ঈশানকোণে মেঘের আনাগোনা

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

রাজ্যে আবার অপহরণের রাজনীতি শুরু হয়েছে৷ সম্প্রতি উত্তর ত্রিপুরা জেলার দামছড়ার জয়রাম পাড়া  থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা পঁয়ত্রিশ বছরের জনৈক লিটননাথকে দুষৃকতিকারীরা অপহরণ করে নিয়েছে৷ আজ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃপক্ষ অপহৃতের কোন খোঁজ পান নি৷ তাই, অপহৃতের তিনকন্যা ও কোলের শিশুপুত্রসহ পত্নী ও অন্যান্য পরিবাব -পরিজনেরা যথেষ্ট উদ্‌বেগের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন বলে দৈনিক খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় দেখতে পেলুম৷ কাজে কাজেই এ থেকে রাজ্যবাসীদের কেউ কেউ উদ্বেগ যে বোধ করছেন না তা নয়৷ ফেস-বুকের  মাধ্যমে ‘আমরা বাঙালী’ সংঘটনের উদ্বেগের কথা ও প্রশাসনের কাছে তাদের মতামত ব্যক্ত করার কথা প্রকাশ পেয়েছে৷ কিন্তু, এতে প্রশাসনের কুম্ভকর্ণ-নিদ্রার কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটেছে বলে কোনরূপ সাড়া-শব্দ বা গতি প্রকৃতি এখানে জনগোচরে এসেছে বলে বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে, আমাদের রাজ্যের রাষ্ট্রপতির পুরস্কার-ধন্য পুলিশ পুঙ্গবদের যারা অপহরণকারীদের তল্লাসীর কাজে রত ছিলেন তাদেরই মুখ নিঃসৃত অন্তরের বাণী ফেসবুক মাধ্যমেই দৃষ্টিগোচরে এসে গেছে কালো অক্ষরে ---‘‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাইতাম না’’ এ ধরনের উক্তিসমেত৷ যদি সত্যিই এই ঘটনা বাস্তবায়িত  হয়ে থাকে তাহলে তাদের অবশ্যই ‘‘বাহবা’’ সমেত সাধুবাদ জানাতেই হচ্ছে৷ কেননা, এই  অপহরণ-ঘটনার মাত্র দিন কয়েক আগে পানিসাগরে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন কারীদের ওপরে জলকামান দাগিয়ে আর বেপরোয়াগুলি চালিয়ে যারা নিরস্ত্র লোকদের হতাহত করতে সক্ষম ছিল, সেই পুলিশবাহিনীরাই তথা এ রাজ্যের আরক্ষাবাহিনীরই উপযুক্ত বীরপুঙ্গবদের উক্তি যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না৷ সাবাশ জোবান! সাবাশ, এরাজ্যের  কংজমানা আর বাম-জমানার পর, বর্তমানের রাম-জমানার  পুলিশ বাহাদুরগণ! এতো সচ্চী বীর কী বাত হুয়ী! জীবনের  ঝুঁকি নেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? আর চাকরি করার খাতিরে তো ডিউটি কা সবাল , তাই না?  তো ডিউটি-পরায়ণতা দেখাতে গিয়ে যদি প্রাণটা খুইয়ে ফেলতে হয়! তোবা তোবা, ইয়ে তো গজবকী বাত হুয়ী৷ তো ঠিক হ্যায় পুলিশজী, অ্যাপ্‌ তো বিলকুল সহী বাত কী থী৷’

কিন্তু, প্রশ্ণ এবার রাজ্যের পুলিশ তথা আরক্ষা কর্তাদের উদ্দেশ্যে আর রাজ্যের মহামান্য পুলিশ দপ্তর  তথা আরক্ষা দপ্তর তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মান্যবর  মন্ত্রী মহোদয়ের সকাশে৷ জনাব,৭২ ঘন্টা সময় কেটে গেলেও আপনার ও আপনাদের কর্মতৎপরতার  কোন লক্ষণ না বুঝতে পেরে আমরা রাজ্যবাসী অনেকেই কিন্তু প্রমাদ গুনতে  শুরু করেছি৷ কারণ? শুণুন তবে কারণগুলো ঃ---

(১) পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যষ্টি ছিলেন কিনা অপহৃত ব্যষ্টি জানা নেই৷ যদি তা-ই হয়ে থাকেন, তবে এ অবস্থায় পরিবারটির রসদ-যোগাড়ের উপায় রয়েছে কিনা, গরজ নিয়ে সেটা ভাবার ও দেখার  দায়িত্ব কিন্তু রাজ্যের নিরাপত্তা তথা আরক্ষা দপ্তরের ওপরই বর্তায়৷ দ্বিতীয়তঃ কমোনসেন্স ও একথা বোঝায় যে গৃহমন্ত্রনালয় তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়্ চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ, অপহরণ-নির্যাতন, বে-আইনী আক্রমণ বা অভিযান অথবা জন-জীবনে হানিকর যে -কোন বাদ বিসংবাদগুলো নিয়ে ভাববেন৷ তদুপরি, এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই যেহেতু আমাদেরই সৌভাগ্যবশতঃ স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশ মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন আর এ অবস্থাতেই অতীতের জঙ্গল রাজত্বের দুরবস্থার পুনরাবৃত্তির অভিজ্ঞতা আমাদের নিতে  হচ্ছে, তাতে ‘‘চলো পাল্টাই’’-এর বাহাদুরি যে নিতান্তই কপটতা তথা সোজাভাষায় ধোঁকাবাজি ছিল তা তো আর কোন যুক্তিতেই ঢেকে রাখতে পারবেন না৷

