একের পর এক বলাৎকার ও খুনের ঘটনা ঃ সমস্যা সমাধান কোন পথে?

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার ও খুনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে৷ ২৮ শে নভেম্বর হায়দ্রাবাদের ঘটনায় সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল৷ সর্বত্রই এই সব নরপশুদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হ’ল৷’’ সর্বত্র দোষীদের ফাঁসীর দাবী উঠল৷ কিন্তু না,এ ধরনের অপরাধ কাণ্ড ঘটেই চলেছে৷ উত্তর প্রদেশের উন্নাওতে ধর্ষণকারী জামিনে মুক্তি পেয়েই অভিযোগ কারিনীর  গায়ে  প্রকাশ্য রাস্তায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল৷ সর্বাঙ্গে জ্বলছে আগুন৷ এই অবস্থায় ওই তরুণী প্রায় এককিলোমিটার পথ  সাহায্যের জন্যে  ছুটে গিয়ে একজনকে দেখতে পেয়ে  তার ফোনে  নিজেই থানায়  ফোন করে পুলিশকে জানায়৷ পুলিশ ওই তরুণীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়৷  হাসপাতালেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে৷ এর মধ্যে  এ রাজ্যে  মালদাতেও পাওয়া যায় এক যুবতীর দগ্দ দেহ৷ ত্রিপুরাতেও এইভাবে বলাৎকার করে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার খবর প্রকাশ পায়৷ মুজঃফ্ফর নগরে বলাৎকারের সামলা তুলে নিতে অস্বীকার করায় অভিযোগকারিনীর মুখে  দুষৃকতীরা এ্যাসিড্ ছঁুড়ে মারে৷

সারা দেশ জুড়ে এই মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে৷ সর্বত্র  মা বোনেরা  রাস্তায় বেরুতে ভয় করছে৷  বিশেষ করে  কর্র্মেপলক্ষ্যে বা পড়াশোনার  জন্যে রাত  বেরাতে কোনো নির্জন  রাস্তা দিয়ে বা যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা মদের  ঠেকের  পাশ দিয়ে যাদের  যেতে  হয় তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত্র হয়ে  চলাফেরা  করে৷ সব সময় ভয়  এই কোথায়  নেকড়ের  মত নরপশুরা ঘাপটে মেরে অপেক্ষা করছে৷ এ সমাজটা যেন নরপশুদের  ভয়াবহ অরণ্যে পরিণত হয়েছে!

দেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে তো বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে৷ কিন্তু  লাভ তো কিছু হচ্ছে না৷

হায়দ্রাবাদের ঘটনায় পুলিশ দোষীদের গ্রেফতার করে৷ পুলিশের চাপে পড়ে তারা দোষ স্বীকারও করে৷ তারপর তাদের ঘটনার পুণনির্মাণের জন্যে রাতে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কেমন করে তারা অপরাধ করেছিল দেখানোর সময় হাতকড়া খোলাই ছিল৷ এমন সময় আচমকা তারা পুলিশের রিভলভার ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে৷ অন্যান্য পুলিশরা তাদের আত্মসমর্পণের হুঁশিয়ারী দিলেও তাঁরা আত্মসমর্পণ করেনি৷ তখন পুলিশ গুলি চালায়৷ ৪ জন দোষী ঘটনাস্থলে নিহত হয়৷ পুলিশের সঙ্গে দোষীদের লড়াইয়ের সময় ভোর হয়ে গিয়েছিল৷ জনতা খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হয় ৪ দুষ্কৃতীরই মৃত্যুতে জনতা পুলিশের জয়ধবনি দেয়, তাদের ওপর পুষ্পবৃষ্টিও করে৷ অনেকেই মনে করছেন, আসলে  দুষৃকতকারীদের  সঙ্গে লড়াইটা পুলিশের নাটক৷ এভাবে এনকাউন্টারের  নামে দোষীদের খতম করাই পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল৷ সে যাই হোক, এইভাবে দোষীদের নিকেশ করাতে জনতা উল্লসিত৷ দেশজুড়ে পুলিশের  এই ভূমিকার প্রশংসা করা হচ্ছে৷ কারণ আইনের  মাধ্যমে  কবে দোষীদের  সাজা হবে, আদৌ হবে কিনা--- এই আশঙ্কায় আইনী ব্যবস্থার ওপর জনসাধারণ ভরসা করতে পারছে না৷ তাই সর্বত্র দাবী উঠেছে, এইভাবেই দোষীদের হত্যা করা হোক৷

কিন্তু  এভাবে দেশ চলে না৷ এভাবে এনকাউন্টারে বা সরাসরি দোষীদের হত্যা করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? নিশ্চয়ই নয় তাহলে তো দেশে নৈরাজ্য শুরু হয়ে যাবে৷ পুলিশ এভাবে নির্দোষকেও হত্যা করতে পারে!

