‘এনেছিলে সাথে করে মৃতুহীন প্রাণ’

লেখক
পথিক বর

‘‘তোমরা মনে কোরোনা যে, আজ এই আদালতেই এ মামলার শেষ৷ মানব ইতিহাসের বিরাট বিচারালয়েও এই মামলার শুনানী চলবে চিরকাল৷

একদিন যখন তোমাদের সমস্ত বিচার-বিতর্ক নীরব হয়ে যাবে, যখন আজকের এই আন্দোলন ও উত্তেজনার কোনও চিহ্ণই অবশিষ্ট থাকবে না এবং আজ যিনি আসামী হয়ে তোমাদের সামনে দাঁড়িয়েছেন, তিনিও পৃথিবী থেকে চলে যাবেন, সেদিন সেই অনাগত যুগের মানুষ এই অরবিন্দকেই স্মরণ করবে, দেশপ্রেমের কবি বলে৷ মানবতার উপাসক বলে সমগ্র পৃথিবী তাকেই  দেবে সেদিন পুষ্পাঞ্জলী৷

আজ যে বাণী প্রচারের জন্য তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, সেদিন সেই বাণীর তরঙ্গ দেশ-দেশান্তরের মানুষের অন্তরে মহাভাবের প্রতিধবনী জাগিয়ে তুলবে৷’’

কথাগুলো বলেছিলেন আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দেশবরেণ্য নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ৷ আদালতে দাঁড়িয়ে যাঁর উদ্দেশ্যে কতাগুলি বলেছিলেন তিনি বিপ্লবী ঋষি শ্রীরবিন্দ৷

১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর ঢাকা বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন  দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ৷ বি.এ. পাশ করেন কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে৷ এরপর লণ্ডনের মিড্ল টেম্পল থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করেন৷

১৯০৯ সালে আলিপুর বোমার মামলায় শ্রী অরবিন্দ ও বিপ্লবীদের হয়ে তিনি লড়েছেন৷ তাঁর যুক্তি ও আবেগময় ভাষণের কাছে বাকরুদ্ধ বিচারক অরবিন্দকে মুক্তি দিনে বাধ্য হন৷

১৯১৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রত্যক্ষভাবে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন৷ ওই সম্মেমলনে তিনিই ছিলেন সভাপতি৷

১৯২০ সালে উচ্চ আদালতে প্রাকটিস্ ছেড়ে অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনে যোগ দেন৷ সেই সময় তিনি যে অঙ্কের টাকা উপার্জন করতেন প্র্যাকটিসে, হেলায় তাকে ত্যাগ করা আজকের দিনে অকল্পনীয়৷ আজ বরং রাজনীতি উপার্জনের উপায়৷ ১৯২১ সালে সুভাষচন্দ্র বসু আই.সি.এস. উপেক্ষা করে দেশের জন্যে কাজ করতে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ ভবিষ্যতের নেতাজী খুঁজে পেলেন নেতার নেতাকে৷

গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার মেনে নিতে পারেননি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন৷ তিনি কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই গড়ে তোলেন স্বরাজ দল৷ হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তাঁর স্বরাজ দলে যোগ দিয়েছিলেন৷ ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে স্বরাজ দল বিপুল ভাবে জয়ী হয়৷ চিত্তরঞ্জন দাশ হন কলকাতার মেয়র৷ ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন দার্জিলিংয়ে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে ভারতীয় রাজনীতিতে ইন্দ্রপতন ঘটে৷

দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে তাঁর ত্যাগ ও ভালবাসা তাঁকে দেশবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে৷ সুভাষচন্দ্র তখন মান্দালয়ে জেলে৷ শোকস্তব্ধ রবীন্দ্রনাথ দেশবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন---

‘‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান৷’’