গণতন্ত্রের বেদীতে ফ্যাসিষ্ট সাপের ছোবল

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

মহারাষ্ট্রে নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলী ভারতীয় রাজনীতির কুশীলবদের নীতিহীন রাজনীতির স্বরূপটা আর একবার নগ্ণ করে দিল৷ গণতন্ত্রকে পদদলিত করে, জনমতকে উপেক্ষা করে শক্তিমদের যে সাংঘাতিক চেহারা নির্লজ্জ নেতারা দেশবাসীকে দেখাল তা কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের নেতাদের পক্ষে শোভন নয়৷

নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি নেতারা এন সি পি নেতা অজিত পাওয়ারকে নির্বাচনের পর জেলে ঢোকাবার হুমকী দিয়েছিল৷ অজিত পাওয়ার তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থীকে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন৷ ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর জমানত জব্দ হয়৷ নির্বাচনে বিজেপি-শিবসেনা জোটবদ্ধ ছিল৷

কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী খেলাটা দলগুলোর চেহারা পাল্টে দিল৷ ক্ষমতার লোভে সেই জামানত জব্দ দলের দ্বারস্থ হলেন অজিত পাওয়ার৷ আর বিজেপি---যে দুর্নীতির দায়ে অজিতকে জেলে ঢোকাবার হুমকী দিয়েছিল সেই দুর্নীতির মামলাটাই প্রত্যাহার করে নিল ক্ষমতার মোহে৷ আর শিবসেনারও নির্বাচন পূর্ব জোট ছেড়ে নতুন জোটে ভিড়তে এতটুকু সংকোচ হয়নি৷

ভারতীয় রাজনীতির এই পশ্চিমী c,এই অশোভন আচরণ নতুন নয়৷ গান্ধী মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি পদে জয়ী হওয়ারপর ভারতীয় রাজনীতির এই পশ্চিমী ফ্যাসিষ্ট রূপ প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল৷ সেদিন গান্ধী মনোনীত প্রার্থী সীতারামাইয়ার পরাজয় গান্ধী ও তার ভক্তরা মেনে নিতে পারেননি৷ গান্ধী বললেন---‘‘সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়৷’’ আর গান্ধী ভক্ত নেতা শেঠ গোবিন্দ দাস বললেন---‘‘ফ্যাসিষ্টদের মধ্যে মুসোলিনীর, নাৎসীদের মধ্যে হিটলারের ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে ষ্ট্যালিনের যে স্থান কংগ্রেস সেবীদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর সেই স্থান৷’’ উপস্থিত সমর্থকদের কণ্ঠে আওয়াজ উঠল---‘‘হিন্দুস্থান কা হিটলার কি জয়’’৷ অর্থাৎ গণতন্ত্র নয় হিটলারী গান্ধীতন্ত্রই কংগ্রেসের শেষ কথা৷

প্রতিবাদে কলম ধরলেন ব্যাথিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---‘‘অবশেষে আজ এমন কি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেও হিটলারী নীতির জয়ধবনী শোণা গেল৷ ....স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্য যে বেদী উৎসৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিষ্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷ ....তিনি আরও লেখেন---কংগ্রেসের অন্তঃসঞ্চিত ক্ষমতার তাপ হয়তো অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে সন্দেহ করি৷ যাঁরা এর কেন্দ্রস্থলে এই শক্তিকে বিশিষ্টভাবে অধিকার করে আছেন, সংকটের সময় তাঁদের ধৈর্য্যচ্যুতি হয়েছে, বিচারবুদ্ধি সোজা পথে চলেনি৷ পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য, যে বৈধতা রক্ষা করলে যথার্থভাবে কংগ্রেসের বল ও সম্মান রক্ষা হ’ত, তার ব্যভিচার ঘটতে দেখা গেছে, এই ব্যবহার বিকৃতির মূলে আছে শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব৷

এই তপোক্ষেত্রে যাঁরা রক্ষকরূপে একত্র  হয়েছেন, তাঁদের মন কি উদারভাবে নিরাসক্ত? তাঁরা পারস্পরিক আঘাত করে যে বিচ্ছেদ ঘটান সে কি বিশুদ্ধ সত্যেরই জন্যে? তার মধ্যে কি সেই উত্তাপ একেবারে নেই, যে উত্তাপ শক্তিগর্ব ও শক্তিলোভ থেকে উদ্ভূত? ভেতরে ভেতরে কংগ্রেসের মন্দিরে এই যে শক্তিপূজার বেদী গড়ে উঠেছে তার কি স্পর্দ্ধিত প্রমাণ এবারে পাইনি---যখন মহাত্মাজীকে তার ভক্তেরা মুসোলিনী ও হিটলারের সমকক্ষ বলে বিশ্বসমক্ষে অসম্মানীত করতে পারলেন? ....