(২) হ্যাঁ বেশ বুঝতে  পারা যাচ্ছে--- খুব সম্ভবতঃ বিগত শতাব্দীর আশির দশকের সেই কালোতম অভিশপ্ত দিনগুলোর পুনরাবির্ভাব ঘটবার বা ঘটাবার কোন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ভেতরে ভেতরে চালানো হতেও পারে৷ কারণ, এরাজ্যবাসী মাত্রেই ভালভাবে জানেন যে রাজ্যের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিতে আর শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে হলে ‘উগ্রপন্থা’, অপহরণ বাণিজ্য’ ইত্যাদি একটা নির্ভরযোগ্য মূলধন৷ আর, তাই যদি হয়, তাহলে  পূর্র্বেক্ত দামছড়ার ঘটনা ও এর পরবর্তী সময়ে ঊনকোটি জেলার ডেমজুমের ঘটনা--- এই দুটো ঘটনাই কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ বলেই মনে হচ্ছে৷ আর যদি এই অনুমান বা সংশয়ের পেছনে কিঞ্চিৎ মাত্রায়ই বাস্তবতার লেশমাত্র থেকে থাকে, তাহলেই বলতে হচ্ছে---মাঝিভাই, সামাল! সামাল! ঈশাণকোণে কালো মেঘের আনাগোনা চলছে ঝড় এল বলে! দেখো যে তরীর না ভরাডুবি হয়!

(৩) তৃতীয়ত ঃ বলতেই হচ্ছে যে, ঘরপোড়ারা নাকি সিন্দুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়৷ সামনেই তো রাজ্যে ‘‘এডিসি’’নির্বাচন৷ তাই, এ নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে যদি রাজ্যের বর্তমানে চলা অর্থনৈতিক দুর্গতির  সঙ্গে  পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ গড়ে তুলে অবাঞ্চিতরূপে অস্থিরতা তৈরী করা যায়, তাহলে ঘোলাজলে মাছ শিকার জমে উঠবে৷ এ ধরনের  চিন্তা-প্রসূত কারসাজিতে রাজ্যের  পলিটিক্যাল দাবাড়ুদের মাথায় যে নেই তাও বা কী করে হলপ করে বলা যাবে?

(৪) চতুর্থতঃ, অতীতে রাজ্যে ঘটে গেছে বলেই সে অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যাচ্ছে, উত্তর ত্রিপুরা জেলার কাঞ্চনপুর, দশদা, পানিসাগর  প্রমুখ এলাকাগুলোতে রিয়াং শরনার্থীদের পুনর্বাসন নিয়ে যে জট পাকিয়েছে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলো থেকে বসবাসরত বাঙালীদের  উচ্ছেদ পূর্বক জমি জায়গা খালি করে মুশকিল আসানের পথ খোঁজার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ তাই হয়তো বা  দামছড়ার ঘটনাকে উস্কানিমূলক বলে ধরা যেতে পারে৷ কিন্তু,এরকম ভাবতে গেলে একটু দ্বিধাও দেখা দেয়৷ তাহলে এর  পর পরই ডেমজুমের গাড়ী আক্রমণের ঘটনাটির পেছনেই বা কী ধরনের  কুমতলব থাকতে পারে এ নিয়ে  প্রশ্ণ থেকে যাচ্ছে৷

(৫) পরিশেষে বলব, যদি উল্লেখিত চতুর্থ কারণটি বাস্তবিকই সত্য হয়ে প্রমাণের অপেক্ষায় থেকেই থাকে, তবে  এ দুটো ঘটনাই অত্যন্ত পাকা-পোক্ত মাথাদেরই কাজ বলে বিবেচিত হতে কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়৷ তাহলে জল বহুদূর গড়াবে সন্দেহের অবকাশ বোধ হয় নেই৷ তবে, আশা করব এরকমটা না হলেই সর্র্বেত্তম হবে৷ কারণ, এ রাজ্যে বিগত শতাব্দীর সাত-আট নয়-এর দশকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশটা কিন্তু এখন আর নেই৷ রাজ্যের অভিশপ্ত দিনগুলোর ভুক্তভোগীরামাত্রই ডান-বাম-রামের সকলেরই এসম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পেয়ে গেছেন বলেই, ভবিষ্যতের পদক্ষেপ যে পূর্বেকার  মতই রূপ নেবে এমন ভাবাটা বিভ্রান্তিকর নাও হতে পারে৷