‘এ গান থামিবে না, এ দাবি দমিবে না’

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

মহাকালের অনাদি থেকে অনন্তের যাত্রাপথে বিশেষ কিছু বিন্দু সৃষ্টি হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে এক একটা মাইল ফলক হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকে, বিশেষ কিছু মুহূর্ত বা ঘটনা মানব চেতনার গভীরে মোটা দাগ এঁকে দিয়ে যায়৷ ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল এমনই একটা দিন যা পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার  চরমতম লাঞ্ছনার অন্যতম একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকবে৷ আমরা আরও একটি ৩০শে এপ্রিল পেরিয়ে এলাম, যে দিনটাকে বিশ্বের সকল আনন্দমার্গী ভাই-বোন ‘‘মানবতা বাঁচাও দিবস’’রূপে পালন করে আসছেন৷ আনন্দমার্গের অনুগামী ও বিশ্বের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের কাছে এই দিনটা প্রচণ্ড যন্ত্রণাবিদ্ধ হওয়ার দিন, হৃদয়ের সমস্ত সুকুমার বৃত্তিগুলোকে দুমরে মুচড়ে দেওয়ার দিন, তীব্র ক্ষোভ, রোষ ও প্রতিবাদে গর্জে ওঠার দিন৷

বৈশাখের তপ্ত দহনে জর্জরিত কলকাতার মানুষ শর্বরীর শীতলতায় শরীরের ক্লান্তি দূর করে নোতুন এক সুন্দর মনোরম সকালে নবশক্তিতে  উজ্জীবিত হয়ে অন্যান্য দিনের মতো কর্মচঞ্চলতায় তৎপর হওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলছেন,তখনই আকাশে-বাতাসে  উৎক্ষিপ্ত হ’ল অসহায় সমবেত কন্ঠের আর্ত চিৎকার, আকুল ‘‘বাঁচাও বাঁচাও’’ রব আর তারই বিপরীতে ‘‘মেরে ফেল্, মেরে ফেল্’’, ‘‘জ্বালিয়ে দে,  পুড়িয়ে দে’’ ইত্যাদি কর্কশ শব্দ তরঙ্গের সাথে  পৈশাচিক উল্লাসের অট্টহাসি৷ হায় কল্লোলিনী কলকাতা ! রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্রের কলকাতার এ কোন রূপ দেখল বিশ্ববাসী! কোন বার্র্ত উদ্গীত হ’ল ধূলির ধরণী থেকে দূর  মহাকাশে! কলকাতার কসবা অঞ্চলের বিজনসেতু ও বন্ডেল গেট সন্নিহিত স্থানগুলিতে একটি জনকল্যাণমূলক আধ্যাত্মিক সংঘটন আনন্দমার্গের ১৭ জন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীকে ট্যাক্সি-রিকশা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে  ছোরা-বল্লম দিয়ে খঁুচিয়ে,চোখ খুবলে, বাঁশ রড দিয়ে পিটিয়ে অর্ধমৃত ও নগ্ণপ্রায় করে’ অ্যাসিড ও পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার এক বীভৎস ধবংসলীলায়  মেতে উঠল কয়েকশত মত্ত হিংস্র মানবরূপী নরপশুর দল, যারা নিজেদের  এই সুন্দর কলকাতার  অধিবাসী বলে এতদিন গর্ব করত৷ অথচ ‘আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ’ আধ্যাত্মিকতার প্রচার প্রসার  ও মানব কল্যাণে  বহুবিধ জনহিতকর  প্রকল্পের জন্যে  সমগ্র ভারতবর্ষ ও বিশ্বের মানুষের কাছে  একটি সুপরিচিত নাম৷  বিভিন্ন জনসেবামূলক কর্মসূচী যেমন, ছোট ছোট শিশুদের  আধ্যাত্মিকতার আদর্শে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে বিদ্যালয় স্থাপন,  বহু শিশুসদন যেখানে পিতৃমাতৃহীন শিশুদের  বা              দুঃস্থ ও দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তানদের পরম যত্নসহকারে  পিতা ও মাতার আদর- ভালবাসা-স্নেহ  দিয়ে  মানুষের মতো মানুষ  করবার ব্যবস্থা রয়েছে, কুষ্ঠরোগীদের জন্যে হাসপাতাল ,সেবাসদন, যোগসাধনা কেন্দ্র ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে দেশে  আনন্দমার্গ সংঘটন যথেষ্ট সমাদৃত ও সাধারণ মানুষের নিকট  আদরনীয় ও  বরণীয়  হয়ে উঠেছিল৷ এই সময়েই ঘটল  ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিলের নারকীয় নরমেধ যজ্ঞ৷  একসঙ্গে  এতজন  নিপীড়িত মানবতার সেবায় নিয়োজিত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের এই ধরণের বীভৎস মারণযজ্ঞ ইতোপূর্বে কলকাতার বুকে সংঘটিত হয়নি৷

