দণ্ডকারণ্যেও ‘বাঙালী খেদাও’?

লেখক
মানস দেব

অসমের পর আন্দামান, আবার দণ্ডকারণ্যেও বাঙালীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে৷ সরকারী উদ্যোগেই বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল দণ্ডকারণ্য সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ৷ উদ্বাস্তু বাঙালীরাও সমস্ত বঞ্চনা দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করে নিয়ে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের বাঁচার ব্যবস্থা করেছিলেন৷

স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশেই উদ্বাস্তু বাঙালীরা সমস্ত দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনা স্বীকার করেই নিজেদের জীবিকা অর্জন করছিলেন৷ এতদিন ওই সমস্ত এলাকার আদিবাসীদের সঙ্গে মধুর সম্পর্কই ছিল৷ হঠাৎ কিছুদিন ধরে কোনো দুষ্টচক্র স্থানীয় আদিবাসীদের মনে বাঙালী বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ তাদের দিক থেকে হুমকি আসছে, বাঙালীদের এখানে থাকতে দেওয়া হবে না৷

 গত ১৩ই নবেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত ‘বর্তমানে’ ওই পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু বাঙালীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাদের এই প্রচণ্ড উদ্বেগের কথা বর্তমানে প্রকাশ করেছেন৷ এ সংবাদ বাঙালীদের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আমি এই পত্রিকায় আমার উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে আমি এই পত্রিকায়ও বর্তমানের সংবাদটি উদ্ধৃত করে দিচ্ছি ঃ

‘‘আবার ভিটেছাড়া হতে হবে? আমাদের কি কোনও স্থায়ী ঘর হবে না? কোন স্থায়ী দেশ? উচ্ছেদ হওয়াই ভবিতব্য? বাংলাদেশ থেকে সবথেকে সব ছেড়ে চলে আসার পর এপার বাংলায় স্থান হয়নি৷ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দণ্ডকারণ্যের ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে৷ অরণ্য, রুক্ষ পাথর, পাহাড় আর শ্বাপদ-সঙ্কুল সেই আদিমতাকে সঙ্গী করে কেউ স্থান পেয়েছিলেন জগদলপুরে, কেউ ওড়িশার মালখানাগিরিতে৷ কেউ পাখানজোড়৷ কেউ বাইলাডিলা৷ কেউ আবার উমরকোট৷ ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়নের জেরে বরিশাল, ফরিদপুর, বিক্রমপুর, পাবনা, রাজশাহির মতো এলাকা থেকে আসা দলে দলে বাঙালি উদ্বাস্তু এদেশের দণ্ডকারণ্যে ক্যাম্পজীবন কাটিয়ে সরকারি জমিতে ঠাঁই পেয়েছিলেন ও সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে এই বাঙালির দলের কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে৷ কেউ অন্তহীন পরিশ্রম করে ব্যবসায় থিতু হয়েছেন৷ দণ্ডকারণ্যের সর্বত্র তাই ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালি৷ বস্তার ডিভিশনের প্রতিটি জেলা, প্রতিটি ব্লক ,প্রতিটি জনপদে বাংলা ভাষা শুনতে পেলাম৷ এমনকী প্রত্যন্ত নারায়ণপুরে যাওয়ার পথে এক অখ্যাত গ্রামে চায়ের দোকানে দাঁড়াতেই দেখা মিলল বাঙালি দোকানির সঙ্গে৷ তখনই জানা গেল এই দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনী শেষে নিজেদের বসতি গড়ে তোলা বাঙালির উপর দণ্ডকারণ্যেও নেমে আসছে ঘরছাড়া করার রক্তচক্ষু৷ দণ্ডকারণ্যের সবথেকে প্রত্যন্ত এলাকার বাঙালি জনপদ পাখানজোড়ে বাঙালি সমাজের মধ্যে প্রবল উদ্বেগ শুরু হয়েছে৷ আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাঙালি সমাজের বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে৷ আদিবাসী সমাজের ক্ষোভ, বাঙালিরাই গোটা এলাকায় সমস্ত জীবনচর্র্চর সুযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে৷ বাঙালিদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাচ্ছে না৷ তাই ফের ‘বাঙালি খেদাও’য়ের জিগির উঠেছে৷ এই প্রত্যন্ত জনপদের বাঙালি চায় সংরক্ষণের ঢাল৷ আর সেটাই এবার ভোটের অন্যতম ইস্যু এই বিস্তীর্ণ এলাকায়৷ অমিত ভক্ত , হরি মহলদার৷ দু’জনেই পাখানজোড়ের বাসিন্দা৷ তাঁরা জানালেন, অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কটে দণ্ডকারণ্যের বাঙালি এখন সংরক্ষণ চাইছে সরকারের কাছে৷ পদবি কিংবা জাতি যার যাইহোক, বাঙালিরা জাতিবর্ণ নির্বিশেষে চাইছেন ওবিসি স্ট্যাটাস৷ শুরু হয়েছে তীব্র আন্দোলন৷ গঠিত হয়েছে বাঙালি সমুদয় সমিতি৷ এমনকী এই দাবি খতিয়ে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী রামন সিং কমিশনও গঠন করেছিলেন আশ্বাস দিয়ে৷ প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে৷

সরকার ও বিজেপি আশ্বাস দিয়েছে সমস্যা সমাধানে সবরকম সহায়তা করা হবে৷ কিন্তু যতটা সামাজিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া উচিত ছিল বাঙালিরা সেটা পাননি আজও৷ নিজেরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবন চালাচ্ছেন আজও৷ মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে গড়চিরৌলি৷ মাওবাদীদের দুর্গ৷ যখন পুলিশের অপারেশন চলে তখন জীবনযাপন স্তব্ধ৷ কত বাঙালি বাস করে পাখানজোড়ের এই প্রত্যন্ত জনপদে? ১৩৩ টি গ্রাম জুড়ে বসতি গড়ে তুলেছেন দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা কয়েকলক্ষ বাঙালি৷ সুতরাং অন্তাগড় বিধানসভা কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে বাঙালি ভোটারই৷ বেশ কয়েক বছর ধরে আদিবাসীরা আর এই বাঙালি সমাজকে পছন্দ করছে না৷ বিভিন্ন সময়ে বিরোধ, মতান্তর তৈরী হচ্ছে৷ মাঝেমধ্যেই প্রবল সংঘর্ষ৷ সমস্যা হল, আদিবাসীদের জন্য আইনকানুন সব কড়া৷ তাঁদের যে কোনও অভিযোগেই পুলিশ প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেয়৷ তাই বাঙালিদের এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না বলে হুমকি দিয়েছে আদিবাসীদের কিছু অংশ৷ ৬০ বছর পর আবার নতুন করে বহিরাগত তকমা? বাঙালির কি উদ্বাস্তু তকমা থেকে মুক্তি নেই?’’

সাধারণ উপজাতি ভাইয়েরা, ওইসব রাজনৈতিক ধান্দাবাজদের কথায় ভুলবেন না৷ আর যদি ভোলেন তাহলে নিজেদের পায়েই কুড়ুল মারবেন৷ সবার সঙ্গে মিলে মিশে সবার উন্নয়নের লক্ষ্যে যারা এগিয়ে যায় না তারা নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে আনে৷