-শৃঙ্খলার অধঃপতন যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি দেশে চরম নৈতিক অধঃপতন ঘটাচ্ছে দেশের প্রচার মাধ্যমগুলির দ্বারা ভোগবাদী চিন্তাভাবনার ব্যাপক প্রসার৷ এইগুলি প্রশ্রয় পাচ্ছে দেশের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধারক-বাহকদের ভোগসর্বস্ব লালসা প্রসূত প্রচার মাধ্যমগুলির কার্যাবলীতে৷ রাজ্যভাষাগুলির প্রচার ও প্রসারের জন্য কেন্দ্রের যে সাহায্য সেটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার-এর সেদিকে কোনও নজর নেই৷ জোর করে অহিন্দীভাষী রাজ্যগুলির জনগণের মধ্যে হিন্দী ভাষা চাপাবার ষড়যন্ত্রে এই নতুন সরকার অত্যধিক আগ্রহী বলে দেখা যাচ্ছে তাদের কাজকর্মে৷

বাংলা মেগা সিরিয়ালে কথায় কথায় হিন্দী গানের ছড়াছড়ি৷ পৃথিবীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা বাংলা৷ সেই ভাষাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ গণতন্ত্র তখনই সার্থকতা লাভ করবে যখন জনগণ নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করে সুশিক্ষিত হবে৷ ঝাড়খণ্ড ও বিহারের সীমান্তের জেলাগুলিতে যে সব বাংলা সুকল ছিল সেগুলিকে রাজ্য সরকার বন্ধ করে জোর করে বাঙালী পড়ুয়াদের হিন্দী পড়তে বাধ্য করছে দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে৷ সেদিকে কেন্দ্রের কোনওই নজর নেই৷ বাংলা ভাষাকে ধবংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই সরকার৷

কেন্দ্রের স্মরণে রাখা দরকার যে হিন্দী ভাষা ভারতের জাতীয় ভাষা নয়৷ ইংরেজীর মতই এটি কাজ চালানোর ভাষা বিশেষ৷ রাজ্যগুলির সরকারী ভাষা হ’ল রাজ্যভাষা, যেমন পশ্চিমবাঙলার সরকারী ভাষা হ’ল বাংলা ভাষা৷ লজ্জার কথা রাজ্য সরকার এই বাংলা ভাষায় কাজ তেমন করে চালায় না৷ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই রাজ্য ইংরাজীতে কাজ চালায়৷ অত্যন্ত বেদনার কথা হ’ল ভাষার ব্যাপারে  কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির আন্তরিকতার দারুণ অভাব৷ তবে দক্ষিণভারতে রাজ্য ভাষার কদর অনেকখানি৷ উত্তর ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দী নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করে থাকে৷ রেলের টিকিটে, রেলের ষ্টেশনে অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক ভাষার নাম লেখা হয় না, ইংরেজ আমলে যেটা ছিল৷ বাংলা ভাষাটা তো ব্রাত্য করেই রেখেছে৷ পরিশেষে বলতেই হয় যে লোকসভায় যাতে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সাংসদগণ নিজ নিজ মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখতে পারেন তার সুব্যবস্থা কেন্দ্র সরকার যেন করেন৷ গণতন্ত্র চলুক গণতন্ত্রের পথ ধরে৷ মানুষের জন্মগত অধিকারকে সংকুচিত করার অধিকার কি কেন্দ্র কি রাজ্য সরকার কারুরই নেই৷ দলবাজীটা বন্ধ হোক সর্বক্ষেত্রে, নোঙরা দলতন্ত্র মানুষকে সব দিক থেকে ধবংস করেই চলেছে, মানুষের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে৷ অদ্যাবধি সুশিক্ষার প্রসার হয়নি৷ শিক্ষা নিয়ে সর্বস্তরে দলবাজী হচ্ছে৷ সরকার, কি কেন্দ্র কি রাজ্য শিক্ষা নিয়ে দলবাজী     করতে পারে না৷ শিক্ষায় সরকারী অনুপ্রবেশটা মারাত্মক ক্ষতিকারক৷

দল আসবে যাবে, কিন্তু শিক্ষা হবে শাশ্বত৷ সেখানে কোনো দলীয় ও সাম্প্রদায়িকতার স্থান থাকবে না৷

সুশিক্ষা হ’ল সুনাগরিক গড়ার একমাত্র পথ৷  তাই শিক্ষা নীতি  নির্র্ধরণ  করার ভার প্রকৃত  শিক্ষাবিদদের   হাতে থাকাই বাঞ্ছনীয়৷ শিক্ষাবিস্তারের জন্য সরকার আর্থিক সাহায্য দান করবে৷ গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণকে প্রাধান্য দিতেই হবে৷ বেকার সমস্যা দূরীকরণের এটাই একমাত্র পথ৷ ব্লকস্তরগুলিকে আর্থিক স্বয়ংভর করে নোতুন ভারত করার পরিকল্পনা জরুরী ভিত্তিতে করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে৷

ব্যয় সংকোচ করা, বেকার সমস্যা দূর করা, সমবায় আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া, দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, দেশের ঐক্য সংহতি রক্ষা করা, জাতপাতের ঊধের্ব উঠে মানবতাকে মর্যাদা দেওয়া, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসই হ’ল সার্থক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি৷ দলবাজিতেই দেশের কল্যাণ হতে পারবে না৷ তাই সত্তর বছরেও আমরা বৃহত্তর জনগণের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছি৷ নিষ্ঠা, ত্যাগ, সেবাই হ’ল দেশনায়কদের মূলধন৷ তবেই দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব৷