প্রকৃতপক্ষে আনন্দমার্গের মতো একটি জনসেবা মূলক  আধ্যাত্মিক সংঘটনের ব্যাপক  জনপ্রিয়তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি দুর্নীতির ধবজাধারী জড়বাদী পুঁজিপতিদের  দল ও  তৎকালীন কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতারা ৷ তাই তাদের হাতের  পুতুল কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই মানবতাবাদী, নৈতিকতায় বিশ্বাসী, সর্বাত্মক শোষণবিরোধী সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী আধ্যাত্মিক সংঘটন আনন্দমার্গকে প্রতিহত করার জন্যে  সর্বশক্তি প্রয়োগ করে৷ কেন্দ্রের সরকারী প্রশাসন তাদের অধীন গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে আনন্দমার্গের পিছনে লেলিয়ে দেয় ও শেষ পর্যন্ত সিবি আই আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা  ও প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি  ধর্মগুরু হিসেবে  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে  সমধিক পরিচিত, তাঁকে ১৯৭১ সালে ষড়যন্ত্রমূলক  মিথ্যা মামলায়  গ্রেফতার করে ৷  শুধু তাই নয়, আইনের পথে সিবিআই প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে ও মার্গগুরু শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীকে  শত শারীরিক, মানসিক লাঞ্ছনা ও উৎপীড়নেও বাগে আনতে না পেরে, পটনার বাঁকিপুর সেন্ট্রাল জেলের ভিতর ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী তাঁকে ঔষধের নামে বিষ প্রয়োগ করে৷  এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে অনশন শুরু করেন ও সুদীর্ঘতম সময়  ৫বছর ৪ মাস ১দিন পরে ১৯৭৮ সালের ২রা অগাস্ট তারিখে পটনা  হাইকোর্টের রায়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে কারাগারের বাইরে আসেন ও অনশন ভঙ্গ করেন৷ ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থার সময় আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রম  ও কার্যালয় পুরুলিয়ার আনন্দনগরের সমস্ত সেবাকেন্দ্রগুলিকে  ধবংস করে দেওয়া হয় ও সকল কর্মকর্র্ত্ত তথা আনন্দমার্গের গৃহী সাধকদেরও কারাগারে বন্দী করা হয়৷ তারও পূর্বে  কম্যুনিষ্ট গুণ্ডারা  ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ আনন্দনগরে হামলা চালিয়ে  ৫ জন সন্ন্যাসীকে হত্যা  করে৷ এরপরেও  এই  ধরনের বহু অত্যাচার, নিপীড়ন  ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আনন্দমার্গের ইতিহাসে৷ তারপর এলো এই ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিলের  ভয়ঙ্করতম নৃশংস ঘটনা যার  মূলেও ছিল সেই কম্যুনিষ্ট পাণ্ডাদের দল ও তাদের মদতপুষ্ট চেলা চামুণ্ডারা৷  অনুগত প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব রেখে কয়েকদিন  ধরে ছেলে ধরার গুজব ছড়িয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রায় দুই-তিন ঘন্টা ব্যাপী এই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ড ও মানুষের রক্তের হোলি খেলেও আনন্দমার্গকে শেষ করতে পারেনি এই কম্যুনিষ্ট  শয়তানদের দল৷ বরং আজ পৃৃথিবী থেকে কম্যুনিজম ও কম্যুনিষ্ট নামটাই প্রায় মুছে যেতে বসেছে  আর বিশ্বের ১৮২ টি দেশে আনন্দমার্গের বিজয় পতাকা স্বমহিমায়  উড্ডীন রয়েছে৷

তাই প্রতিবছর ৩০শে এপ্রিল আনন্দমার্গীদের দাবি--- এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের সুবিচার চাই৷ প্রকৃতির নির্মম কশাঘাতে এই চক্রান্তকারী ও হামলাকারীদের অনেকেই  সমুচিত শাস্তি পেয়ে  ধরাধাম থেকে হারিয়ে গেছে৷  কিন্তু দেশের আইনে  এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও  দোষীদের তথা ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি ঘোষণার দাবীতে  আনন্দমার্গীরা সরব রয়েছেন৷ একটি মহৎ আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্যে, লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানবতার সেবার জন্যে  যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন, অমূল্য মানব জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পনের দিন  এই ৩০শে এপ্রিল৷ সর্র্বেপরি বিশ্বমানবতাকে জাগ্রত ক’রে পৃথিবীর বুকে আধ্যাত্মিক আদর্শ আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নব্যমানবতাবাদ ও নৈতিকতার পথে শোষণহীন সুন্দর সমাজ রচনা করার  দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের দিনও এই ৩০শে এপ্রিল৷

যতদিন না উপর্যুক্ত লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে ও সার্বিক শোষণমুক্ত সদ্বিপ্র নিয়ন্ত্রিত ‘নোতুন পৃথিবী’ গড়ে উঠছে ততদিন বিশ্বের সমস্ত শুভচেতনা সমৃদ্ধ মানুষকে মানবতা রক্ষার দাবি ও এগিয়ে চলার গানকে  সাথী করে দৃঢ় পদবিক্ষেপে  গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সম্মুখপানে অগ্রসর হতেই হবে৷ এইমর্মে স্মরণ করি মহান দার্শনিক মহাসম্ভূতি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত  ও সুরারোপিত  প্রভাত সঙ্গীতের (৪৭৯৫ সংখ্যা) আশ্বাস বাণী---

‘‘এ গান থামিবে না, এ দাবি দমিবে না৷

পথ বেঁধে দিল আলোকোজ্জ্বল প্রাউটের প্রেষণা৷৷

সহ্য করেছি যুগ যুগ ধরে’, সহ্যের সীমা  গেল ভেঙ্গে’ পড়ে’৷

দানব আজিও ভ্রূভঙ্গী করে নীতিবাদী উন্মনা৷৷

পূর্ব দিগন্তে অরুণ এসেছে, কালের কালিমা  সরিয়া যেতেছে৷

বিষাদের পর আলোক ঝরিছে আর দেরী সহিবে না ৷৷’’