গ্রাম স্ব-নির্ভর হলে দেশ স্ব-নির্ভর হবে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

স্বাধীনতারপর সাত দশক পার হয়ে গেলেও সর্বসাধারণের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে, সামগ্রিকভাবে দেশের হতদরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্যে কোন বলিষ্ঠ ও বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি৷ এর একমাত্র কারণ ভারতবর্ষের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় পুঁজিপতিরা, অর্থনীতিবিদ্ ও নেতারা শিখণ্ডী মাত্র৷

 প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতি হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রয়োগভৌমিক বিজ্ঞান৷ দুঃখের বিষয় কর্পোরেট জগতের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির এই বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন৷ দিতে বাধ্যই হয়েছেন ক্ষমতাবানদের চাপে পড়ে৷ ধুল্যবলুণ্ঠিত, পদদলিত, অবহেলিত হতদরিদ্র মানুষের উন্নয়নের চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি৷

কেন্দ্রিত অর্থনীতি কর্পোরেট জগতের লুণ্ঠন ও সাধারণ মানুষকে শোষণের পথ প্রশস্ত করেছে৷ তাই স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার করেও গরীব মানুষগুলো উন্নয়নের মুখ দেখতে পায়নি৷ এর জন্যে দায়ী শুধু অর্থনীতিবিদ্রা নয়, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতারাও এর দায় অস্বীকার করতে পারবে না৷ প্রাউট-প্রবক্তার ভাষায়---আজ অর্থনীতি বস্তাপচা তত্ত্বকথার কচ্কচানি ছাড়া আর কিছুই নয়৷ একে অধিকতর বাস্তবমুখী করতে হবে৷

আজ পর্যন্ত দেশের কি সরকার কি অর্থনীতিবিদ সেই বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পথে পা বাড়াননি৷ অর্থনীতিবিদ্রা অবশ্য বাস্তব বলতে যদি পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করাটই বোঝেন তবে তারা ১০০ ভাগ সফল৷ আজ পুঁজিবাদী শোষক তার শোষণের জাল সমাজের সর্বস্তরে বিছিয়ে দিয়েছে৷ মানুষের অস্তিত্বকে চরম বিপর্যয়ের সীমায় নিয়ে এসেছে৷ প্রাউট-প্রবক্তার ভাষায়---‘আজ সমগ্র মানব সমাজ বৈশ্য শোষণের নিষ্পেষণে ওষ্টাগত প্রাণ৷’

মানুষকে বৈশ্য শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর  আমূল পরিবর্তন৷ এর খোল-নলচে বদলে এমন এক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজন যেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিপতির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা গড়বে সমষ্টির কল্যাণের স্বার্থে৷ প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বহিরাগতের কোনও ভূমিকা থাকবে না৷ কোন এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় বহিরাগত নাক গলালে স্থানীয় মানুষের স্বার্থ ব্যাহত হবেই৷ ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সবথেকে বড় ত্রুটি এটাই৷ রাজধনীর ঠাণ্ডা ঘরে বসে যাঁরা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনা করেন  ভারতবর্ষের গ্রামের সঙ্গে তাঁদের নাড়ীর যোগ নেই৷ অর্থনীতির জটিল তত্বে তাঁদের যতই পাণ্ডিত্য থাক দেশের ভূগোল, ইতিহাস, জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় নেই৷ কর্পোরেট ভারতের অঙ্গুলী হেলনে তাঁরা অর্থ পরিকল্পনা রচনা করেন৷ সেই পরিকল্পনায় গ্রামের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করার বাগাড়ম্বর থাকলেও বাস্তবের ছোঁয়া লেশমাত্র থাকে না৷ দরিদ্র জনগণ বোঝেই না অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী জিনিস৷

প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবন ধারণের নূন্যতম প্রয়োজন অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, আবাস, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চিততা দেওয়া৷ এই লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পরই উদ্বৃত্ত সম্পদকে সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবে কাজে লাগাতে হবে৷ প্রাউটের পরিকল্পনা শুরু হবে ব্লক স্তর থেকে৷

