কেন্দ্রিত  অর্থব্যবস্থার পরিবর্তন চাই

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ ২০২০ সালে সারা দেশের অর্থনীতি যেখানে বিধবস্ত, বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে, কোটি কোটি সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য ও বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছে অনাহারে৷ মৃত্যু অভাবে, ঋণশোধ করতে অসমর্থ হয়ে আত্মহত্যার বহু সংবাদও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে,সেখানে এই বছরেই এই দেশেরই সাতজন ধনকুবেরের সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪,৭১,২৯৬ কোটি টাকা৷ কী অদ্ভূত বৈপরিত্ব!

‘ব্লুমমার্গ বিলিওনেয়ার ইণ্ডেক্সের পক্ষ থেকেই এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে৷ এই তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এ বছর (২০২০ সালে) ভারতের  শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের অন্যতম গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ২১১০ কোটি ডলার অর্থাৎ ১,৫৫,৩৮০.৪০ কোটি টাকা৷ গত বছর ডিসেম্বরে তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮৩,২১৩,২০ কোটি টাকা৷ গত ১৮ই ডিসেম্বর তাঁর সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ২৩৮৫৯৩.৬ কোটি টাকা৷

এমনিভাবে ভারতের সবচেয়ে যে ধনী ব্যষ্টি মুকেশ আম্বানি এবছর  তার সম্পত্তি বেড়েছে ১৩৩২৮৮.৪ কোটি টাকা এই হল ভারতের কেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থার চেহারা---যেখানে দেশের অর্থশক্তি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে৷

সমাজ কথাটার মানে হ’ল সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলা৷ মানুষ সামাজিক জীব৷ সবাইকে নিয়েই চলতে হয়৷ তবেই সমগ্র সমাজের উন্নতি৷ কিন্তু যদি দেখা যায়,দেশের কোটি কোটি জনগণের করুণ অর্থনৈতিক অবস্থা, আর মুষ্টিমেয় কয়েক জনের হু-হু করে উন্নতি হচ্ছে, তা হলে স্পষ্ট বোঝা যায়, অন্যদের শোষণ করেই ওই মুষ্টিমেয় কয়েকজন লাভবান হয়েছে৷

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এবছরে দেখা গেছে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪-তে৷ এটা ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলির অবস্থা ভারত থেকে ভাল৷ ক্ষুধাসূচকে শ্রীলঙ্কা (৬৪), নেপাল (৭৩), বাংলাদেশ (৭৫), মায়ানমার (৭৮), এমনকি পাকিস্তান (৮৮) ---এসব দেশ ও এগিয়ে৷

সূচকসংখ্যা কম মানে ক্ষুধার্ত মানুষের হার কম, সূচক সংখ্যা বেশি মানে ক্ষুধার্ত মানুষের হার বেশি৷

কেন এমনটা হচ্ছে? তার কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট৷ দেশে চলছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা৷ পুঁজিপতিদের  কাছে এই যে বিশাল পুঁজির পাহাড়, গরীব মানুষকে শোষণ করা এই বিপুল পরিমান অর্থেই পুষ্ট শাসকদল সহ কমবেশি (দু-একটি বাদে) সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল৷ আদানি ও আম্বানি প্রভৃতি পুঁজিপতি গোষ্ঠী শাসকদলকেও জিততে বস্তা বস্তা টাকা ঢেলেছে, তাদের টাকায় পার্টির ফাণ্ড যেমন ফুলে ফেঁপে উঠেছে, ব্যষ্টিগত ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ও সম্পত্তিও ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছে৷ তাই ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা যে সরকারী আইন প্রণয়ন করেন তার পেছনে ওই পুঁজিপতিদের স্বার্থই নিহিত আছে৷ পুঁজিপতিরাও সরকারের তৈরী আইন ও বিভিন্ন প্রোজেক্ট-এর মাধ্যমে তাদের দানের টাকা সুদে আসলে উঠিয়ে নেয়৷ মাঝখান থেকে রক্তশূন্য হয় কোটি কোটি দেশবাসী৷

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আনা কৃষি আইনেই মূল উদ্দেশ্য এইটাই৷ কেন্দ্রীয় সরকার এখন পিছিয়ে যেতে পারছেন না৷ কারণ পুঁজিপতিদের কাছে তাঁদের হাত-পা বাঁধা-চোখ বাঁধা

কিন্তু এ তো অন্যায়৷ এই দেশের সমস্ত সম্পদে দেশের প্রতিটি মানুষের যৌথ অধিকার রয়েছে৷ মহান দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন,‘‘এ বিশ্বজগৎ আমাদের সকলের পৈত্রিক সম্পত্তি৷ আমরা সকলে এক বিশ্বভিত্তিক যৌথ পরিবারের সদস্য৷ পরমপুরুষ (পরমব্রহ্ম) আমাদের পিতা৷ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মতই আমাদের উচিত, সবাই ‘নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচাও’ নীতি নিয়ে চলা৷’’

তাই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের ঘরে প্রাচুর্যের স্রোত বয়ে যাক, আর দেশের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে তিলে তিলে শুকিয়ে মরুক, এই অবস্থাকে কোনোমতেই ন্যায় সঙ্গত বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ তাই এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন একান্ত জরুরী, মার্কসবাদী অর্থব্যবস্থাকে মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ এই ব্যবস্থায় দেশের সমস্ত ধনসম্পত্তির মালিক সরকার৷ আর সরকার চালায় কম্যুনিষ্ট পার্টি৷ কম্যুনিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় একটাই পার্টি থাকে৷ ওই পার্টির নেতাদের হাতেই থাকে সমস্ত শিল্প ও কৃষিফার্মের পরিচালনার ভার৷ তারাই ঐসবের  মালিক৷ উৎপাদন, বন্টন, মজুরী সমস্ত তাদেরই মর্জিতেই৷ তাই তারা হয়ে ওঠে স্বৈরতন্ত্রী৷ সাধারণ মানুষের অবস্থা এখানে ক্রীতদাসের মত৷ তাই এই ব্যবস্থাও আজ অচল৷

এ অবস্থায় প্রাউট-নির্দেশিত প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রই সর্বপ্রকার  শোষণমুক্ত সমাজ গড়বার পূর্ণ-প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে৷

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় বা মাকর্সবাদী অর্থব্যবস্থায় অর্থনীতি কেন্দ্রীভূত হয়৷ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে অথবা শাসন ক্ষমতাসীন পার্টির হাতে, প্রাউটের অর্থনীতি বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি তথা অর্থনৈতিক গণতন্ত্র৷  এখানে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকবে জনগণের  হাতে মূলতঃ সমবায়ের মাধ্যমে৷

বর্তমান পুঁজিপতিদের হাতে দেশের সমূহ অর্থব্যবস্থা৷ অর্থশক্তির মাধ্যমে দেশের সর্বক্ষেত্রেই তাদের অবাধ প্রতিপত্তি চলে৷ এব্যবস্থার অবসান একান্ত জরুরী৷ আর তার জন্যে আগে জরুরী হল জনমত৷ মানুষকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ভয়ঙ্কর আগ্রাসী রূপটি সম্পর্কে আগে সচেতন হতে হবে৷ এই অব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নীতিবাদীর নেতৃত্বে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তথা বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে৷