হাথরস কাণ্ড সভ্যতার  কলঙ্ক ঃ সমস্যার সমাধান কোন্ পথে?

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

বিশ্বসৃষ্টির দুটি ধারা৷ প্রথম ধারা হ’ল ভূমাচৈতন্য থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি---সূক্ষ্মতম সত্তা থেকে স্থূলতম জড় সৃষ্টি৷ এটাকে বলে সঞ্চরধারা৷ আর এর পরবর্তী ধারা হ’ল প্রতিসঞ্চর ধারা৷ এককোষী জীব থেকে চেতনার বিকাশ হতে হতে বিভিন্ন জীবজন্তু সৃষ্টির পর মানুষের যে সৃষ্টি ও পরে মানুষের বিকাশ--- এটাকেই বলা হয় প্রতিসঞ্চর ধারা৷ প্রতিসঞ্চর ধারায় বুদ্ধি-চিন্তা চেতনা তথা বিবেকের বিকাশ হয়৷ সৃষ্টির এটাকেই স্বাভাবিক বিকাশ বলা হয়৷ কিন্তু বর্তমানে কি ‘ঋণাত্মক অর্র্থৎ নেগেটিব প্রতিসঞ্চর ধারা বেয়ে মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে৷ মানে---প্রগতির  উল্টো দিকে --- অধঃপতনের দিকে চলেছে? মানুষ থেকে পশু-জন্তু-জানোয়ারদের দিকে চলছে?

বর্তমানে অন্ততঃ সারা দেশ জুড়ে নারী নির্যাতনের বিশেষ করে নারীর ওপর বলাৎকার করে খুন করার ঘটনা যেভাবে একের পর  এক ঘটে চলেছে--- এতে মনে হচ্ছে মানুষ পেছন দিকেই দ্রুত হাঁটছে৷

আবার বিশেষ করে সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের  হাথরাসে  ১৯ বছরের তথাকথিত দলিত শ্রেণীর কিশোরী কন্যা মনীষা বাল্মিকীকে যেভাবে তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর চার যুবক চরমভাবে পাশবিক নির্যাতনের পর মেরে মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে বার বার গলায় দড়ি বা কাপড় পেঁচিয়ে খুন করেছে--- তাতে মনে হয় এই তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় মানুষেরা চারপেয়ে জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে চরমভাবে অধমে পরিণত হয়েছে৷ পশুর সঙ্গে এদের তুলনা করলে পশুদের অপমান করা হবে৷ হিংস্রতায় এদের সঙ্গে কোনও জন্তু জানোয়ারের তুলনাই হয় না৷

এই ঘটনায় আরও বিস্ময় জাগে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এই জন্তুদের  বাঁচাতেই শশব্যস্ত ছিল, তাদের অপকর্মকে ঢাকতে এরা মনীষার  মৃতদেহকে তার আত্মীয় স্বজনের হাতে তুলে না দিয়ে তার বাবা-মা-ভাইবোনকে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে মধ্যরাতে  মাঠে পুলিশ প্রহরায় জ্বালিয়ে দেয়৷ বাড়ীর লোককে পুলিশ আধিকারিক বলেছে, তোমাদের ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে, ১টা বাড়ী দেওয়া হবে ও ১জনকে চাকরী দেওয়া হবে একটাই শর্ত সাংবাদিকদের কিছু বলবে না, ধর্ষণের  অভিযোগও তুলে নেবে৷

অথচ প্রথমে ওই তরুণীকে যে জওহরলাল নেহেরু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ওই হাসপাতালে৷ ময়না তদন্তের দায়িত্বে থাকা তিন ডাক্তারই জানিয়েছে মেয়েটির ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছিল, তারপর তাকে গলা টিপে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল, পরে দড়ি বা কাপড় পেঁচিয়ে বার বার ফাঁস দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল, কারণ গলায় একাধিক ফাঁসের দাগ রয়েছে৷ দড়ি বা কাপড় দিয়ে বার বার প্যাঁচ দেওয়ার কারণে গলার হাড় ভেঙ্গে গেছে৷ প্রচণ্ড মারধোর করা হয়েছে৷ মেরুদণ্ডের হাড়গুলো মারাত্মকভাবে জখম  ছিল৷ এই হাসপাতাল থেকে পরে দিল্লির  সফদরজঙ্গ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়৷ এখানে ১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে  লড়াই করে মনীষা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷

এ ধরণের ঘটনায় অন্যান্য ক্ষেত্রে সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে, প্রশাসনও দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে সক্রিয়তা দেখায়, এক্ষেত্রে অন্য চিত্র৷ এক্ষেত্রে তথাকথিত উচ্চবর্ণের চার যুবকের পক্ষে গ্রামে ঠাকুর সম্প্রদায়ের মহাপঞ্চায়েতের (মহাসভা) আহ্বান করা হয়৷ সেখানে নেতৃত্ব দেন প্রাক্তণ এক বিজেপি’র বিধায়ক৷

এই ঘটনার নিন্দার ভাষা নেই৷ এক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশের বিজেপি প্রশাসনের ভূমিকার বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই৷ আমাদের দাবী৷ চার অভিযুক্ত অপরাধীসহ প্রশাসনেরও যারা এই অপরাধকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে---তাদের সকলেরই কঠোর শাস্তি হোক৷

দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের পর মেয়েদের ওপর বলাৎকার  ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল, সংসদে কঠোর আইন পাশও হয়েছিল, ওই কেসের অপরাধীদের ফাঁসীও হয়েছে, কিন্তু মেয়েদের ওপর বলাৎকার, খুন, বধূ হত্যা প্রভৃতি যে হ্রাস পায় নি--- তা প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা খুললেই বোঝা যায়৷ অর্থাৎ সমস্যার সমাধান তো হচ্ছে না! এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উপায় কী?

আসলে কেবল কঠোর আইন প্রণয়ন করলে হবে না, হাজার মোমবাতি  মিছিল বা প্রতিবাদ সভার ঝড় উঠিয়েও কিছু হবে না৷ এ রোগ কোভিড-১৯-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর রোগ৷ এই রোগের বিনাশের  জন্যে সুচিন্তিত পরিকল্পনা চাই৷ মানুষের মনের মধ্যে পশুপ্রবৃত্তি  রয়েছে৷ মানুষের  উন্নত বুদ্ধির সংযোগে সেই পশুপ্রবৃত্তি চরম হিংস্রতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে৷ তাই প্রথমে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচে বদলে শিশুকাল থেকে ব্যাপক নৈতিক শিক্ষায় সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার  মাষ্টার প্ল্যান নিতে হবে৷  দ্বিতীয়তঃ কঠোর নীতিবাদী, অর্থাৎ দৃঢ়ভাবে নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত মানুষ ছাড়া অন্য কাউকেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া যাবে না৷ লক্ষণীয় ব্যাপার, বর্তমান লোকসভার মোট সদস্যদের মধ্যে ২৩৩ জন (৪%) বিভিন্ন ক্রিমিন্যাল কেসে জড়িত৷ এর মধ্যে ১৫৯ জন (২%) বিভিন্ন ভয়াবহ অপরাধ , যেমন ধর্ষণ, খুনের চেষ্টা, অপহরণের মত অপরাধে অভিযুক্ত৷ দেশের শাসকগোষ্ঠীর এই অবস্থা হলে দেশে সুশাসন আশা করব কী করে?

দেশের সুউচ্চ নৈতিক মানের বিকাশ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে৷

প্রাউটের দৃষ্টিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যে Internal urge & extrenal presure’ -দুই-ই চাই৷Internal urge হ’ল অভ্যন্তরীণ প্রেরণা৷ উপযুক্ত নৈতিক  ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যেন তার অন্তর থেকে  সততা ও নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার,সততঃ অভ্যন্তরীণ প্রেরণা লাভ করতে পারে৷ তার  সঙ্গে অবশ্য নীতিবাদী প্রশাসকের দিক থেকে বাইরের থেকে আইন তথা প্রশাসনিক চাপও রাখতে হবে৷ একমাত্র এই দুটোর  ঠিকভাবে সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়েই এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব৷