একসময় যে জনপদ সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে অবস্থান করত পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে সেই জনপদই শ্রীহীন সম্পদহীন হয়ে পড়ে৷ প্রাউট-প্রবক্তার দৃষ্টিতে জনপদগুলির শ্রীহীন হওয়ার কারণ হ’ল যে নদীকে কেন্দ্র করে জনপদ গড়ে ওঠে সেই নদী মরে যাওয়া বা সরে যাওয়া, দ্বিতীয় কারণ হ’ল গ্রাম থেকে শিল্প সরে যাওয়া বা নতুন শিল্প গড়ে না ওঠা, তৃতীয় কারণ শিক্ষাগত ত্রুটি অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা৷ এইসব কারণেই গ্রাম্যজীবনের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে৷ বলা যেতে পারে বৈশ্য শোষকরা তাদের স্বার্থে গ্রাম্য জীবনের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে৷

একটি অঞ্চলে বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হলে কৃষিকে যেমন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে শিল্পকেও তেমনি কৃষির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে৷ এখন কৃষি ও শিল্পের সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্রাউট দেখিয়েছে কীভাবে ১০০ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে৷ প্রাউটের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কৃষিনির্ভর মানুষের হার কিছুতেই ৪০-এর ওপরে উঠতে দেওয়া উচিত হবে না৷ জনসংখ্যার আনুমানিক ২০ শতাংশের মত মানুষ থাকবে কৃষিনির্ভর শিল্পে৷ ২০ শতাংশ থাকবে কৃষি সহায়ক শিল্পে৷ ১০ শতাংশের মত মানুষ থাকবে সাধারণ ব্যবসায়, বাকী ১০ শতাংশ থাকবে বুদ্ধিজীবী বা  চাকুরীজীবী বা অন্যান্য সরকারী কাজে৷ এর পরেও থাকে অকৃষি শিল্প৷ এই অকৃষি শিল্পের হার ঠিক করতে হবে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অকৃষি শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থেকে৷ অকৃষি শিল্পের নিয়োগ হবে উপরে উল্লিখিত শতাংশের হার প্রয়োজনমত কমিয়ে৷ এইভাবে কৃষি-শিল্পের ভারসাম্য বজায় রেখে গ্রাম্য জীবনে গড়ে উঠবে সুসন্তুলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক সংরচনা৷

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ শিল্পগুলি ধবংস হয়ে যাওয়ায় ও নতুন শিল্প গড়ে না ওঠার কারণে কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ পড়েছে৷ তেমনি শিক্ষিত চাকুরী প্রার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে৷ সেই হারে বাড়ছে বেকার সংখ্যা৷ দেশের কোন সরকারই এখনও পর্যন্ত গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার কোনও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি৷ শিল্পের অভাব ও কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ গ্রামীণ অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবে গ্রামীণ মানুষ শহরমুখী হয়েছে৷ ফলে সমাজে দেখা দিয়ে এক দুর্বিসহ অবস্থা৷ এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে বৈশ্য শোষকরা৷

আজ পুঁজিবাদী আগ্রাসন,কেন্দ্রীত অর্থনীতি ও সরকারের ভ্রান্ত পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সামনে এনে ফেলেছে৷ সরকার কোভিড-১৯ বিপর্যয়ের ঘাড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় চাপিয়ে দৈব দুর্বিপাক বলে পার পেতে চাইছে৷ কিন্তু স্বনির্ভরতা কোনপথে  আসবে সে বিষয়ে নীরব৷ কারো কারো এমনটাও মনে হতে পারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় ঘাড়ে চাপাতে কোভিড-১৯কে আনা হয়েছে৷ সে যাই হোক---সামনে ভয়াল পরিণতি অপেক্ষা করছে৷ সরকারের হাতে এখনও সময় আছে, পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত না থেকে প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামগুলিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তুললে দেশ স্বনির্ভর হবে, মানুষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখবে৷