জড়বাদ, পুঁজিবাদ ও ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শনের ত্রুটি - ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মানুষ সাধারণতঃ যে সমস্ত দর্শনকে মেনে চলে তাদের ৪শ্রেণীতে ভাগ করা যায়৷

১) জড় কেন্দ্রিক দর্শন Matter Centered Philosophy)

২) আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক দর্শন Self Centered Philosophy)

৩) ডগ্মা বা ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন Dogma  Centered Philosophy)

৪) ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন God Centered Philosophy)

জড়কেন্দ্রিক দর্শন

 এই দর্শনের অনুসারীরা জড় ছাড়া অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার  করে না৷ এরা বলে, মন জড়েরই  গুণ, এছাড়া বেশি কিছু নয়৷ চৈতন্য বা পরমাত্মাকেও এরা মানে না৷  মাকর্সবাদ জড়কেন্দ্রিক দর্শনের উদাহরণ৷

প্রাউট-প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘‘মানুষের ক্ষুধা অনন্ত৷ এই অনন্ত ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয়, তাহলে মানুষে মানুষে সংঘর্ষ বাধবেই৷ কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব  দেখা দেবে৷ মানুষের এই ক্ষুধা মানস ও অধ্যাত্ম সম্পদেই মিটাতে হবে৷ হ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে হবে৷  (আজকের সমস্যা)

কম্যুনিষ্ট সরকার জনসাধারণের ওপর বল প্রয়োগ করে জাগতিক সম্পদ (খাদ্য-বস্ত্রাদি) নাগরিকদের মধ্যে সমবন্টন করে যদি দেও প্রথম প্রথম পুলিশ-মিলিটারীর ভয়ে মানুষ অনিচ্ছায় মেনে নিতে বাধ্য হবে, কিন্তু কিছুদিন ধীরে ধীরে তাদের মনে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকবে৷ মানুষ মনের ওপর বেশিদিন  চাপ সহ্য করতে পারে না, তাই অনন্তের পিয়াসী মন কিছুদিন পরে বিদ্রোহ করবে৷ তাই অচিরেই বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব দেখা দেবে ও কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে৷

কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ঃ

একই গোষ্ঠীর হাতে (কম্যুনিষ্ট পার্টি) থাকায় সরকার অত্যাচারী ডিক্টেটরে পরিণত হয়৷ বলা হয়ে থাকে, Absolute Power Corrupts Absolutely

কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থাপনায় ব্যষ্টি-স্বাধীনতা থাকে না৷ স্বাধীনতাভাবে  মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না৷ স্বাধীনভাবে বই পত্র-পত্রিকা প্রকাশের সুযোগ থাকে না৷ স্বাধীনভাবে বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার সুযোগ থাকে না৷ অর্থাৎ কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থায় মানুষের জীবন  ক্রীতদাসের মত৷ কম্যুনিষ্ট দেশে স্বাধীন মত প্রকাশ করলে তার স্থান হয় ‘ক্যাম্প’ নামক জেলে৷

স্বভাবগতভাবে মানুষ জীবনের সর্ববিধ ক্ষেত্রে মুক্তি চায়, এমনকি জানায়োররাও মুক্তি চায়৷ উত্তম ভোজন ও কিছুটা নিশ্চিন্ত জীবন পেয়েও মৃগশিশু চিড়িয়াখানায় থাকতে চাইবে না৷ সুযোগ পেলেই সে বেড়া ডিঙ্গিয়ে বাইরে পালাবে৷ বেয়োনেটের খোঁচা মেরে থাকে বেড়ার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে৷ নইলে সে থাকবে না৷

আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক দর্শনঃ

আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক দর্শন Self Centered Philosophy) - এর উদাহরণ হ’ল -পুঁজিবাদ৷

এর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাউট-প্রবক্তা বলেছেন, ‘‘ভোগ্যপণ্যের অন্তর্নিহিত সুপ্ত  শক্তিই পুঁজি৷ বুদ্ধিমান লোকেরা ভোগ্যপণ্যরূপে অন্যদের থেকে বেশি পুঁজি সংগ্রহ করে, কিন্তু  যেহেতু ভোগ্যপণ্য বেশিদিন ধরে জমিয়ে রাখা যায় না, সেইজন্যে  তারা পুঁজি হিসেবে জমাতে থাকে অর্থ৷ এদেরই বলে পুঁজিবাদী৷ এই পুঁজিবাদীরা ‘ভূমা-উত্তরাধিকার তত্ত্বের বিরোধী৷

