ধর্ম বনাম ডগ্মা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

আনন্দনগরে মহাসমারোহে আনন্দমার্গের  ধর্মমহাসম্মেলন হয়ে গেল৷ এই ধর্ম  মহাসম্মেলনের মাধ্যমে যে মূল কথাটা মানুষের  সামনে  তুলে ধরা হচ্ছে, তা হ’ল প্রকৃত ধর্মই  মানবজীবন তথা মানব সমাজের  ভিত্তিভূমি৷ আর এই ধর্ম তথাকথিত  সাম্প্রদায়িকভিত্তিক ধর্মমত বা রিলিজিয়ন নয়, এখানে  কোনো ডগ্মা তথা অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের স্থান নেই৷  যেমন, বর্তমানে  ধর্মের নামে সারা দেশ জুড়ে  চলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উত্তেজনা সৃষ্টির  প্রয়াস৷  হিন্দুত্ববাদীরা  ‘গো-রক্ষা’র  আন্দোলনের  নামে মানুষ হত্যা  করছে৷

হিন্দু-মুসলমান বিরোধ  সৃষ্টি করে’ সামাজিক  পরিবেশকে দূষিত  ও অশান্ত করে তুলছে৷  কেরালার শবরীমালা মন্দিরে  চরম অযৌক্তিক  কুসংস্কারপূর্ণ প্রথাকে  কেন্দ্র করে  ধুন্ধুমার  কাণ্ড  ঘটছে৷ সারা রাজ্য জুড়ে সংঘর্ষ ও সরকারী  সম্পত্তি নষ্ট  চলছে৷ আসলে এগুলোর  সঙ্গে প্রকৃত  ধর্মের কোনোমাত্র সম্পর্ক নেই৷ ধর্ম অযৌক্তিক, অমানবিক ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করে না৷ যদি  করে থাকে তাহলে  স্পষ্টতই  তা ধর্ম নয়, ধর্মের  নামাবলি গায়ে দেওয়া  ডগ্মা বা ভাবজড়তার কথা অন্ধবিশ্বাস মাত্র৷

ধর্ম হল অধ্যাত্মবিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা  তা  কোনো ভিত্তিহীন কল্পনা বিলাস (Utopian idea) নয়৷

মহান ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, আধ্যাত্মিক তাকে  আমরা  আমাদের  কঠোর বাস্তব দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন ও উপলদ্ধি  করতে পারি৷ এই আধ্যাত্মিকতা হল মানবমনের বিবর্তন  তথা সর্র্বেচ্চ স্তরে উত্তরণের elevation) নামান্তর, এর সঙ্গে  কুসংস্কার  ও নৈরাশ্যবাদের সম্পর্ক নেই, যে সমস্ত বিচ্ছিন্নবাদী প্রবণতা বা ক্ষুদ্র  গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবনা-চিন্তা মানুষের মনকে  সংকীর্ণতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ  করে, তার সঙ্গে  আধ্যাত্মিকতার  কোনো সম্পর্ক নেই৷ এইসব ভাবজড়তাকে (ডগ্মা) মোটেই  উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়৷  যা মনকে প্রসারিত করে ও ঐক্যের ভাবনা জাগায়---তাই  একমাত্র গ্রহণযোগ্য৷ আধ্যাত্মিকতা মানুষে মানুষে  কৃত্রিম বিভেদকে  স্বীকার  করে না৷ আধ্যাত্মিকতা বিশ্বভ্রাতৃত্বের  কথা বলে৷

চতুর্দিকে ধর্মের নামে  নানান্ গোঁড়ামী, ডগ্মায়  লড়াই, অন্ধবিশ্বাস -কুসংস্কারের  বীভৎসতা--- এসব দেখে অনেকেই  ধর্ম সম্পর্কে -বিভ্রান্ত৷ আর এই বিভ্রান্তের  সংখ্যা সমাজে -অত্যন্ত বেশি৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই, তথাকথিত শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবিরাও বেশির ভাগই বিভ্রান্ত৷

এঁদের আবার বেশীর ভাগ নিজেদের  অজান্তেই  নানান্ ডগ্মার দ্বারা প্রভাবিত৷ ডগ্মায়  আচ্ছন্ন হয়ে  প্রকৃত ধর্মকে চেনবার  বা বোঝবার  চিন্তাশক্তিই তাঁরা হারিয়ে  ফেলেছেন৷

তাহলেও বলব, অন্ধকার  খুববেশী দিন থাকে না৷ সত্যভ্রষ্টা মহামনীষীরাও কম্যুকন্টে ঘোষণা করে গেছেন প্রকৃত ধর্মের  অভ্যুত্থান  আসন্ন৷  আবার  বলি,  এ ধর্ম  মানে সর্বজনীন  মানব ধর্ম ---যাকে  আমরা  আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বলতে পারি৷

