গণতন্ত্রকে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে হবে না হলে গণতন্ত্র ব্যর্থ

লেখক
প্রভাত খাঁ

১৯৫০ সালের ২৬শে জাানুয়ারী থেকে সংবিধান মোতাবেক দেশের কেন্দ্র ও রাজ্যে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে শাসন চলছে৷ যদি সমীক্ষা করা যায় তাহলে দেখা যাবে এই সাধারণতন্ত্রের অর্থ কী সেটা মনে হয় খুব কমই লোক জানেন ও বোঝেন৷ তবে ১৫ই আগষ্টের দিনটিকে অনেকেই স্মরণে রেখেছেন৷

মূলত যাঁরা শাসনে আছেন তাঁরা এই দিনটিকে স্মরণে রাখেন কারণ এই দিনটি তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এই দিনটির জন্যেই তাঁরা প্রশাসনিক অধিকার আইনসম্মতভাবে পেয়েছেন৷ বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার পেয়েছেন ও তার জন্যে তারা শাসন ক্ষমতা লাভ করে দেশ শাসন করে থাকেন৷ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ১৮ বছর বর্তমানে বয়স হলেই তিনি বোট দানের সুযোগ পান আর দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পান৷ এটাই গণতন্ত্রে বড় রাজনৈতিক পাওয়া৷

তবে সত্তর বছরের শাসনকালে সংবিধান সংশোধন হয়েছে প্রায় ১২৪ থেকে ১২৫ বার৷ তাই আজ আমরা আগের সংবিধানকে খুঁজে পাইনা৷ আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক দেশে কয়েকশো বছরের সংবিধান মাত্র হাতে গোণা দু’বার সংশোধন হয়েছে৷ সেখানকার গণতন্ত্র এদেশের চেয়ে অনেক মজবুত আর নাগরিকগণও আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে অনেক সচেতন৷  আজ আমরা শুধু রাজনৈতিক যৎসামান্য অধিকারটুকু পেয়েছি৷ যদিও ভয়ঙ্কর দলবাজীর জন্যে সকলে মতদানের সুযোগ পান না৷ নির্বাচনে নানাভাবে কারচুপির জন্য অনেকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন৷ গণতন্ত্রের সার্থকতা তখনই যখন নাগরিকগণ আর্থিক ও সামাজিক গণতন্ত্র ভোগ করতে পারেন৷ অদ্যাবধি দেশের সিংহভাগ মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে পাঁচটি অত্যাবশক জিনিস যেমন অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থান থেকে বঞ্চিত৷ অধিকাংশ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় আতঙ্কগ্রস্ত৷ কিন্তু ভাগ্যবান কিছু সংখ্যক মানুষদের এটা স্বর্গরাজ্য৷ যারা ধনী ও বিশেষ করে শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত সব কিছু সুযোগ সুবিধা তারা পেয়ে থাকেন৷

অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা হ’ল এই যে যখন কোন দল শাসনে আসে তখন নিছক সংখ্যাধিক্য এম.এল.এ. ও এম.পি.দের জোরে প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন করে শাসন চালিয়ে যান৷ তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটাভুটির তোয়াক্কা না করে অধ্যাদেশ জারী করে নিজেদের মত কাজ করে যান৷ এ ধরণের ভুরি ভুরি উদাহরণের আমরা সম্মুখীন হয়েছি৷

জনগণ এদেশে নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ বছরগুলিতে গদীতে আসীন দলগুলির সুললিত হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি শুনেছেন৷ কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য যে যে অত্যাবশক জিনিসগুলি প্রয়োজন সেগুলিতে থেকে বঞ্চিত হয়েই আসছেন৷

সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে আমাদের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বৈচিত্র্য, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধি---এই তিনের ভারসাম্যই দেশের লক্ষ্য৷

সবচেয়ে বড় কথা তিনি যা বলেছেন তা থেকে এখনও আমরা বহুদূরে৷ সৃষ্টির মূল রহস্য হ’ল, বৈচিত্র্যই প্রকৃতির ধর্ম৷ সমান বলে কিছুই নেই৷ তাই তারই মধ্যে মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে ঐক্যকে বজায় রাখাটাতেই গণতন্ত্রের সার্থকতা৷ এই সার্থক গণতন্ত্রে আসতে পারে সুষ্ঠু সামাজিককরণ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে৷ তা আনতে গেলে সমাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল নীতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন৷ তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মানুষের আত্মিক জ্ঞানের বিাকাশ ঘটিয়ে সামূহিক মনস্তত্ত্বের সৃষ্টি করতে হবে৷ মানুষ তখন পরস্পরকে আপন বলে গ্রহণ করবে৷ সকলেই সকলের কল্যাণ কামনায় কিছু না কিছু আত্মত্যাগ করবে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এদেশে তো সেটারই দারুণ অভাব৷ এখানে তো শোষণের ওপরেই সমৃদ্ধি দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই তো এত ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য৷

এদেশে গণতন্ত্র সংকীর্ণ দলতন্ত্রের দ্বারা বিধবস্ত ও অস্বীকৃত৷ এটা খুবই দুঃখের ও বেদনার৷ ‘সমৃদ্ধি’ শব্দটার অর্থ হ’ল সম্যকরূপে বৃদ্ধি৷ এই বৃদ্ধি সকলের হওয়া উচিত৷ কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাটা দাঁড়িয়ে আছে বণ্টনের ক্ষেত্রে মচরম বৈষম্যের ওপর৷ এর ফলে কোটি কোটি মানুষ নানা দিক থেকে শোষিত হচ্ছে৷ সেখানে ভারসাম্য আসবে কি করে? তাই গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা তো সরকারকে করতে হবে! অত্যন্ত দুঃখের কথা নির্বাচনে নাগরিকদের মতদানটাতেই তো রয়ে গেছে নানান জটিলতা৷ তার মূল কারণ হ’ল রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় স্বার্থে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংকীর্ণ নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ তার ওপর গণতন্ত্রে জাতপাত ও সম্প্রদায়ের প্রাধান্যও খুবই বিসদৃশ৷ গণতন্ত্র তখনই সার্থক যখন তা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকে সকল নাগরিকের সার্বিক কল্যাণে কাজ করতে পারে৷ বর্তমানে গদির স্বার্থে দলতন্ত্রটাই হয়েছে প্রবল৷ তাই অতীতে অনেক রাজনৈতিক নেতা দলহীন গণতন্ত্রের কথা বলে গেছেন৷ মোদ্দা কথা গণতন্ত্রকে প্রগতির সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, নাহলে গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে৷