ভূমা উত্তরাধিকার তত্ত্ব কী?--- এই বিশ্বজগৎ সকলের পৈত্রিক সম্পত্তি৷ আমরা সকলে এক বিশ্বভিত্তিক পরিবারের সদস্য৷ পরম পুরুষ (ভূমা সত্তা) আমাদের পিতা৷ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মত আমাদের উচিত সবাই ‘নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচাও’ নীতি নিয়ে চলা৷ বিশ্বের ব্যবহৃত সমস্ত সম্পদ কোনো বিশেষ ব্যষ্টি, রাষ্ট্র বা জাতির সম্পত্তি নয়৷ সকলের এই সম্পদ ভোগ করার অধিকার আছে৷ এই হ’ল ভূমা উত্তরাধিকার তত্ত্ব৷

কিন্তু বাস্তবে আমরা এই সমাজে দেখছি, একদিকে বিশাল পুঁজির পাহাড়, অন্যদিকে ভূখা মানুষের ভীড়৷ বিশ্বের সম্পদতা সীমিত৷ এক জায়গায় প্রয়োজনাতিরিক্ত বিপুল সম্পদ সঞ্চিত হলে অন্যত্র তো অভাব দেখা দেবেই৷ একজনকার বিপুল সম্পদের অপচয়, বহু মানুষের অভাবের কারণে মৃত্যু ঘটায়৷

এটাই পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শোষণ,এই শোষণ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা চলে না৷  সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে৷

‘‘বর্তমান পৃথিবীর ১ শতাংশ  মানুষের কাছে আছে বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি সম্পদ৷ অথচ অন্যদিকের চিত্র হ’ল, বর্তমানে  প্রায় ৮২ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কারণে ক্ষুধার শিকার৷ এদেশেও বছরে প্রায় ২কোটি মানুষের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধাজনিত রোগে মৃত্যু হয়৷ অথচ এই ভারতবর্ষে ১০০ জন শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের মাত্র ১ বছরে সম্পদবৃদ্ধির পরিমাণ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা৷

বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই চরম বেকার সমস্যা তীব্রতর হয়ে চলেছে৷ বিশ্বের তথাকথিত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তো বটেই, খোদ চরম পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্র্মনীতেও তীব্র বেকার সমস্যা৷

বর্তমান আমেরিকার ৩২ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৫ কোটি  ২ লক্ষ মানুষ বেকার৷ এরমধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ বেকারভাতাও পায় না৷ আর বাকি ৪ কোটি ৪ লক্ষ মানুষকে সরকারের কাছ থেকে বেকারভাতা নিয়ে জীবিকা অর্জন করতে হয়৷

বেশ কিছুদিন আগে গ্রীস, স্পেন, ইতালির সব দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন সংকট দেখা দেয় যে বিভিন্ন দেশ সাহায্যের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের মত দেশও আর্থিক সাহায্য করেছিল৷

বর্তমান ভারতবর্ষের বেকার সংখ্যা ৬.৬ শতাংশ৷ অর্র্থৎ প্রায় ৭কোটি ৯৫ লক্ষ ৩৭ হাজার ৯০০ জন৷  পঃবঙ্গে  বেকার ৪.৬ শতাংশ৷ সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ রুখতে দীর্ঘ লকডাউনের পর সব দেশেই বেকার সমস্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷

পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থার কারণে অর্থের চরম অসম বন্টনেরই এটা পরিণতি৷

পুঁজিবাদে কেবল অর্থনৈতিক শোষণই হয় না৷ পুঁজিপতিরা তাদের বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত সম্পদের অপব্যবহার করে রাজনীতিকেও কলুষিত করে৷ পুঁজিপতিদের অর্থানুকুল্যে অযোগ্য অসৎ রাজনৈতিক নেতারা যোগ্য সৎনেতা-নেত্রীদের নির্বাচনে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে৷

পুঁজিপতিদেরই অর্থনৈতিক মদতে দূরদর্শন পত্র-পত্রিকা সর্বত্র চলে অসংসৃকতি রমরমা৷

ধর্মের ক্ষেত্রেও পুঁজিপতিরা ধর্মব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমান অর্থসাহায্য করে তাদের বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ মঠ-মন্দির নির্র্মণ করে দেয়৷ তাদের জন্যে মহাসমারোহে ধর্মসভার আয়োজন করে’ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে’ প্রকৃত অন্তমুখী অধ্যাত্ম সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে৷

