এন. আর. সি.-র নামে বিদেশী তক্মা  দিয়ে সর্বত্র বাঙালী বিতাড়নের বিরুদ্ধে সমস্ত বাঙালী ঐক্যবদ্ধ  হোন

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

বিপন্ন বাঙালী

ভারতের বুকে আজ বাঙালী জাতিসত্তা এক চরম বিপদের সম্মুখীন৷ ভারতবর্ষ বাঙালীদের জন্মভূমি তথা স্বদেশ হলেও, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশাল ত্যাগ তিতিক্ষার পরেও এদেশে বাঙালীদের এখন স্থান হচ্ছে না৷ রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন চুক্তি ও এন আর সি-র মত বিধি প্রয়োগ করে বর্তমানে বাঙালীকে অমানবিক ও অযৌক্তিকভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তথা বিদেশী বানিয়ে দেশ ছাড়া করবার এক গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে৷ আর শুধুমাত্র সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতেই বাঙালী বিরোধী এই চক্রান্তে মদত জুগিয়ে যাচ্ছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের দোসর বর্তমান শাসক দল বিজেপি থেকে শুরু করে বিরোধী কংগ্রেস, সিপিএম এর মত পার্টি গুলি৷ স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশক থেকেই অসম, ত্রিপুরা, উত্তরপূর্বাঞ্চল সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালীদের উপর বার বার আক্রমণ ও আইনের আঘাত নেমে এসেছে৷ অসমে ‘বঙ্গাল খেদা’ ও ১৯৮৩ সালে নেলীর গণহত্যা, ত্রিপুরাতে ৮০-র গণহত্যা ইত্যাদি কয়েকটি উদাহরণ মাত্র৷ বাঙালী বিরোধী ষড়যন্ত্রের সর্বশেষ সংযোজন হল গত ৩০শে জুলাই এন আর সি প্রয়োগের মাধ্যমে চল্লিশ লক্ষাধিক বাঙালীকে বিদেশী চিহ্ণিত করে ডিটেনশান ক্যাম্পে রাখা অথবা দেশছাড়া করবার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে৷

অবৈধ রাজীব-অগপ চুক্তি

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৮৫ সালে অসমের কংগ্রেস রাজত্বকালে বিদেশী তথা বাঙালী বিতাড়নের লক্ষ্যে রাজীব-অগপ চুক্তি পাশ হয়৷ যার প্রতিপাদ্য বিষয় ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চ পর্যন্ত  যারা অসমে  এসেছে  তার বৈধ নাগরিক৷ এরপর যারা  অসমে  প্রবেশ করবে তারা  অবৈধ নাগরিক বা অনুপ্রবেশকারী Illegal migrants) হিসাবে  চিহ্ণিত  হবে৷  অথচ ভারতের  নাগরিকত্ব আইনের  একটি ধারা অনুযায়ী কারও জন্ম  যদি ভারতের  মাটিতে  হয় তবে জন্ম সূত্রেই সে ভারতের  নাগরিক Citizenship by Birth)

বাঙালী প্রতারণার শিকার

অতীতেও বারবার আমরা বিভিন্ন দলের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি৷ যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে  স্বাধীনতার সময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর দেওয়া জাতীয় প্রতিশ্রুতি ঃ ‘Whenever the minorities of East Bengal will across the border they will be welcome’’  অর্থাৎ দেশভাগের বলি হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে যদি সংখ্যালঘু বাঙালীরা তদানিন্তন পুর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ছেড়ে ভারতে প্রবেশ করে তবে সসম্মানে এদেশে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে৷ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই দেশভাগের বলি উদ্বাস্তু পঞ্জাবী (৪৭ লক্ষ)-দের ক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হলেও বাঙালী উদ্বাস্তু (প্রায় ২ কোটি) দের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও আজ পর্যন্ত করা হয়নি৷ উপরন্তু দণ্ডকারণ্য ও মরিচঝাঁপির মত জায়গায় তাদের পাঠিয়ে বাঘ সিংহ ও কুমীরের ন্যায় জন্তু জানোয়ারদের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি

শুধু তাই নয়৷ দেশভাগের সময় জাতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল ইংরেজ আমলে বাংলার যে সমস্ত অঞ্চল কেটে বিহার, ওড়িষ্যা, অসম ইত্যাদি রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বৃহত্তর বঙ্গ গঠন করা হবে৷ ১৯৫৩ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন আইন করে বিভিন্ন রাজ্য পুনর্গঠন করা হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি৷ যদি বাংলার ক্ষেত্রে তা করা হত তবে অসম, ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালীদের আজকের মত পড়ে পড়ে মার খেতে হত না, এন আর সি-র কোপেও পড়তে হত না৷