জড়বাদী  জীবনধারা  আজ পৃথিবীকে স্বার্থ লোলুপ নীতিহীন, শৃঙ্খলাহীন, মানবতাহীন  জঙ্গলের  রাজত্ব কায়েম করেছে৷  নীতিহীন মানব সমাজ  ধবংসের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে৷  এ অবস্থায় এই উন্মার্গগামী বিভ্রান্ত মানব সমাজ  কে রক্ষা করতে নীতিবাদী শুভবুদ্ধি  সম্পন্ন মানুষেরা  ঘুরে দাঁড়াবে  ও এই জড়বাদ  ভোগবাদের  পিশাচ নৃত্য স্তব্ধ করে দিয়ে সুদৃঢ় আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক  নীতিবাদী সমাজের পত্তন  করবে৷ ইতিহাসের  এটাই নিয়ম৷  গীতার বানী থেকে শুরু করে সমস্ত  সত্যদ্রষ্টা  মহান মনীষীদের বানীই  এটাই সারমর্ম৷

স্বামী বিবেকানন্দ একজন  পরাধীন দেশের মানুষ  হয়েও  মদগর্বী পাশ্চাত্ত্যের  বুকে দাঁড়িয়ে  বলেছিলেন,  জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা  আজ  এক জীবন্ত  আগ্ণেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে  আছে৷ যে কোনো  মুহূর্তে এর  বিস্ফোরণ  ঘটতে পারে৷ বাঁচতে  হলে  জড়বাদী  পাশ্চাত্যকে নতজানু হয়ে ভারতের  আধ্যাত্মিকতার  কাছে  দীক্ষা নিতে  হবে৷  অন্যত্র তাঁকে  আরও  বলতে শুণি , অদূর ভবিষ্যতে  এক  ব্রহ্মবাদ ছাড়া  আর কিছুই থাকবে না৷ এই কারণে  তিনি নিজে  অদ্বৈত আশ্রমও গড়ে তুলেছিলেন৷

সত্যদ্রষ্টক কবি রবীন্দ্রনাথও তার ‘বর্তমান যুগ’ প্রবন্ধে বলেছেন, আজ সারা বিশ্বজুড়ে  সমাজের  সর্বস্তরে  এক বিরাট  পরিবর্তন  আসন্ন৷ বাইরে  থেকে তাকে  রাজনীতি  বলে ভ্রম হলেও  আসলে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সমস্ত  পৃথিবী জুড়ে  আজ একটা ধর্মের বিদ্যুৎ শক্তি ছুটে চলেছে৷  এই ধর্মই  সারা পৃথিবীকে রক্ষা করবে৷

বলা বাহুল্য স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ  প্রভৃতি যে ধর্মের কথা বলেছেন, সে  ধর্ম-বিশ্বজনীন  মানবধর্ম কোনো সম্প্রদায়ভিত্তিক  সংকীর্ণ ডগ্মার সমষ্টির নয়৷

আনন্দমার্গ বিশ্বজুড়ে সেই  সার্বভৌম মানবধর্মেরই প্রচার করছে৷  এই ধর্মসাধনার  দৈনন্দিন  অনুশীলনের  মাধ্যমে  মানুষের মনের  পূর্ণ  বিকাশ ঘটবে৷ মানব হয়ে  উঠবে বিশ্বমানব৷ এটাই শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর  ‘নব্যমানবতাবাদের’ সারকথা৷ যেখানে  ‘প্রভাত সঙ্গীতের ভাষায় তিনি বলেছেন’ ‘‘মানুষ যেন  মানুষের  তরে সব কিছু করে যায়/ এ কথাও যেন মনে রাখে  পশুপাখি তার পর  নয়৷  তরুও বাঁচিতে চায়৷’’

এই নব্যমানবতাবাদীদের্ কাছে  কোনও  মানুষও তারপর নয়৷ প্রকৃত অধ্যাত্মবাদীদের  মতে ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই’৷ তাদের্ বলা হবে ‘সদবিপ্র’,  তারাই  সমস্ত  পৃথিবীকে সমস্ত অন্যায়, শোষণ, পাপাচার  ও সঙ্গে সঙ্গে  সমস্ত  অভাব  ও অজ্ঞতা থেকে  দৃঢ়হস্তে  রক্ষা করবে৷ তখন আর কোনও প্রকার  ডগ্মা কোনও  প্রকার  অন্যায় বা শোষণ আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে  পারবে না৷