দুর্গোৎসব ঃ ইতিহাস ও তাৎপর্য

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বাঙ্লায় শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রবর্ত্তনের ইতিহাস খুঁজলে আমরা পাই, পাঠান আমলের গোড়ার দিকে উত্তর বাঙ্লার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় একবার তাঁর মন্ত্রী, পুরোহিত তথা সভাসদ্দের ডেকে বললেন, ‘‘আমি রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই৷ লোকে জানুক আমার ধন–ঐশ্বর্য কত৷ আমি সেই সঙ্গে দান–ধ্যানও করতে চাই৷’’ তখন পণ্ডিতরা অনেক ভাবনা–চিন্তা করে বললেন, ‘‘মহারাজ, এই কলিযুগে তো রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করা যায় না৷ আপনি বরং জাঁকজমক–সহকারে মার্কণ্ডেয় পুরাণ বর্ণিত দুর্গাপূজা করুন৷ তাতে আপনার নাম–যশ খুব হবে৷’’

তখন তাঁদের কথামত রাজা কংসনারায়ণ রায় সে যুগে ৭ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করলেন ও প্রচুর দান–ধ্যান করলেন৷ চারিদিকে রাজা কংসনারায়ণ রায়ের সমৃদ্ধির কথা ছড়িয়ে পড়ল৷ তখন তাঁর দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী একটাকিয়ার রাজা জগদ্বল্লভ রায় মতান্তরে জগৎনারায়ণ রায় সাড়ে আট লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করলেন৷ তারপর দেখাদেখি অন্যান্য জমিদাররাও জাঁকজমক–সহকারে দুর্গাপূজা করতে লাগলেন৷ এইভাবে জমিদারদের মধ্যে দুর্গাপূজা করার প্রথা প্রচলন হয়ে গেল৷

কিছুকাল পরে হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়া গ্রামের বার জন বন্ধু মিলে ভাবল, আমরা মিলিতভাবে দুর্গাপূজা করব৷ যেহেতু এই পূজা খুবই ব্যয় বহুল, কারও একার পক্ষে এই পূজা করা সম্ভব ছিল না৷ তাই বার জন বন্ধু মিলিতভাবে দুর্গাপূজা করল৷ আগে কেবল জমিদাররাই দুর্গাপূজা করত৷ এখন বার জন বন্ধু বা ইয়ার (বন্ধুকে ফার্সী ভাষায় বলা হত ইয়ার, তখন সেই পাঠান আমলে ‘ফার্সী’ ভাষা এদেশে খুবই চলত) মিলে  জমিদারবাড়ীর বাইরে দুর্গাপূজা করা শুরু করল৷ তাই একে বার–ইয়ারী বা বারোয়ারী পূজা বলা হ’ত৷ তখন উচ্চ বর্ণের মানুষ ছাড়া পূজায় অঞ্জলি দেওয়ার অধিকার অন্যদের ছিল না৷ আধুনিক কালে এই বারোয়ারী পূজা বিবর্তিত হয়ে হ’ল সর্বজনীন দুর্গাপূজা–যাতে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের অঞ্জলি দেবার অধিকার স্বীকৃত হ’ল৷ এখন এই পূজা দেশে বিদেশে বাঙালীর সামাজিক–উৎসবে পরিণত হয়েছে৷ এই হ’ল দুর্গাপূজার ইতিহাস৷

পূর্বেই বলা হয়েছে, দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী নেওয়া হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে৷ প্রাচীনকালে চার ধরণের পুস্তক রচনা করা হ’ত৷ কাব্য, ইতিকথা, ইতিহাস ও পুরাণ৷ কাব্য হ’ল ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’ অর্থাৎ ছন্দ, উপমা সহযোগে সুখপাঠ্য রচনা৷ ইতিকথা হ’ল কোনো ঘটনার হুবহু পঞ্জীকরণ–অর্থাৎ অতীতে যা ঘটেছে–হুবহু তাই লেখা৷ ইতিকথার মধ্যেকার যে সমস্ত ঘটনার বিশেষ শিক্ষাগত মূল্য রয়েছে, যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগায়, সেই সমস্ত ঘটনাকে নিয়ে যে বিশেষ ধরণের রচনা তাকে বলা হ’ত–‘ইতিহাস’৷ আর এক ধরণের রচনা ছিল, যা ঘটনা হিসেবে সত্য নয়, কিন্তু তার শিক্ষাগত মূল্য রয়েছে৷ পুরাণ হ’ল সেই শিক্ষামূলক কাহিনী৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গার কাহিনীতে দেখানো হচ্ছে, একবার অত্যাচারী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে৷ সেই মহিষাসুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দেবতারা ব্রহ্মা–বিষ্ণু–মহেশ্ব শরণাপন্ন হলেন৷ তখন ব্রহ্মা–বিষ্ণু–মহেশ্ব তেজ থেকে এক জ্যোতির্ময়ী দেবীমূর্ত্তির সৃষ্টি হ’ল৷ সেই দেবীর নাম হ’ল দুর্গা৷ তাঁকে সমস্ত দেবতারা অস্ত্র দিলেন৷ তখন দশপ্রহরেণধারিণী দুর্গা অত্যাচারী মহিষাসুরকে বধ করে স্বর্গরাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনলেন৷

বলা বাহুল্য, স্বর্গ বলে কোনো রাজ্য নেই বা ‘দেবতা’ বলেও মানুষের বাইরে আলাদা কেউ নয়৷

‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক

        কে বলে তা বহুদূর৷

মানুষেরই মাঝে স্বর্গ–নরক

        মানুষেতে সুরাসুর৷৷’’

সৎ–মানুষরাই হলেন সুর বা দেব, আর অসৎ, অত্যাচারী মানুষদেরই বলা হয় অসুর বা দানব৷ সমাজে অসৎ–ত্যাচারী মানুষদের দাপট যখন খুব বেড়ে যায়, তখন সৎ, নীতিবাদী মানুষদের ওপর খুবই অত্যাচার চলে৷ তখন অসৎ অত্যাচারী মানুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সৎ–মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে হয়৷ সৎ–মানুষদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থেকে উদ্ভূত শুভশক্তিকেই বলা হয়েছে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, যা সমস্ত অশুভশক্তিকে বিনাশ করে৷ মার্কণ্ডেয় ঋষি রচিত এই পৌরাণিক কাহিনীর মূল শিক্ষাটা এটাই৷

আমাদের এই মূল শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে ও সমাজের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অশুভশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে৷ তাহলে শুভশক্তির ‘বিজয়’ অবশ্যম্ভাবী৷ তাই দুর্গোৎসবের শেষ দিনে ‘বিজয়া’ অর্থাৎ ‘বিজয়োৎসব’ পালিত হয়৷

পুরাণের এই শিক্ষামূলক কাহিনী স্মরণ করে’ সমস্ত অশুভশক্তিকে পরাভূত করে শুভশক্তির অন্তিম বিজয়ের লক্ষ্যে সমাজের সমস্ত প্রকার অন্যায়, পাপাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷ তবেই সমাজে প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে৷ এই শুভকামনা করে আমরা সবাইকে শুভবিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই৷