তাহলে এই সমস্যার সমাধান কোন্পথে? এই রোগ তো মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে৷ দিল্লিতে নির্ভয়াকাণ্ডের পর দেশজুড়ে উত্তাল বিক্ষোভ আন্দোলনের জেরে সংসদে আইন সংশোধন করে দোষীদের ২০বছর জেল, অপরাধের  মাত্রা  বুঝে ফাঁসীর পর্যন্ত সংস্থান রাখা হ’ল৷ কিন্তু এধরণের অপরাধ হ্রাসের কোনো লক্ষণই  দেখা যায়নি৷ তাহলে কি দেশে  এই ধরণের নক্কারজনক ঘটনা দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে? এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই? এই গুরুতর সমস্যার সমাধান খঁুজে বের করতে হবে৷

দোষীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা তো করতেই হবে আর এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না৷ প্রয়োজনে প্রশাসন বিচারব্যবস্থাকে  ঢেলে সাজাতে হবে৷

কিন্তু শুধু এখানে থেমে থাকলে চলবে না৷ দেশে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের  জীবাণুবাহী মশার আঁতুরঘরগুলোকে ধবংস করার ব্যাপক কর্মসূচী নিতে হয়৷ ঠিক তেমনি এক্ষেত্রেও রোগ জীবানুর  আঁতুড়ঘরের উৎস সন্ধান  করতে হবে৷ মানুষের মনে বিচারবুদ্ধি বা  বিবেকও যেমন আছে, তার সঙ্গে  সঙ্গে পশু প্রবৃত্তি আছে৷ কারণ  বিবর্ত্তণের সিঁড়ি বেয়ে পশু থেকে  মানুষ এসেছে ৷ তাই তার মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলিও রয়েছে৷ এগুলিকে উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারা, উপযুক্ত সাংসৃকতিক পরিবেশ রচনা করে এইসব  পশুপ্রবৃত্তিকে  সংযত করতে  হয়৷ মানুষের  মনকে স্থূল থেকে  সূক্ষ্মের দিকে ---শুভপথে পরিচালিত করতে হবে৷

কিন্তু সে জিনিসটার একান্ত অভাব৷ বর্তমানে প্রচুর সুকল কলেজ রয়েছে৷ কিন্তু সেই সমস্ত সুকল- কলেজের শিক্ষা মানুষকে মূলতঃ অর্থ রোজগার শেখায়৷ উপযুক্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার অভাব৷  তারপর বর্তমানে সিনেমা, দূরদর্শনের  সিরিয়্যালে অশ্লীল দৃশ্য, এইসব দৃশ্যে বা বিজ্ঞাপণে অর্ধনগ্ণ নারীদেহ প্রদর্শণের প্রবণতা সমাজের সাংসৃকতিক বাতাবরণ নষ্ট  করছে ৷ পরিবেশ দূষণের  মত এইসব দৃশ্যদূষণে মানুষের মনে দূষণ আসছে৷ উল্লেখিত সমস্যারূপ রোগ জীবাণুর আঁতুরঘর কিন্তু এগুলিই, আর এগুলিতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মদের ঠেকগুলি৷

এইসব মানুষের  মনকে কলুষিত  করছে৷ তার প্রতিফলন হচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের এই সব চরম  উচ্ছৃঙ্খল আচরণ৷ যারা দুর্বল চরিত্রের মানুষ তারা এই দূষণ বিষের  দ্বারা সহজে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে৷ আর  যখন  সুযোগ পাচ্ছে, তখন মনের ওই কুপ্রবৃত্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উন্মাদের মতো সাত পাঁচ চিন্তা  না করেই জঘন্য কাজে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ তাই আমাদের দাবী প্রথমতঃ, এই সমস্ত ক্ষেত্রে অবশ্যই দোষীদের দ্রুত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক৷ এজন্যে আইনকে ঢেলে সাজানো হোক৷ দ্বিতীয়তঃ, সিনেমা, দূরদর্শনের সিরিয়্যাল প্রভৃতিতে অশ্লীল দৃশ্য প্রদর্শন ও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নগ্ণ নারীদেহ প্রদর্শনের  প্রবণতা  নিষিদ্ধ হোক৷ তৃতীয়তঃ ,দেশের সমস্ত শিক্ষাকেন্দ্রে ও গণশিক্ষার মাধ্যমগুলি  যেমন সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা, সিনেমা ও দূরদর্শনের  মাধ্যমে যথার্থ নৈতিক তথা সার্বভৌম আধ্যাত্মিক (গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতা তথা গোষ্ঠী মানসিকতা ও সাম্প্রদায়িতা বর্জিত) শিক্ষা দিয়ে সর্বসাধারণের নৈতিকমান  উন্নত করার ব্যবস্থা করা হোক৷ চতুর্থত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে দেখা যায়, মদ অপরাধীদের অপরাধ কার্যের সহায়ক৷ মদ্যপান করার পর মানুষের  বিবেকবুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ তারা তখন যে কোনো জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হয়৷  তাই সারা দেশেই মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক৷

প্রশাসন যদি উপরিউক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে এইসব দাবীতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে সামিল হোন৷ নাহলে এধরণের  মহামারী থেকে দেশকে বাঁচানো যাবে না৷