তাই পুঁজিবাদী দর্শন প্রকৃতপক্ষে দেশের মূল সমস্যাগুলিকেই  তীব্রতর করে তোলে৷

ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শন

ভাবজড়তা কেন্দ্রিক দর্শনের ধবজাধারীরা নানা প্রকার অযৌক্তিক ভাবাবেগ বা সেন্টিমেন্ট, অন্ধবিশ্বাস,কুসংস্কার সহ বিভিন্ন উদ্ভট উদ্ভটতত্ত্ব মানুষের সামনে তুলে ধরে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে ও এইভাবে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়৷

এরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদকেই মদত দেয়৷ এরা মানুষের সমাজের প্রকৃত অর্থনৈতিক সমস্যা, প্রকৃত রাজনৈতিক সমস্যা বা প্রকৃত কোনো সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে ভাবাবেগের বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে মানুষকে শোষণ করে৷

এরা সমাজে জাত-পাত, ধর্মমত বা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বিভাজন এনে বা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাবাদ বা জাতীয়তাবাদের  জিগির তুলে মানবসমাজকে শতধাভিন্ন করে রাখে৷ এতে তাদের শোষণের ষোলো আনা সুবিধা৷

এইভাবে বিভিন্ন জিও-সেন্টিমেন্ট, সোসিও সেন্টিমেন্টকে কেন্দ্র করে  এরা পারস্পরিক বিদ্বেষ, সংঘর্ষ ও রক্তপাত ঘটিয়ে থাকে৷

ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন

ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন ঈশ্বরকে জীবনের ধ্রুবতারা করে এগিয়ে চলে ও সমগ্র জগৎকে ঈশ্বরের বিকাশ জেনে জগতের সেবায় আত্মনিয়োগ করার কথা বলে৷ প্রাউট প্রকৃতপক্ষে এই ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন৷

নোতুন মানুষ

এই দর্শনের গোড়ার কথা নোতুন মানুষ ও নোতুন পরিকল্পনা৷ অর্থাৎ যুগপৎ আদর্শ নীতিবাদ, মানুষ গড়া ও আদর্শ সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তথা অর্থনীতির ক্ষেত্রে  সর্বসাধারণের কল্যাণে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ৷

প্রথমোক্ত তিন দর্শনে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশের কোনো  আদর্শ নীতি বা পদ্ধতি নেই৷ মানুষের জীবনের অতি মূল্যবান  সম্পদ হ’ল তার সুদৃঢ় নৈতিকতা৷ মানুষের এই নৈতিক মানের  ক্রমবৃদ্ধির কোনো অনুশীলন ওই তিন দর্শনে নেই৷ মানুষের জীবনের মৌলিক কর্তব্য কী হবে, মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য কী হবে --- সে সম্পর্ক ওই সমস্ত দর্শন মানুষকে কোনো নির্দেশনাই দিতে পারে না৷ তাই ওই দর্শনগুলি হ’ল দিশাহীন দর্শন৷

ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন তথা আদর্শ প্রথমতঃ মানুষের মনুষ্যত্বের  বিকাশসাধনের পথ দেখায়৷ এই আদর্শ মানুষের জীবনকে দৃঢ়ভাবে নৈতিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে--- যা মানবজীবনের তথা সমাজের অগ্রগতির অত্যাবশ্যক আধারশিলা বা ভিত্তিপ্রস্তর৷

এই জগৎ ঈশ্বরের বিকাশ৷ বিশ্বের সমস্ত কিছুর মধ্যে ঈশ্বর বিরাজিত৷ তাই ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের অনুসারীদের কাছে জগতের সেবা ঈশ্বর সেবারই নামান্তর৷

নোতুন পরিকল্পনা

ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের অনুসারীরা নোতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একান্তভাবে ‘ভূমা উত্তরাধিকার তত্ত্বে’ বিশ্বাসী৷ তাই প্রাউট চায় বিশ্বের সবার কল্যাণে বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও যুক্তি সঙ্গত বন্টন৷ তাই প্রাউট যেমন বিশ্বের সমস্ত প্রকার সম্পদের প্রগতিশীল উপযোগের মূল পঞ্চসিদ্ধান্ত দিয়েছে, তেমনি সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের জন্যে প্রগতিশীল কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, সমবায়নীতি, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি, ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা নীতি, স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন-নীতি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তথা অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রভৃতি দিয়ে আদর্শ, সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর মানব সমাজ রচনার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার করেছে৷

প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের মূল উদ্দেশ্য হ’ল---‘‘সমাজের প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির  গ্যারান্টী পাক৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুযোগ পাক৷ প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলদ্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সমস্ত উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক৷