বাঙালীরাই আসল ভূমিপুত্র

ইতিহাস  পর্যালোচনায় দেখা যায় যে অতীতে  অসম  বলে কোনও প্রদেশই  ছিল না৷ বাঙালীর  নেতৃত্বে  স্বাধীনতা সংগ্রামকে  বানচাল করতেই ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে  বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল কেটে বিহার ও ওড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে৷ সেই সময়েই অসম রাজ্য  গঠন করে বাংলার  রংপুর  ও মৈমনসিং জেলা থেকে  গোয়ালপাড়া, নওগাঁও, কামরূপ  হোজাই-লংকা , লামডিং ও ১৯২২ সালে শ্রীহট্টের  ১২টি থানা এলাকা  তথা  কাছাড়কে (পার্বত্য কাছাড় সহ)  অসমের সঙ্গে  জুড়ে  দেওয়া হয়৷ কাজেই  বর্তমান  অসমের  সেইসব অঞ্চল  প্রকৃতপক্ষে বাংলার জায়গা  ও সেখানকার  অধিবাসী  বাঙালিরা  যে  সেখানকার  ভুমিপুত্র  তা বলার অপেক্ষা  রাখে না৷ অন্যদিকে অসমের অহমিয়ারা ১৬৮৯ সালে বার্র্ম (মায়ানমার) থেকে এদেশে এসেছে৷ কাজেই ঐতিহাসিক বিচারে বাঙালীরা অসমের ভূমিপুত্র তথা বৈধ নাগরিক৷ আর অসমিয়ারা হ’ল বহিরাগত৷ এরই মধ্যে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এন আর সি-র মাধ্যমে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ব্রিটিশ পলিসি ‘ডিভাইড এণ্ড রুল’ প্রয়োগ করে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে বাঙালীদের একতাকে  দুর্বল করার মাধ্যমে সংগ্রামী চেতনাকে নষ্ট করে এখন বাঙালী জাতিটাকে ধবংস করে দেবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে৷

বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক চক্রান্ত

বাঙালী বিরোধী ষড়যন্ত্র  যে শুধু অসম, মণিপুরে চলছে তা তো নয়৷ দীর্ঘদিন ধরে চলছে ত্রিপুরায়৷ জুনের গণহত্যা ছাড়াও এখন এডিসি এলাকাকে নিয়ে আলাদা রাজ্য তিপ্রাল্যাণ্ডের দাবী,৪৯ সালকে ভিত্তি বছর ধরে এন আর সি প্রয়োগের দাবী ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালীকে ত্রিপুরা ছাড়া করবার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে৷ তাছাড়া গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড সহ গোটা ভারতে বাঙালীদের বিরুদ্ধে চলছে ষড়যন্ত্র৷ খোদ পশ্চিমবঙ্গেও চলছে গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের মত বাঙালী বিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্র৷ আর সব ষড়যন্ত্রের পেছনেই কলকাঠি নেড়ে চলেছে বাঙালী বিরোধী হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী কায়েমী স্বার্থবাদীরা৷

বঙালীর অতীত গৌরব

যে বাঙলা---যে বাঙালী জাতি রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বকবি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মত বিশ্ববরেণ্য নেতা, স্বামী বিবেকানন্দের মত ধর্ম জগতের এক দিক্পাল সহ শত শত মনীষীদের জন্ম দিয়েছে তাঁরা কী অভিমন্যুর মত সপ্তরথীর দ্বারা বেষ্ঠিত হয়ে মরে যাবে নাকি দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে, অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করবে? উদার সহনশীল জাত বলেই দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালীদের ওপর এত অন্যায়-অত্যাচার ও আঘাত চলছে৷ কিন্তু আর নয়৷ বাঙালীকে যারা শেষ করে দিতে চায় তারা জানে না বাঙালী কাপুরুষ নয়, বীরের জাতি৷ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামই যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘‘হিংস্র দুঃসময়ের পীঠের ওপর চড়ে বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হতে হবে৷ বাঙালী অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না, প্রচণ্ড মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে৷’’

বাঙালীস্তানের যৌক্তিকতা

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতীয় সংবিধান (পার্ট ওয়ানের তিন নম্বর ধারা) মোতাবেক বাঙলার কেটে নেওয়া অঞ্চলগুলিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘বাঙালীস্তান’ গড়াই হবে সমস্ত অন্যায়-অত্যাচার থেকে  বাঙালীদের বাঁচার একমাত্র পথ৷ এর জন্যে চাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম৷ তাই প্রতিটি বিবেকবান মানুষ শ্রমিক, কর্ষক, বুদ্ধিজীবী, তরুণ-তরুণীদের কাছে আমাদের আহ্বান আসুন এগিয়ে৷ আজ আমাদের শপথ হোক অন্ধকারের জাল ছিন্ন করে মোরা রাঙা প্রভাত আনবোই,বাঙলীর দুর্দশা ঘোচাবোই৷   

বাঙালী ঐক্য জিন্দাবাদ৷