তিনি জওহরলালের কাছে প্রশ্ণ রাখলেন---‘‘আমি তাঁকে প্রশ্ণ করি, কংগ্রেসের দুর্গদ্বারের দ্বারীদের মনে কোথাও কি এই ব্যক্তিগত শক্তিমদের সাংঘাতিক লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করেনি?’’

মহারাষ্ট্রে ক্ষমতার কুর্সী দখলের যে জঘন্য খেলা দেশবাসী দেখল তার শুরু সেই দিনই হয়েছে৷ দল হিসেবে যদিও বিজেপি কংগ্রেস বিরোধী কিন্তু তার আজকের কাণ্ডারী ‘হিন্দুস্থানকা হিটলার-এরই অনুগত ভক্ত৷ তাই শক্তিমদের সেই সাংঘাতিক লক্ষণ আজ আরও সাংঘাতিকভাবে ফুটে উঠেছে৷

রবীন্দ্রনাথ সেদিন সুভাষচন্দ্রকে লিখেছিলেন---অসুস্থ শরীর নিয়ে কংগ্রেসের দুঃসাধ্য কাজে তোমাকে পীড়িত করেছিল সে জন্য আমরা সকলেই উৎকণ্ঠিত ছিলাম, এখনও উৎকণ্ঠার কারণ আছে৷ আশা করি উপযুক্ত শুশ্রুষায় ও বিশ্রামে তুমি আরোগ্যের পথে চলেছ এবং বাঙলাদেশের হয়ে তোমাকে সম্মানদানের যে সংকল্প আমার মনে আছে  তা সফল হতে বিলম্ব হবে না৷

দূরদর্শী কবি শক্তিমদের পরিণতি সেদিনই বুঝেছিলেন৷ তাই তিনি সুভাষকে বাঙলাদেশের হয়ে সম্মানদানের সংকল্প সেদিন নিয়েছিলেন৷ হিন্দুস্থান কা হিটলার ও তার অনুচরদের ঘৃণ্য চক্রান্তের শিকার হয়ে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন৷ মর্মাহত কবি তাঁর সংকল্প রক্ষা করতে বিলম্ব করলেন না৷ এক ঐতিহাসিক পত্রে তিনি লিখলেন---‘‘সুভাষচন্দ্র, বাঙালী কবি আমি, বাঙলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি৷ ওই পত্রেই তিনি লিখেছেন---‘‘হিংস্র দুঃসময়ের পীঠের ওপর চড়ে বাঙালীকে বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হতে হবে৷....’’

আজ ভারতবর্ষে সমগ্র বাঙালী জাতি সেই বিভীষিকাময় দুঃসময়ের সম্মুখীন৷ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সেই ফ্যাসিষ্টের সাপ ফোঁসফোঁস করছে৷  রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের সেই ফ্যাসিষ্ট রূপ নগ্ণ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে৷ বাঙলার দিকেও সেই ফ্যাসিষ্ট সাপ বিষাক্ত ফনা তুলে এগিয়ে আসছে এন.আর.সি.-র হিস্হিস্ শব্দে৷ বাঙালীর কাছে আশা শুধু সেই রবীন্দ্রনাথেরই আশ্বাসবাণী৷ ওই পত্রেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন---‘‘অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে বাঙালী মরবে না৷.... প্রচণ্ড মার খেয়েও মারের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে বাঙালী৷’’

সত্যদ্রষ্টা কবির আশ্বাসবাণী ব্যর্থ হবে না৷ ফ্যাসিষ্ট সাপের শক্তি ও ক্ষমতার স্পর্ধাকে চূর্ণ করে নতুন বাঙলা---নতুন ভারত তথা নতুন বিশ্ব গড়ার পথ বাঙালীই দেখাবে৷